অর্পিতা দে, সাংবাদিক, কলকাতা:

ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা দেশ,কাল,সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে অবিলম্বেই পৌঁছে যেতে পারি  যে কোনো মানুষের কাছে, এছাড়াও  যা কিছু অজানা তা মুহূর্তেই অবগত করতে পারি| সেই সূত্রেই একে ওপরের কাছে ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়  বার্তা প্রেরণের জন্য ক্রমাগত জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়েছে ইন্টারনেট দ্বারা চালিত ম্যাসেজিং অ্যাপ গুলো| এদের মধ্যে এক নম্বর তালিকায় আছে “হোয়াটসঅ্যাপ” | ২০১৯ সালের জরিপের নিরিখে জানা গেছে সারা বিশ্বে ১.৫ বিলিয়ান মানুষ সক্রিয় ভাবে এই অ্যাপ ব্যবহার করেন | এই অ্যাপের জনপ্রিয়তার বিশেষ কারন হল তথ্যের গোপনীয়তা বজায়, কিন্তু এত সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিগত কিংবা অফিস সংক্রান্ত অথবা গোপনীয় তথ্য আদতে কতটা নিরাপদ? সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠে এসেছে ইসরায়েলের এন.এস.ও নামক সংস্থার তৈরী “পেগাসাস” নামক সফ্টওয়্যারের সাহায্যে ,সারা বিশ্বের বিভিন্ন পেশার মানুষের হোয়াটসঅ্যাপে হ্যাকিং এর মাধ্যমে সেই সব ব্যক্তিদের  উপর নজর দারি চালানোর ঘটনা সামনে আসার পর থেকে|

প্রথমে অপরিচিত নম্বর থেকে কল করা হয় হোয়াটসঅ্যাপে  টার্গেট করা ব্যক্তিদের| নম্বর গুলো হয়  ইসরায়েল, সুইডেন, ব্রাজিল কিংবা ইন্দোনেশিয়ার| কল রিসিভ হোক বা না হোক  মোবাইল ফোনে ইন্সটল হয় যায় এই পেগাসাস নামক সফ্টওয়্যার, যা আসলে একটি  স্পাইওয়্যার| এর পর শুরু হয় নজরদারি ফোনের মাইক বা ক্যামেরায় যা শুনছেন এবং দেখছেন তা দেখছে অপর কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি,এবং সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য| হোয়াটসঅ্যাপের নিরাপত্তার  কিছু গলদকে লক্ষ্য করে সংস্থাটি সফল ভাবে কাজটি সেরে ফেলে| তবে ইসরায়েলের সংস্থাটি তা অস্বীকার করে  জানিয়েছে তারা কেবল সরকারি এজেন্সিকে এবং গোয়েন্দা দপ্তর গুলোকে এই সফ্টওয়্যার বিক্রি করে সন্ত্রাস বাদ দমনের উদ্দেশ্যে|
 টরান্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিটিজেন ল্যাব' এই বিষয়টি নিয়ে যৌথ ভাবে হোয়াটসঅ্যাপের সাথে তদন্ত করেছে | তারা  ইতিমধ্যে ১০০ র বেশি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে| বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ নতুন একটি আপডেট দিয়েছে ব্যবহারকারী দের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে| এও জানা যাচ্ছে ২০ টি দেশের কাছে সংস্থাটি এই স্পাইওয়্যারটি বিক্রি করেছে,যার মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে সাংবাদিক,মানবাধিকার কর্মী ,আইনজীবি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর | দেশগুলির নাম না জানা গেলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হোয়াটঅ্যাপ ব্যাবহারকারীরা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে| আক্রান্ত ব্যক্তিদের  মধ্যে  একজন রুয়ান্ডার অধিবাসী ফস্টিন রুকান্ড| তিনি বর্তমানে ব্রিটেনের লিডসে বসবাস করেন,এবং তিনি শাসক গোষ্টির সমালোচক হিসেবেই পরিচিত| গত এপ্রিল মাসে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে|তিনি অনলাইনে সার্চ করে বুঝতে পারেন নম্বরটি সুইডেনের, এর পর তিনি বিষয় টিতে বিশেষ আলোক পাত করেননি| এর পর ভিন্ন ভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে তার কাছে কল আসতে থাকে| তিনি নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান হয় পরেন এবং নতুন একটি মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করেন| তাতেও নিষ্পত্তি মেলে না কয়েক দিনের মধ্যেই আবার একই রকম কল আসতে থাকে| পাশ্চাত্যের এক সংবাদ মাধ্যমে তিনি জানান বেশ কয়েকবার সেই নম্বরে কল করার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয় না, এবং তিনি লক্ষ্য করেন তার ফোন থেকে হয় কিছু ফাইল উধাও হয় গেছে|  মে মাসে তিনি সংবাদ পত্র থেকে হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাকিং সংক্রান্ত খবর জানতে পারেন এর পর তার কাছে সবটা পরিষ্কার হয় যায়| এর পর তার কাছে কানাডার টরন্টো-র সিটিজেন ল্যাবের ফোন আসার পর তিনি নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারেন হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের যে ১৪০০ ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়েছে মি.ফস্টিন তাদেরই একজন| তিনি এ বিষয়ে সত্বর তার কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ব্যাক্তিদের অবগত করেন| তিনি সংবাদ মাধ্যমকে এও জানান তার কম্পিউটার,ফোন,ইমেল কোনোটাই নিরাপদ নয় এবং তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন|
এ ঘটনায় থেকে ভারতবর্ষের নামও বাদ পরেনি, পাশ্চ্যাতের এক সংবাদ সংস্থার প্রাক্তন কর্মী শুভ্রাংশ চৌধুরি | তাকে কয়েকদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপের তরফ থেকে জানানো হয় তার ফোনে ওই সফ্টওয়্যারটি ইনস্টল করা হয়েছিল, এবং তার কার্যকলাপের ওপর চলছিল নজরদারি । যদিও তিনি জানান তার কাছে গোপনীয় বিশেষ কিছু ছিলনা তবুও বিষয়টি যথেষ্ট দুশ্চিন্তার| সাইবার বিশেষঙ্গ প্রশান্ত রায় জানান বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক, সম্পাদক, আইনজীবিরা মূলত এই সংস্থার ফাঁদে পড়েছে,এবং মনে করা হচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রিয় এজেন্সি গুলো এর মাধ্যমে নজরদারি করছে এনাদের উপর। হ্যোয়াটসঅ্যাপে হ্যাকিং এর বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ অন্তর্বর্তী কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী রীতিমতো আঙ্গুল তোলেন কেন্দ্রে থাকা বিজেপি সরকারের দিকে| শনিবার এক সর্ব ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে সনিয়া গান্ধী বলেন কেন্দ্রীয় সরকারের এমন ভাবে সফ্টওয়্যারের সাহায্যে বিভিন্ন ব্যক্তির অগোচরে তার ব্যক্তিগত তথ্যের উপর নজরদারি বেআইনি এবং অসংবিধানিক| অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন এ কাজ অনুচিত এবং এর ফলে সরকারি কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে,এছাড়াও নাম না করে তিনি আরও দুটি রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন যারা এ ঘটনায় জড়িত বলে তিনি মনে করেন এর একটি বিজেপি শাসিত। মমতা ব্যানার্জি সরাসরি প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেন এই বিষয়ে সত্বর একটি তদন্ত কমিটি গড়ার| অন্যদিকে কেন্দ্রে থাকা বিজেপি সরকারে তরফ থেকে এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, এবং  বিরোধী দের ডাকা তোপের জবাবে এ বিষয়ে সমস্ত দায় অস্বীকার করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে সরকার |


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours