মুজতবা আল মামুন, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: 

মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে মোদী সরকারের প্রতি।  ক্রুদ্ধ,  মনে মনে ফুঁসছে। ঠিক এমন একটা সময়ে দিল্লি পুলিশ ইন্ডিয়া গেটের অদূরে রীতিমত বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেন । যাতে শুধু সারা দেশ নয়,  বিদেশেও তোলপাড় পড়ে গেছে। ওখানেই দিল্লি পুলিশের সদর দপ্তর।  সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরও। পুলিশের পোশাক পরেও অংশ নিলেন অনেকে। শ্লোগান দিলেন প্ল্যাকার্ড হাতে ।  তাদের নিরাপত্তা চেয়ে। উর্ধতন পুলিশকর্তাদের বারংবার অনুরোধেও তারা বিক্ষোভ থেকে সরে যান নি।  সে সময় দিল্লিতেই ছিলেন দিল্লি পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা অমিত শাহ। পুলিশদের ক্রোধে ফেটে পড়া দেখে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন। বিরোধীরা বলছে,  এটা মোদী সরকারের প্রতি খোদ আইনরক্ষকদের বিদ্রোহ। এর গুরুত্ব অসীম। সার্বিক বিদ্রোহের সূচনা হলো । একই সঙ্গে মোদী সরকার যে ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ছে,  তা স্পষ্ট হলো। এবার নানাক্ষেত্রের মানুষ পথে নামবে।

অমিত শাহ দাবি করেন,  তাঁর বুকের ছাতি ৭৬ ইঞ্চি।
সেই ৭৬ ইঞ্চি পাটাওয়ালা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় গেলেন ? খাস রাজধানীতে নজিরবিহীন পুলিশ বিক্ষোভ নিয়ে যখন গোটা দেশ তোলপাড়, তখন  তিনি লুকিয়ে পড়লেন কেন?  কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদের পর থেকেই বিজেপির ঘরোয়া মহলে বল্লভভাই পটেলের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছিল অমিত শাহকে। সেই তাঁর নাকের ডগায় গত মঙ্গলবার ( ৫ নভেম্বর ) যে ভাবে দিল্লি পুলিশের বিদ্রোহের আভাস পাওয়া গেল, তা থামাতে তিনি কেন ব্যর্থ হলেন ?

নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আমলে সিবিআই কর্তাদের মধ্যে লড়াই দেখেছে দেশবাসী। সাক্ষি থেকেছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে সংঘাতেরও। এ বার দিল্লি পুলিশের পদস্থ কর্তা বনাম নিচুতলার কর্মীদের প্রকাশ্য বিক্ষোভে কার্যত অচলাবস্থা তৈরি হল গোটা দিল্লি জুড়ে। দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক বাহিনীর শীর্ষে থাকলেও, দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় বাহিনীর রাজনৈতিক প্রধান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দিল্লি পুলিশ তাদের কর্তব্য ভুলে ১৩ ঘণ্টা যে ভাবে তাদের মুখ্যালয়ে বিক্ষোভ দেখাল, স্বাধীন ভারতের ৭২ বছরের ইতিহাসে তা এক কথায় নজিরবিহীন। এটা কি ক্রমাগত নানা অবিচার ও জনবিরোধী নীতির অবশ্যম্ভাবী ফল ? তাদের দলদাসের পরিণত করার বহিঃপ্রকাশ ?  বিরোধীরা কিন্তু তাই-ই বলছে।

কার্যত গত মঙ্গলবার ‘সিপাহি বিদ্রোহ’-এর সাক্ষী থাকল দেশের রাজধানী। যে পুলিশের কাজ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া, আজ তাঁরাই নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে পথে নামলেন। এটা সাধারণ মানুষকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। বর্তমান সরকার সর্বদিক ও বিভাগ সামলাতে যে ব্যর্থ , এই ঘটনা তার প্রমাণ।
কাশ্মীরীদের বিক্ষোভকে সেনা দিয়ে দমন করা যায়।  এখানে তো তা করতে পারে না। উচিত ও নয়। বিরোধীরা অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করে বলেছেন,  ওঁরা তো প্রাইভেট আর্মির কমান্ডার।

এই অভূতপূর্ব সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা আইনজীবীদের হাতে পুলিশের মার খাওয়াকে কেন্দ্র করে। পরপর দুদিন পুলিশ মার খেল। এ ছারা তার প্রতিবাদে পুলিশবাহিনী রুখে দাঁড়ালো। মঙ্গলবার সকালে একশোর মত পুলিশকর্মী দিল্লি পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে নরব বিক্ষোভ শুরু করেন। তারপর যত সময় গড়িয়েছে,  পুলিশকর্মীদের উপস্থিতি বেড়েছে। এক সময় তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। অনেকে ডিউটিতেই যান নি।  অনেকে ডিউটিতে গিয়েও, কাজে যোগ না দিয়ে, বিক্ষোভকেন্দ্রে চলে আসেন। কার্যত সারাদিন দিল্লি ছিল নিরাপত্তাহীন। যেখানে নেতা-মন্ত্রীদের আনাগোনা, বিদেশি দূতদের চলাফেরা, বিদেশি ভিআইপিদের উপস্থিতি,  দেশের সেই রাজধানী এমন নিরাপত্তাহীন,  এটা কখনও ঘটে নি। মোদী জামানায় তাও দেখলো দেশবাসী!

সূত্রপাত গত শনিবার,  তিসহাজারি আদালত চত্বরে আইনজীবীদের গাড়ি পার্ক করা নিয়ে। তা হাতাহাতিতে গড়ায়। গুলিও চলে। মূলত মার খান পুলিশকর্মীরা। অভিযোগ, ওই গোলমালে বিজেপি সমর্থিত আইনজীবীরা নেতৃত্ব দেন। মঙ্গলবার সকালের দিকে সাকেত আদালতের সামনেও গাড়ি পার্ক করা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের হাতাহাতি হয়। এখানেও  পুলিশকর্মীদের মার খেতে হয়। পুলিশের উচ্চ কর্তৃপক্ষ সব জেনেও নীরব থাকেন। শুধু তাই নয়,  আইনজীবীদের রেহাই দিয়ে, পুলিশকর্মীদের শাস্তি দেওয়া হয়। এতেই পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ আগুনে পরিণত হয়। তার ফলে এই নজিরহীন বিদ্রোহ। তারা সন্ধের পর মোমবাতি মিছিলও করেন।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে,  পুলিশকর্তারা বিষয়টা খতিয়ে দেখে অমিত শাহ উচ্চতম পুলিশকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সেই মত ব্যবস্থা নেওয়া হবে প্রতিশ্রুতি দিলে,  ঘরে ফেরেন পুলিশকর্মীরা। তবে এও জানিয়েছেন তারা,  সঠিক ব্যবস্থা না নিলে তারা আবার কাজ ছেড়ে পথে নামবেন।

বিষয়টা মারাত্মক জায়গায় চলে যায়,  যখন কর্ণাটক,  কেরালা, হরিয়ানা,  পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্যের পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন  নৈতিক সমর্থন দিয়ে দিল্লি পুলিশের পাশে দাঁড়ায়। আইপিএস এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশদের একাধিক সংগঠনও পক্ষ নেয়।

এই সময় দিল্লি পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লিতেই ছিলেন। কিন্তু তাঁকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষ করতে বা প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায় নি। এই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে পুলিশের শীর্ষ নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস এবং আপ নেতৃত্ব এই বিদ্রোহকে কেন্দ্রের প্রতি দেশের পুলিশ বাহিনীর অনাস্থার প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছে। এটাযে কোনও সরকারের পক্ষে লজ্জার।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন,  স্বাধীনতার বাহাত্তর বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এটা। দিল্লি পুলিশকে প্রতিবাদে পথে নামতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও টিকি দেখা গেল না। কংগ্রেস মুখপাত্র বলেছেন,  অন্য কোনও রাজ্য হলে,  সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি বলে চিৎকার শুরু হত। এখন অমিত শাহ চুপ কেন ?  কেনইবা সারাদিন তার দেখা মিললো না?

সোস্যাল মিডিয়ায় মোদী-অমিতকে প্রশ্ন ও সমালোচনায় জর্জরিত করা চলছে। অনেকেই বলেছেন,  ভয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরোন নি। বেরোলে অপমানিত হতে হত। সোস্যাল মিডিয়া এও বলছে,  সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক চালাতে গেলে নিয়ম মানতে হয়। ওরা গুজরাটে গায়ের জোরে আর কৌশল করে  সরকার চালাতো। তাই দেশটাকে গুজরাট ভেবে চলছে। এখন সেই নিয়মই গলার ফাঁস হয়ে উঠছে। ভয় পাচ্ছে সে কারণেই। পেশিশক্তি আর কৌশলে বেশিদিন  চলে,  এটা ওরা বোঝে। সোস্যাল মিডিয়া আরও বলছে, মুখ বুজে সহ্য করতে করতে মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। দিল্লি পুলিশের এই বিদ্রোহ সেই ক্ষোভে অক্সিজেন যোগালো। এবার বিভিন্ন পেশার মানুষ অনুপ্রাণীত হয়ে পথে নামার রসদ পেল। এও বলা হচ্ছে,  পতনের এই হল শুরু। মানুষ একটা কুটো খুঁজছিল,  দিল্লি পুলিশ তা যুগিয়ে দিল। এখন দেখার,  বিরোধীরা এটাকে কতটা ব্যবহার করতে পারছে !  আর তলিয়ে যেতে থাকা বিভিন্ন সেক্টর কতটা সাহস দেখাতে পারে!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours