পারমিতা দাস, লেখিকা, কলকাতা

উৎসব চলছে। সেই সেপ্টেম্বর মাসে গণেশ পুজো দিয়ে মোটামুটিভাবে শুরু ধরা যেতে পারে। একে একে বিশ্বকর্মা পূজা, মহরম, দুর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা, ছট পূজা হয়ে এখনও প্রবল বিক্রমে চলছে জগদ্ধাত্রী পূজা। আর এইসব উৎসব অনুষ্ঠানের অফুরন্ত জাঁকজমক আর গা জোয়ারি উৎসাহে যে শব্দটি উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে আর দিন দিন অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হয়ে উঠছে তা হল পরিবেশ। ক্ষমতাশালীদের প্রচ্ছন্ন বা প্রকট মদতে এবং সাধারণ মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অজ্ঞতায় উৎসবের আছিলায় আমরা রোজই একটু একটু করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি।

সকালবেলা পেপার খুলেই দেখছি দিল্লীতে দূষণের ফলে জরুরী অবস্থা জারী করতে হয়েছে। আমরা বলছি, দেখেছ কি অবস্থা!! আর সন্ধ্যেবেলা বন্ধুবান্ধব ডেকে মহা উল্লাসে বাজি (শব্দ ও নিশব্দ) ফাটাচ্ছি। আমরা বলছি, গ্রেটা থুনবার্গের কথা শুনেছ? ওইটুকু মেয়ে গোটা বিশ্বকে কেমন তাক লাগিয়ে দিয়েছে! আর বেমালুম বাজারের ব্যাগ ভুলে (জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে) দোকানির এগিয়ে দেওয়া পলিথিনের ব্যাগে সবজি, ফল, মাছ, মাংস কিনে অথবা শপিং মল থেকে পাঁচ টাকা বা সাত টাকা দিয়ে সুদৃশ্য পলিপ্যাক কিনে তাতে জিনিষপত্র নিয়ে হাত দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফিরছি। আমরা বলছি, অস্কার জয়ী আশি বছরের বৃদ্ধা জেন ফন্ডা, তাকেও কিনা জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাতকরা পরিয়ে? ছি ছি। বেমালুম উহ্য থেকে যাচ্ছে তাঁর প্রতিবাদের বিষয়বস্তু। আমরা আম্লানবদনে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে ঠাকুর বিসর্জন করছি অথবা ছটে যাচ্ছি অথবা ঈদ পালন করছি অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছি। আইন আইনের মত আছে, আমরা রোজ রোজ তাকে কলা দেখিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে বীরত্ব প্রকাশ করে চলেছি।  

জনগণের এই অর্বাচীন উল্লম্ফন আর কতদিন চলবে? আর কতদিন আমরা বালিতে মুখ গুঁজে রেখে নিজেদের সুরক্ষিত ভাবব? আমাজন জ্বলবে, কঙ্গো জ্বলবে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হবে, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে হিমালয় প্রতিদিন একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, দক্ষিণের কাবেরী নদী থেকে আসানসোলের নুনিয়া নদী রাসায়নিক দূষণে ফেনায় ফেনায় ভরে যাবে আর আমরা সেই ফেনার সঙ্গে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে নিজেদের আরও গন্ডমূর্খ প্রমাণ করে যাব? আর কতকাল ক্ষমতাশালী এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা কখনও জাতপাত আবার কখনও ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণের মধ্যে বিভাজন করে যাবে আর আমরা, দেশীয় জনগণ, সেই রাজনৈতিক ডুগডুগির তালে তালে বাঙালী বিহারী কাশ্মীরি হিন্দু মুসলিম বলে ঊর্দ্ধবাহু হয়ে নৃত্য করব? এখনও কি সময় আসেনি রাজনীতিকে নস্যাৎ করে সাধারণ জনগণের একজোট হওয়ার? এখনও কি আমরা প্রতিজ্ঞা করব না কোন অজুহাতেই আর একটাও গাছ কাটা যাবে না? একটাও নদী, একটাও জলাশয় দূষিত করা যাবে না? একটাও কারখানাকে কালো ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে ফেলতে দেওয়া যাবে না? বাজি (শব্দ বা নিঃশব্দ) ছাড়াই উৎসব অনুষ্ঠান হবে? ডিজে ছাড়াই বিসর্জন বা যেকোন রকম অনুষ্ঠান (ধর্মীয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক) হবে? আর কবে আমরা রুখে দাঁড়াব? আর কবে আমরা নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিজ্ঞা নেব? সময় বড় কম। আসুন কিছু করি আজই, এখনই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours