দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

"রবীন্দ্র তপোবনে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে অনুভব করে গেলাম কবি একাধারে ভবিষ্যত দ্রষ্টার উপস্থিতি  তাঁর বিশ্ব সৌহার্দ্য, শান্তি এবং সম্প্রীতির বিমূর্ত চেতনায়। আমি বিমুগ্ধ দেখে গুরুদেবের স্বপ্ন  সংস্কৃতিতে , নান্দনিক এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তুলনারহিত পবিত্র মুক্ত অঙ্গন এই আশ্রমে।  আমি আনন্দিত গুরুদেবের আশ্রম পরিদর্শন করে" --  রবীন্দ্র ভবনের ভিজিটরস বুকে  কলমের আঁচড়ে এই কথা গুলো লিখেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। সমাবর্তনে তাঁর ভাষণের  সার কথা এভাবেই আরেকবার  প্রকাশ করে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক। এদিন তাঁর বক্তব্যে আগা গোড়া ছিল  আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বিশ্বভারতী ও তার প্রভাব ভারতের হৃদস্পন্দনে। তবে এসবের বাইরেও,  সমাবর্তনের বিশেষ কিছু দিক, যা বিগত দিন থেকে আলাদা ঠেকেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অধ্যাপক, কর্মী থেকে আশ্রমিকদের কাছে! অনেকের কাছে মনে হয়েছে মূল সুর ঠিক থাকলেও, তাল কেটেছে, বেশ কিছু জায়গায়!  আর শুরু থেকেই যেটা বার বার চোখে লেগেছে অনেকের! 
রবিবার ই শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছেছেন বিশ্বভারতী পরিদর্শক তথা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং রাজ্যপাল তথা বিশ্বভারতী প্রধান জগদীপ ধনখড়। সোমবার সকালে পুরনো মেলার মাঠে প্রাত ভ্রমনে বের হন রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল। উপাসনা গৃহের সামনে পুরনো মেলার মাঠে প্রাত ভ্রমন সাড়েন দুজনেই। সাত সকালে এই দৃশ্য দেখে হুলুস স্থুলুস শুরু হযে যায়। পরে বেলা সাড়ে ১০ টা নাগাদ বিশ্বভারতী ঐতিহ্য মেনে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল প্রথমে পৌঁছন উত্তরায়ণের উদয়ন গৃহে। সেখানে কবি কক্ষে মাল্যদান করে তারা চলে আসনে আশ্রম প্রাঙ্গনে। সেখানে গুরুদেবের আঁকা ছবির রেপ্লিকা তুলে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির হাতে।  তার আগে, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় রবীন্দ্র ভবনের পাশে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়ুয়াদের সাথে নিজস্বী তুলে নিজের আনন্দ ব্যক্ত করে বলেন, " আই এ্যাম অন দ্যা টপ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড"।   বিশ্বভারতী কর্ম সমিতির সদস্য ও একাডেমী কাউন্সিলর সদস্য এবং ভবন অধ্যক্ষ দের সঙ্গে শোভাযাত্রা করে পৌঁছান আম্রকুঞ্জের জহরবেদীতে। তবে তখনও অনুষ্ঠান স্থলের অতিথি আসনে সিংহ ভাগ ফাঁকা। আসেন নি অনেক কর্মীরাও। কারন হিসাবে কর্মী মন্ডলীর সভাপতি গগন সরকার বলেন, "আমরা যাব কেন? আন্দোলন করলে যে উপাচার্য শোকজ করে তার ডাকে কাজ করতে যাবে কেন সবাই।" আরেকজন কর্মী জানান, যেখানে ৮২ জন শোকজের নোটিশ পেয়েছেন, সেখানে যাওয়া যায় কি করে? 
তবে এটাও জানাগেল অনেক প্রাক্তনী, বরিষ্ঠ অধ্যাপকরাও আমন্ত্রন পেয়েছেন ঠিকই তবে শেষ মুহূর্তে পেয়েছেন বলে আসেন নি। ফলে যেখানে গত বছরই আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী উপস্থিততে ভিড় উপচে পড়েছিল সেখানে কার্যত ফাঁকা মাঠে হল সমাবর্তন। 
জহরবেদীতে এতদিন সমাবর্তনে চেয়ারে অতিথি দের বসার কোন ব্যবস্থা হত না। বেদীর উপরে এক সারিতে  বসতেন সবাই।  কিন্ত এবার পৃথক তিনটি চেয়ারে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় এবং উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বসলেন। রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের পিছনে চেযার নিয়ে বসে থাকলেন সিকিউরিটি লোকজন। যা এযাবৎ কোন দিন হয় নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আশ্রমিকরা। 
উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সমাবর্তনে সূচনা কথা ঘোষণা সময় থেকেই কার্যত শুরু করে অনুষ্ঠানের তাল কাটে। অর্থাৎ মাইক বিভ্রাট। তা সামাল দিতে মাইক ম্যান এলেও শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারে নি তিনি। পোডিয়াম পাল্টাতে হয়।  উপাচার্য স্বাগত ভাষন দেওয়ার সময়ে শেষমেষ অপর পাশে থাকা রাষ্ট্রপতি জন্য নির্দিষ্ট পোডিয়ামের মাইক থেকে কথা বলতে হয়। 
সব চেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত সমাবর্তনের সংকল্প বচন এতদিন মূলত সংস্কৃতে উচ্চারিত হত। কিন্তু উপাচার্য ঘোষনা করলেন, "সময়ের অভাব তাই বাংলায় পড়ে দিচ্ছি।" 
সমাবর্তন কি দায়সারা? তাই হল না প্রবীন ও নবীন অতিথি বরণ। দীপ সমর্পণ। মন্ত্র উচ্চারণ। হল না রবীন্দ্র রচনা থেকে পাঠ। রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিষ্ঠান কে যে বিশ্ব বিদ্যা তীর্থ প্রাঙ্গনে পরিনত করেছিলেন তার যে মূল ধ্যেয় গীত - "বিশ্ব বিদ্যা তীর্থ প্রাঙ্গন কর, মহোজ্জ্বল আজ হে" সেই গান টি ই বাদ দিয়ে দেওয়া হযেছে। শান্তি বচন এবং আরও একটি বিশেষ গান - "মোরা সত্যের পরে মন, আজি করিব সমর্পণ" এই গান টি ও বাদ দেওয়া হল। এই বিষয়ে সঙ্গীত ভবনের এক শিক্ষক জানান, "আমরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে এই গান, মন্ত্র সবই অভ্যাস করিয়েছিলাম। শেষ মুহুর্তে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে সময় নেই বলে বাদ দেওয়া হল। "
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র পরিবারের সদস্য প্রবীন আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর তিনি ও এই দায়সারা সমাবর্তন নিয়ে বলেন," এমন তো আগে কোন দিন হোত না। হওয়ার কথা ও নয়। দেখলাম সংক্ষেপে সব সারা হচ্ছে। এমন তো হওয়া উচিত নয়। "
প্রতিবেদন পাঠ থাকে, সভাপতি দীক্ষান্ত ভাষন থাকে। এবার সে সব কিছুই হল না। আগে সব ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী নিজে নিদর্শন পত্র দিতেন। সে সব তো কবেই উঠে গেছে। নিরাপত্তার কারনে এতদিন ভবন অধ্যক্ষরা ছাত্র ছাত্রীদের হয়ে নিদর্শন পত্র এবং সপ্তপর্নী নিতেন। এবার উপাচার্য সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের হয়ে নিদর্শন স্বরূপ প্রতিকী সপ্তপর্নী নিলেন। কিন্ত ৪৭২৫ জন ছাত্রছাত্রী সবাই এলেন ও না সমাবর্তনে। তাদের কথায়, "আমরা তো সার্টিফিকেট বা ছাতিম পাতা অতিথি দের হাত থেকে পাব না। উল্টে সকাল থেকে রোদে গরমে দূরে ঘেরা জায়গায় গিয়ে নিরাপত্তার ঝামেলার মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগেনি। তাই যায় নি।" 
জানা গিয়েছে, বিশ্বভারতী পড়ুয়া যারা হোস্টেলে থেকে পডাশুনা করে তাদের সবাই কেও এই ঘরের অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। কারন হিসাবে বিশ্বভারতীর যুক্তি বেশি ভিড় হলে সামলানো অসুবিধা। তাই প্রতি বিভাগ থেকে মাত্র চার জন করে ছাত্র ছাত্রীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে বলা হয়। বিশ্বভারতী হোস্টেলে তারা কার্যত গৃহবন্দী ছিলেন। কারন রাষ্ট্রপতি আশ্রম ক্যাম্পাস ঘুরে দেখবেন তাই। ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগ, আমাদের অনুষ্ঠান অথচ আমরা যেতে পারছি না। এটা কেমন বিচার হল" এটা তাদের যুক্তি। 
এদিন  রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষনে বুলবুলে মৃত পরিজনদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে তাঁর  মূল বক্তব্য রাখেন।  বিশ্ব ভারতীর শতবর্ষ ও মহাত্মা গান্ধীর সার্ধোশতবর্ষ উপলক্ষে পঞ্চাশতম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে  ভাষণের বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে ছিল  রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী। পরিদর্শক তাঁর বক্তব্যে বলেন," আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন এই বিশ্ব-ভারতী। তিনি এই জায়গাটিকে ধারণার আঁতুরঘর হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। ভারতীয় ঐতিহ্যকে বজায় রেখেই সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণাকে এই স্থান স্বাগত জানিয়েছিল। বিশ্ব-ভারতীর অনন্যতা আমাদের কাছে পুরস্কার-স্বরূপ এবং সারা বিশ্বের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য আমরা গর্বিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জায়গায় তাঁর ভাবনাকে রূপ দেয়ার জন্য কাজ করে গেছেন। বিশ্ব-ভারতীর প্রাক্তনীরা বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, সত্যজিৎ রায় থেকে অমর্ত্য সেন এরা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্নকেই শুধু বাস্তবায়িত করেননি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতে এরা নিজেদের অবদান রেখেছেন।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, "বিশ্ব-ভারতী যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন তথাকথিত পুঁথিগত শিক্ষাদানের মরুভূমিতে, যেখানে শিক্ষার্থীদের যন্ত্রমানব তৈরি করা হ’ত, তার মধ্যে এই জায়গাটি ছিল একটি মরুদ্যান-স্বরূপ। এই মরুদ্যানে রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্তরাত্মার চাহিদাকে পূরণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি অনুভব করেছিলেন, দর্শন, সাহিত্য বা ইতিহাসের মতো বিষয় ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেই চলবে না, সঙ্গীত, অঙ্কন ও চারুকলার মধ্য দিয়ে  তাদের অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে তুলতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী এখানে কৃষিবিদ্যা পড়ানোরও ব্যবস্থা ছিল। আর তাই শান্তির এই নিকেতন, শান্তিনিকেতনের পাশাপাশি, তিনি গ্রামীণ এলাকার পুনর্গঠন ও গ্রামোন্নয়নের জন্য শ্রীনিকেতনেও একটি কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন, যার মাধ্যমে সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে।  উপাচার্য ও পরিদর্শকের ভাষণের পর, হলুদ উত্তরীয় গলায় পড়ুয়ারা করতালিতে ফেটে পড়েছিলেন। এর মাঝে একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের " রক্ত করবী" নভেল হিসেবে উদিত হওয়ায়। 
এদিন প্রথাগত দীক্ষান্ত ভাষন হয় নি। গত বছর সমাবর্তনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে আত্মপ্রিয়া নন্দ মহারাজ দীক্ষান্ত ভাষন দেন। এবার প্রথা ভেঙে সেই ভাষণ দেন বিশ্ব ভারতীর পরিদর্শক। তবে তাঁর সমাপনী ছিল সুন্দর ভাবে রবীন্দ্র নাথের কবিতায়--
"তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন--
সকল ক্ষীণতা মম করহ ছেদন
দৃঢ়বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর।"





Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours