পারমিতা দাস, লেখিকা, কলকাতা: 


ঈশান নন্দকিশোর অবস্থিকে মনে পড়ে? কল্পনাপ্রবণ শিশুটি নিজের কল্পনার জগতেই মগ্ন থাকত। আর নিজের মনে ছবি আঁকত। সে সব অসাধারণ ছবি। কিন্তু পড়াশোনায় মন না দেওয়ার জন্য স্কুলে, বাড়িতে সর্বত্র বকা খেত, শাস্তি পেত। শেষে তাকে ‘মানুষ’ করার জন্য তার বাবা-মা তাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আরও কড়া শাসনে থেকে ছেলেটি ছবি আঁকাই বন্ধ করে দিল। শেষে তার বিশেষ অসুবিধা (ডিসলেক্সিয়া)র কথা বুঝতে পেরে তার এক টিচার তাকে আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। আমরা অনেকেই ‘তারে জমিন পর’ সিনেমাটি দেখেছি, প্রশংসাও হয়ত করেছি, কিন্তু সেটি আমাদের কাছে নিছকই এক সিনেমা হয়ে রয়ে গেছে। বাস্তবে এখনও বাড়ির শিশুটি সন্ধেবেলা পড়তে বসতে না চাইলে, বা স্কুলের পরীক্ষায় অভিভাবকদের আশানুরূপ ফল করতে না পারলে তাদের কপালেও ঈশানের মতই শাস্তি জোটে। জানি আপনারা অনেকেই হয়ত বলবেন আপনার বাচ্চা সিনেমার ঈশানের মত স্পেশাল চাইল্ড নয়, নরমাল চাইল্ড। হলই বা সে স্বাভাবিক বাচ্চা, তবু কি তার নিজস্ব কল্পনার জগতে নিজের মত করে বেড়ে ওঠার অধিকার নেই? পাশের বাড়ির ছেলেটি ডাক্তারি পড়ে, ওই বাড়ির মেয়েটি আই আই টিতে পড়ে অতএব আমার শিশুটিকেও হতেই হবে ওদের মত। ঘরে ঘরে চলে তারই প্রস্তুতি। বাচ্চার শৈশব দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে, শিশু থেকেই তাকে ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার বা আই এ এস অফিসার বানানোর সাধনায় শুরু হয়ে যায় বাবা মায়েদের ইঁদুর দৌড়। ইন্ধন যোগায় স্কুলগুলো। শিশুদের বিদ্যাদিগগজ করে তুলতে গিয়ে রোজ রোজই বেড়ে চলে তাদের স্কুল ব্যাগের ওজন। তার ওপর আছে এক্সট্রাকারিকুলারের চাপ। ড্রয়িং ক্লাস, নাচের স্কুল, গানের টিচার, ক্যারেটে বা ক্রিকেট ক্লাব, সুইমিং ক্লাস ইত্যাদি প্রভৃতি। শিশুরা শৈশব হারিয়ে যান্ত্রিক এক পরিবেশে বেড়ে উঠতে বাধ্য হয়।

এর ঠিক উল্টোপিঠেই কিন্তু আছে আর এক ছবি। সেখানের শিশুরাও শৈশব হারিয়েছে। তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু মিড ডে মিল খেতে পাবে বলে বা কন্যাশ্রীর টাকা, সাইকেল, জুতো পাবে বলে স্কুলে নাম লেখানো আছে। কেউ হয়ত শহরের ফুটপাতে থাকে, দুবেলা ঠিকমত খারাব পায় না। কেউ স্টেশনে স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়, ট্রেনে ঝাড়ু দেয়, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে, ছোটখাট চুরিচামারি করে, কাগজ কুড়োয়, বাড়ি বাড়ি বা চায়ের দোকানে কাজ করে। নোংরা পরিবেশে, প্রাথমিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে এরা নেশা করতে শেখে। অনেক সময় এরা অপরাধপ্রবণও হয়ে ওঠে।
ভারতে ১৯৫৬ সাল থেকে ১৪ই নভেম্বর শিশুদিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। শিশুদিবস পালন করার উদ্দেশ্য শিশুদের অধিকার, যত্ন ও শিক্ষা সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। আজও স্কুলে স্কুলে অনুষ্ঠান হবে, পাড়ায় পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে দুঃস্থ শিশুদের খাবার দেওয়া হবে বা জামাকাপড় দেওয়া হবে, সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়বে শুভেচ্ছা বার্তায়, পত্র পত্রিকায় লেখা হবে শিশুদিবসের তাৎপর্য। তারপর?
তথ্য বলছে ২০০১সালে শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়েছিল ১০হাজারের কিছু বেশি, ২০১৬সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১লাখেরও বেশি এবং সংখ্যাটি ক্রমবর্ধমান। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া শিশু অপরাধীর সংখ্যা ৮লাখেরও বেশি, অপরাধের মধ্যে চুরি ডাকাতি থেকে শুরু করে নেশা করা এমনকি খুনও আছে। ২০১১সালের সেনসাস বলছে ভারতে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১কোটি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের তথ্য বলছে প্রতিদিন বিশ্বে ১লাখ স্কোয়ার কিলোমিটারেরও বেশি জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে। ভারতেও পরিস্থিতি একটুও অন্যরকম নয়। পৃথিবীতে গড়ে ২০০ থেকে ২০০০ প্রজাতির প্রাণী লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। নষ্ট হচ্ছে ইকোলজিকাল ব্যালেন্স। সমুদ্রের জলতল প্রতিবছর সাড়ে তিন মিলিমিটার বাড়ছে। প্রতিবছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। পৃথিবী একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু ২০১৯সালে ৭০হাজার শরণার্থী শিশুকে আটক করেছে আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিওরিটি। আজকের পত্রিকাতেও ইজরায়েলি  হানায় মৃত প্যালেস্টাইনের বালকের রক্তাক্ত ছবি।
আমরা এ কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি আমাদের শিশুদের জন্য! এই প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিতে নিজের আদরের শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে শিশু দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে কি বারেবারে কেঁপে উঠছে না হৃদয়!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours