মহালয়া চট্টোপাধ্যায়, লেখিকা ও অধ্যাপিকা, কলকাতা:

কাল সন্ধ্যায় তাঁর চলে যাবার খবর শোনা ইস্তক ফেসবুকের পাতা জুড়ে স্মৃতিচারণ। ওনার  বহুধা-বিস্তৃত কর্মের জন্য অনেকেই তাঁর কাছাকাছি এসেছেন - তাদের ব্যক্তিগত`পরিচয় আর সান্নিধ্যের সুবাদে  নানা আঙ্গিকে মানুষটির নানা পরিচয় ফুটে উঠেছে। আমি তার মধ্যে কোন দলেই পরি না। তাও মাঝে মাঝে কয়েক পলকের দেখা কখনো – তাই নিয়েই আমার স্মরণের ডালি। 

১৯৮০
সদ্য কলেজে ঢুকেছি। সারা কলকাতা জুড়ে পথের পাঁচালির পঁচিশ বছর বলে সত্যজিত রায়ের সিনেমা দেখানো হচ্ছে। আমি আর মা গ্লোবে নাইট শোতে কিছু একটা দেখতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময়ে একটা ঢাকুরিয়ার মিনিবাসে উঠেছি, উনিও উঠলেন। মা আর উনি পাশাপাশি, আমি সামনের সীটে। উনি মাকে জিগ্যেস করলেন - আপনাকে যাদবপুরে দেখেছি মনে হচ্ছে? মা সম্মতি জানালেন যে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে তাই আবার গবেষণাতে ফিরতে চাইছি। উনি বললেন - বেশ, বেশ। শেষ অবধি মা সরস্বতীর আরাধনাই সবচেয়ে ভালো। তারপরে সিনেমা নিয়ে আলোচনা। আমাকে বললেন কি কর? কলেজে পড়ি, জানাতে বললেন - আরে তুমি তো ভারি ভালো মেয়ে, কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে না গিয়ে মায়ের সঙ্গে সিনেমা দেখছ। আমি বললাম ,সে তো দেখছি বটেই, কিন্তু মা এই সিনেমাটা দেখতে চেয়েছিলেন, তাই টিকিট কেটে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি বললেন - সে তো আরো ভালো। মায়ের খেয়াল রাখছো!

১৯৮৬
আমি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করি। আমাদের আর্বান সেন্টারের বার্ষিক সম্মেলন। নগরবিদ্যাচর্চার সেই আদিযুগে সেবার একটা পর্ব ছিল সাহিত্যে কলকাতা। সেখানে উনি একজন আমন্ত্রিত বক্তা। দক্ষিণ কলকাতায় থাকার সুবাদে আমার দায়িত্ব ছিল ওনাকে কাঁটাকলে নিয়ে যাবার। সারা রাস্তা অনেক গল্প হল। বললেন - যাই বল, সতেরো বছর ঘর করেছ্‌ কিন্তু তোমাদের এই ইকনমিকস বাবা খুব ভয়ঙ্কর!। আমার ফুলশয্যার পরের দিন, উনি বইয়ের প্রুফ দেখছেন, একটা জটিল ছবি আর তার তলায় লেখা - a simple model of..... ।(এই গল্পটা অমর্ত্য সেন নোবেল প্রাইজ পাবার পরে  উনি স্বভাবসিদ্ধ ঢং-এ দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন)। তবে আজ যেতে রাজি হয়েছি শুধু বিপ্লবদার জন্য। লন্ডনে আমার দুঃসময়ে অনেক করেছেন।

২০০৭
আমার ছোট ছেলে তখন নিয়মিত নাটক করে স্বপ্নসন্ধানীতে। রবীন্দ্রনাথের বিদূষক গল্পের সূত্র নিয়ে একটা নাটক হয়েছিল, তাতে সে গ্রামের একটি প্রতিবাদী ছেলের ভূমিকায় ছিল, বেশ বড় রোল।সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই নাটকের অন্য তাৎপর্য । উনি ছিলেন দর্শকাসনে ।নাটকের শেষে রুশতীদি আমার সঙ্গে ওনার পরিচয় করিয়ে দিল। উনি আমার ছেলেকে দেখে বললেন - ওমা, তুই তো একেবারে বাচ্চা রে, এত শক্ত রোলটা করলি কি করে! দারুণ করেছিস। চালিয়ে যা, জীবনেও যেন এরকম হ'তে পারিস।

২০১৩
বড় ছেলে তখন বেশ কবিতা লিখছে, একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সহসম্পাদক। বইমেলার শেষদিনে তাদের কবি সম্মেলন। আমাদের তখন একটা মারুতি ওমনি ছিল, যাতে ড্রাইভার সহ আটজন`বসা যায়। ছেলে গাড়ি চাইল, অনেককে নিয়ে যেতে হবে, আবার পৌঁছতে হবে। আর তার বদলে সে নিয়ম ভেঙে আমাকে তাদের কবিতার অনুষ্ঠানে থাকতে দেবে। তাই সেদিন অনেকটা সময়ে ওনার সঙ্গে ছিলাম, দেশের পরিস্থিতি, মেয়েদের হালচাল নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল।

আমি নেহাতই সাহিত্যের পাঠিকা, সেই কবে থেকে ওনার লেখার অনুরাগী। ওনার আকাডেমিক লেখাও কিছু পড়েছি। কিন্তু লেখার বাইরে ওনার জীবনবোধের অনেক বড় ভক্ত। যেভাবে উনি শারীরিক, সামাজিক সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষদিন অবধি লড়াই করলেন, সেটা সব মানূষের শিক্ষনীয়, বিশেষতঃ মেয়েদের।

ওনার বৈদগ্ধ কিন্তু কখনও ওনাকে আকাশে তোলেনি- বরং রেখেছে মাটির কাছাকাছি। একসময়ে উনি যখন মেয়েদের লেখাপড়া, তাদের পশুপ্রীতি ইত্যাদি নিয়ে লিখতেন, তখন নিজেদের বড় হ'বার সঙ্গে মিলিয়ে নিতাম। আবার যখন পরবর্তী জীবনে 'করুণা তোমার...' আরেকবার পড়লাম, তখন বুঝলাম মা আর অধ্যাপিকা একসঙ্গে হলে কত কিছু সামলে তবে কনফারেন্সে পেপার পড়তে যেতে হয়!

কাল রাতে ভাবছিলাম, যিনি হায়দ্রাবাদ থেকে কুম্ভে চলে যান, ট্রাকবাহনে অরুণাচলের প্রান্তে যেতে ভয় পান না, তার সঙ্গে আমার চারবার মোলাকাত সবই পথে! আমার স্বভাববশতঃ এই ফেসবুকের যুগেও কোনদিন একটা বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাই নি। ব্যস্ত মানুষদের উত্যক্ত করতে কখন মন চায় নি। তাই আজও দূর থেকেই রাখলাম আমার প্রণতি।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours