সীমন্তী দাস, লেখিকা, দুর্গাপুর:

খুব সাধারণ পোশাকের একজন সৌমদর্শন মানুষ যখন ফাইল বোঝাই টেবিলের কোণ থেকে দুহাত জোড় করে নমস্কার করেন তখন সন্ধিনী চোখ তার কোম্পানির নাম আর বিল আটকে আছে শোনার অপেক্ষায় এপারের আমি।
পিছন থেকে ভেসে আসে পরিচিত গলা,ম‍্যাডাম ইনি সেই ডাক্তার বাবু যিনি কাল আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন।ওহ,আসুন আসুন।
আপনি ফিরে যাননি।না,আসলে আপনার সাথে দেখা না করে যেতে মন চাইলোনা।
আমার সাথে?হ‍্যা,আপনার জন্যই তো এতো জন কুষ্ঠ রোগীর সেবা করার সুযোগ পেলাম।অবাক বিস্ময়ে তাকালাম।
আস্তে আস্তে জানলাম মানুষটি একজন রিটায়ার্ড আর্মি ডাক্তার।কুষ্ঠ রোগীদের ক্ষত ড্রেসিং করে বেড়ান সারা ঝাড়খণ্ডের প্রত‍্যন্ত গ্রামে প্রায় কুড়িটা স্পষ্টে।কলকাতার ধাপার মাঠের পাশে,আরো তিনটি জায়গায় আছে কলকাতা শহরে।উনি দুর্গাপুরের কুষ্ঠকলোনির নাম শুনেছিলেন কিন্ত ঠিক পৌঁছনোর রাস্তা পাচ্ছিলেননা,যাক নানা পথ ঘুরে উনি আমার মাধ্যমে সেখানে যেতে পেরে নাকি কৃতজ্ঞ।আর ঐ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন‍্য কাল উনি থেকে গেছেন এই শহরে।আর আমাদের নবদিগন্তের রোগীরাই বলেছেন সিটিসেন্টারের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে কয়েকজন রোগী আছেন তাদের উনি একবার দেখবেন।নিজে হাতে ড্রেসিং করবেন।
ওনার রোগীরা জানেননা উনি ডাক্তার।কেন?আরে গ্রামের মানুষ নাকি ডাক্তার দের বিশ্বাস করেননা এবং ভীষন ভয় পায়।উনি নিজের পেনশনের টাকায় ও সঞ্চয়ের থেকে গজ,ব‍্যান্ডেজ ,ওষুধ কেনেন।একজন কম্পাউন্ডার গোছের ছেলেকে রেখেছেন মাইনে দিয়ে। ওনার চেম্বার নেই।দুটো বড় ব‍্যাগে ওষুধ পত্র।অন‍্যটিতে জামাকাপড়, চাদর।সময়ে অসময়ে রাস্তাঘাটে গাছের তলায় কাটাতে চাদর বেশ কার্যকরী ।
অনেক দেরিতে এই কাজে নেমেছেন, তাই ভীষন আফসোস।অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি নিয়ে প্রান্তিক মানুষের লড়াই উনি বলে চলেন অবলীলায়।আমি যেন দেবদর্শন করি।
আপনি শাড়ি জামা পুরানো যা কিছু একটু শক্ত গোছের জিনিস রাখবেন আমি নিয়ে যাবো।হঠাৎ কিছু ল‍্যামিনেট করা ছবি দেখালেন।চোখ তাকিয়ে গোটা শরীর শিউরে উঠলো।মানুষটি বলছেন কুষ্ঠরোগীদের সেন্স থাকেনা ক্ষত স্থানে,এই ছবিটি দেখুন,ইদুরে এর পাটা খেয়ে ফেলেছে।হাড় পর্যন্ত।চোখ বন্ধ করে ফেলেছি।উনি গর্ব করে বলছেন ওর এখন ক্ষত স্থান গোলাপি চামড়ায় ঢাকা।
এহেন মানুষটির সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেলাম বলে ওনার চোখের কোলে জল।এমন সম্মান নাকি উনি পাননা।ওনাকে পাশে বসাতে কুন্ঠিত বোধ করেন আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজ।যত শুনছিলাম লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।
ফেসবুক, হোয়াটস আপ উনি জানেননা।তবে সভ‍্য সমাজের ছোঁয়ায় থাকতে গেলে এসব জানতে হবে সদ‍্য বুঝেছেন।তাই ফোরজি একটি ফোন বাড়িতে আছে।তাতে ঐ দুটি জিনিস আছে।বাড়ি ফিরে অবসরে ঐ ফোন দেখেন।কলকাতাতে বাড়ি থাকলেও গোমোতে থাকতেই ভালো বাসেন।একমাত্র মেয়ে সুদূর আন্দামানে থাকেন বললেন।
এখন ওষুধের দাম চড়চড় করে বাড়ছে তাই আর্থিক দিক নিয়ে একটু অসুবিধা হচ্ছে।
তাই সভ‍্য জগতের কাছে সাহায্য পেতে গেলে ফেসবুক করতে হবে বুঝেছেন।তবে তার কদর্যতা নিয়ে ওয়াকিবহাল নন।ছবি তুলবো বলতেই শিশুদের মত পরিপাটি হয়ে বসে বেশ পোজ দিলেন।
মানুষটির নাম ডাক্তার তপন কুমার দেউরি।নিবাস গোমো।পেশা কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা।
আমি সমাজসেবক নই।আমার খুব ভালো লাগে এই কাজ করতে তাই করি।ঐ আঙুলহীন হাত যখন আশির্বাদ হয়ে মাথায় ঠেকে ওটাই আমার পরম পাওয়া।
এই অবক্ষয়ের যুগে এমন ডাক্তারের দেখা পাওয়া যেন কয়লা থেকে হীরের সন্ধান।
স্বশ্রদ্ধ প্রনাম আপনাকে শ্রী তপন কুমার দেউরী।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours