নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

নবনীতা দেব সেনের -“স্বাগত দেবদূত “ কবিতা থেকে নেয়া কিছু লাইন লিখে 
শ্রদ্ধা জানাই উনার বিদেহী আত্মার প্রতি -

“এমন সময়
অবিকল দেবদূত যেমন স্বাগত
তেমনই উথ্বিত হয় কোনো শব্দ |
ভয়ানক চেষ্টা ক’রে
একগলা জল ঠেলে-ঠেলে
সারারাত হেঁটে এসে কেউ
যেন এক প্রিয়ের সৎকার ক’রে গাঁয়ে ফিরে গেলো |
ভয়ানক চেষ্টা ক’রে
কেউ একটা কথা ক’য়ে ওঠে
কী আশ্চর্য ইন্দ্রজাল----
উচ্চারিত শব্দ যেন মন্ত্রের মতন ত্রাম করে----
মন্ত্রের মতন সব মৃত চোখ ত্রস্তে বেঁচে ওঠে
ফুলের বাগানে যেন হাওয়া বয়
কোনায় আগুন জ্বলে, তাকে বই, বিছানায় রেশমি চাদর
নিস্তব্ধতা এইমাত্র পথে নেমে গেছে |
পর্দা দোলে, উষ্ণ শুভ সৌহার্দ্যের বাতাস কাঁপিয়ে
শব্দ ঘোরে--- ঘর ভ’রে দয়াময় শব্দ ঘোরে-ফেরে
ঘর ভ’রে শব্দময়ী করুণা ছড়ায় |”

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল, উপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, কবি, শিক্ষাবিদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখিকা নবনীতা দেব সেনের জীবনাবসান হল ৭ নভেম্বর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। পদ্মশ্রী-সম্মানে ভূষিত লেখিকার ব্যক্তিগত জীবনে উনি। 
দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তার বাবা- মা'র 'ভাল-বাসা'(এখনো সেখানেই বসবাস করেন) যে গৃহে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারানী দেবী সে যুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। ছেলেবেলায় এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর , হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৫- ২০০২ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্য একদেমি পুরস্কার পান তার আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা' গ্রন্থের জন্যে। এছাড়াও তিনি মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
১৯৫৯ প্রথম বই ‘প্রথম প্রত্যয়’ প্রকাশিত হয়। নটী নবনীতা-র জন্য ১৯৯৯ সালে তাঁকে সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার।
২০০০ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য – ভালোবাসার বারান্দা, হে পূর্ণ তব চরণের কাছে ও ট্র্যাকবাহনে ম্যাকমোহনে। দ্বিরাগমন ,দেশান্তর ,শনি-রবি ।আমি অনুপম , অ্যালবাট্রস ,সীতা থেকে শুরু ,তুমি মন স্থীর করো, প্রত্যয় , ইত্যাদি অনেক অনেক উল্লেখ যোগ্য কাজ আছে উনার। 
জীবনসঙ্গী হিসেবে যার হাত ধরেছিলেন ১৯৬০ এ তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।
নবনীতা দেব সেনের মৃত্যুতে শোকাহত সমস্ত সংস্কৃতি জগত ।
এতক্ষণ যে মানুষটার সম্পর্কে বললাম , এসব তথ্যগুলো আজ আবার খুব বেশী পোষ্ট হয়েছে সামাজিক মাধ্যম গুলোতেও । এই তথ্যগুলোর মাঝে একজন মানুষের পরিচিতি টুকুই কেবল আছে । 
কিন্তু যখন উনার লেখার ভেতরে ডুবে যায় পাঠক তখনি লেখক নবনীতা দেব সেনের ধীশক্তি ও মেধার পরিচয় পায় । উনার অনেক কটা বই পড়বার সুযোগ হয়েছিল আমার , সবচেয়ে ভালো লেগেছিল আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা' । অসাধারণ লেগেছিল । কিন্তু, বইটি পড়তে গিয়ে আমি কতকিছু যে শিখলাম, তার হিসাব দিতে পারব না। 
"নটী নবনীতা" প্রবন্ধটি হাস্যরসে ভরপুর৷ লেখক নিজের অভিনয় জীবনের বিভিন্ন ধাপ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে উৎফুল্ল হয়ে উঠবেন। হোক না সেটা নিউ এম্পায়ার স্টেজ বা কোনও রঙ্গমঞ্চ, বা ফিচার ফিল্মে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে তোলা হাই, সামান্য সুযোগের সদ্ব্যবহার যে উনি করেছিলেন, তার পরিচয় পাবেন এই গদ্যে৷  অসাধারণ সাবলীল ভঙ্গিতে লেখা । 
আর আমরা, মানে বইপাগল পাঠকরা পেয়ে যাই এক সোজা কথা সোজাভাবে বলতে পারা মানুষকে, যাঁর লেখনী গর্জে উঠেছে কালের সাথে, মানুষের সাথে, যাঁর লেখনী স্নিগ্ধ করেছে আমাদের মন, আমাদের মননকে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours