কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

তপস্যা দেখেছিলেন? অথবা আঁচল।

প্রথমটা ১৯৭৬ এর রিলিজড। দ্বিতীয়টা ১৯৮০ সালের।

১৯৮১ এর শ্রদ্ধাঞ্জলি হলেও চলবে।

তবেই কিছুটা আঁচ পাবেন, রাখী ঠিক কোন গোত্রের অভিনেত্রী।

অবশ্য অনেক দিন হয়ে গেল। তবে বর্তমানকে চিনতে গেলে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হয়। যে সিনেমাগুলির জিগির করলাম, এপ্রজন্মের অনেকেই নাও দেখে থাকতে পারেন। আরেকটু পরের দিকের কথা বলি। অপর্না সেনের পরমা(১৯৮৫)। দেখেছিলেন? আর লেটেস্ট বলতে তাও ষোল বছরের পুরনো, ঋতুপর্ণ ঘোষের শুভ মহরত(২০০৩)।

এটাও যদি না দেখে থাকেন তাহলে আপনি নিশ্চিত জানুন, রাখীকে দেখা আপনার অসম্পূর্ণই নয়, আপনি রাখীকে আদৌ দেখেননি। তা সে আপনি যতই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চোখের সামনে রাখীকে দেখুন না কেন।

বাদামি চোখের তারা। মুখের দিকে তাকালে ওই চোখজোড়াই চোখ টেনে নিতো। অনেকে বলতো খারাপ। আবার আমার মতো যারা ছিলো, তাদের কাছে ওটাই অ্যাট্রাকসন। কোনও মাপজোক করা মারকাটারি ফিগার না মোটেই। বরং আর দশটা মেয়ের মতোই। প্রথম দিকে চেহারা হাল্কাই ছিল। রোগা পাতলা। ভরাযৌবনে এক বঙ্গতনয়ার মেয়ের যতটা সুন্দর থাকার কথা ঠিক ততটাই সুন্দরী। তারচেয়ে এক চুল কম না বেশিও না। তবে কোথায় যেন তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা। ঠিক চলতি হাওয়ার পন্থী না। তাই সেদিন অনেকেই রাখীর নামে পাগল হতেন। ঠিক যেরকম হলাম বাহাত্তরের রাখীকে দেখেই।

পাগল হয়েছিলেন মুম্বইয়ের আরেকজনও। পঞ্জাবসন্তান হলেও কী হবে, বাংলার সংস্কৃতীপ্রেমী। গুলজার সাহেব। হাবুডুবু খেয়েছিলেন বঙ্গতনয়ার প্রেমে। সেদিন ছেচল্লিশ বছর আগে, "বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার, সে রাখী খুলো না !" আজও সেই রাখীতেই বাঁধা পড়ে আছেন দুটিতে। রাখী গুলজার।

ওপার বাংলা থেকে ভেসে আসা রাখীর পরিবার। রাণাঘাটের সেই মেয়েই একদিন পৌঁছে গেছিলেন আরব সাগরের তীরের মায়ানগরীতে। তবে মধ্যে কিছুদিন কেটেছিলো কলকাতার টলিপাড়ায়। বরাবরের মতো তখনও রাখীকে ধরে রাখতে পারেনি টলিগঞ্জ। তবে বলিউড ফেরত রাখীকে নিয়ে আজকের কলকাতার মাতামাতি দেখার মতো।

মঞ্চে নারী স্বাধীনতা নিয়ে কোনও বড় বড় বাতেলা মারেননি রাখী। বরং যোগীর মতো নীরবে, একাগ্র চিত্তে নিজের কাজটা করে গেছেন। দেখতে নরম- তরম হলে কী হবে, আসলে প্রচন্ড জেদি এক মেয়ে। আর জীবনটাকে নাচিয়েছে একেবারেই নিজের তালে। বেঁচেছেন সেভাবেই, ঠিক যেভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। বাহাত্তরেও একটুও টাল খাননি, সাক্ষাতকারে মিষ্টি করে সেকথা শুনিয়েও দিলেন।

বড্ড স্বাধীনচেতা মেয়ে! টিনসেল টাউনের ঘনিষ্ঠজনেরা বলতেন। তা হবে নাই বা কেন? জন্মলগ্নের দোষ বা গুণ যাই বলুন না কেন। ১৯৪৭ এ জন্ম। তাও আবার পনেরোই অগাস্টে। স্বাধীনতার মেয়ে রাখী। মা- বাবার কথা শুনে, বেশ কম বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছিলেন রাখী মজুমদার। ঘরনী হলেন সাংবাদিক পরিচালক অজয় বিশ্বাসের। স্বপ্নও দেখতেন না অভিনয়ের। তবে ফিল্মি পরিবার। অগত্যা, বয়স যখন কুড়ি দেখা দিলেন রূপালী পর্দাতে। বধূবরণ। ঘুরতে শুরু করলো ভাগ্যের চাকা। অশান্তি জমতে লাগলো দাম্পত্যে। বিচ্ছেদ। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ডাক পেলেন বলিউডের। ডাকটা এসেছিলো তখনকার দাপুটে নায়ক সুনীল দত্তের রেশমা অউর সেরার জন্য। তবে তার আগেই রিলিজ হলো জীবন মৃত্যু(১৯৭০)।

সে সময়কার হিম্যান হিরো ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে জমিয়ে অভিনয় করলেন রাখী। সবার চোখ কেড়ে নিলেন নবাগতা। শশী কাপুরের সঙ্গে সাইন করলেন শর্মিলি। তাও একেবারে ভিন্নধর্মী দুই চরিত্রে। ঠিক কোন রাখীকে কাছে টেনে নেবেন? তাঁর অভিনয়ে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন শশী কপুরের। লালপত্থর, পারসের মতো পরপর কমার্শিয়াল হিট দিয়ে, সত্তরের দশকে টিনসেল টাউনে পায়ের তলার মাটিটা বেশ শক্তপোক্ত করে নিলেন রাণাঘাটের রাখী।

সাল ১৯৭৬। একেবারে এক অন্যরকম ভূমিকায় দেখা গেল রাখীকে। তপস্যা আর আঁচল। তিনি যেন একাই টেনে নিয়ে গেলেন শুরু থেকে ক্লাইম্যাক্সে। বসেরাতেও তিনি অনবদ্য। শ্রদ্ধাঞ্জলিতে দেখালেন আভিজাত্য কাকে বলে। পাশাপাশি মেন স্ট্রিম কমার্শিয়াল সিনেমাতেও মাতালেন উঠতি দর্শককে। প্রথমদিকে খানিকটা খোলামেলা পোশাকে দেখা গেলেও, তা বেশিদিন টানেননি। এড়িয়ে গেছিলেন খুব বেশি নাচানাচি, চটকদারির রাস্তা।

তবে রাখীর মতে, দিলীপ কুমারই সেরা। এবারেও কলকাতায় এক সাক্ষাতকারে বলেছেন রাখী। দু'যুগের দুই সেরা দিলীপ কুমার আর অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, শক্তিতে অভিনয় করে রাখী তাঁর জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। একেবারে নীচু পর্দার অভিনয়। কোনও ম্যানারিজম না। ষোল আনা স্বাভাবিক চলনে- বলনে, কথায়।

সুপারহিট কভি কভি, বেমিসাল, অনুসন্ধানে অমিতাভের নায়িকাকে শক্তিতে দেখা গেছিলো অমিতাভের মায়ের ভূমিকায়। আবার ঋষি কপুরের মধ্যেই মনের মানুষের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন তিনি দুসরা আদমিতে। কিন্তু ইয়ে ওয়াদা রহাতে তাঁকে দেখা গেল ঋষি কপুরের মায়ের ভূমিকায়।

শুধু নায়িকা না। দিদি, মায়ের ভূমিকাতেও রাখী সমান হিট। বলিউডে দাপিয়ে বেড়ানোর সময়েও বাংলার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তিনি। মাঝেমাঝেই তাঁকে দেখা গেছে চামেলি মেমসাহেবের মতো বাংলা সিনেমায়। তবে বাংলার সিনেরসিকরা রাখীকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে আবিষ্কার করলেন, অপর্না সেনের পরমাতে। শরীরের বাঁধভাঙা ডাকের কাছে, এক গৃহবধুর অসহায় আত্মসমর্পন। ঘটনার দ্বন্দ্ব, ঘাত- প্রতিবাদের আবেগে তিনি অনন্যা। এবার নির্বাণে দেখা দিলেন একেবারে এক অন্যরূপে। রূপের বিবিধতায় রাখীই সেরা।

তবে মনেপ্রাণে তিনি একটাই। বাঙালি। মন্দজনে বলে, "সেকথা আর বলার দরকার হয় না। রাখীর হিন্দি শুনলেই, সেটা বোঝা হয়ে যায়।" জন্মদিনে কেক বা বড় হোটেলে আসর বসানো না। বাড়িতে মায়ের হাতের পায়েস। মেয়ে মেঘনাকেও জন্মদিনের পায়েস খাইয়েই বড় করেছেন তিনি। হাজার হলেও বাঙালির আত্মজা তো। এমন মাকে নিয়ে মেয়ে গর্ব করবে নাতো কী?

কোনদিনই তেমন ভাবে কোন হীরোর সঙ্গে জুটি বাঁধতে পারেনি রাখী। তবে নিজেই জানিয়েছিলেন,  বলিউডে কাজ করে সবচেয়ে বেশি মজা পেতেন রাজেশ খান্না আর শশী কপুরের সঙ্গে। হিন্দি ফিল্মে তাঁকে শেষবারের মতো দেখা গেছিলো ষোল বছর আগে, শুভ মহরত সিনেমায়। ওই সিনেমার জন্য সেরা সহ অভিনেত্রীর ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন।

পথ চলা কি ওখানেই শেষ?

মনে হয়েছিলো। তবে তা হয়নি।

"কোনও শিল্পী অবসরে যেতে চান না।" মুম্বইয়ে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন রাখী। "ক্যামেরা, লেন্স শিল্পীদের টানে।" তবে মনের মতো রোল চাই। আর যদি মেঘনার ডাক আসে? স্নেহময়ী মায়ের মধ্যে একটুও দেরি না করে, ফের ভর করে সেই জেদি মেয়ে। "রোল পছন্দ হলে তবেই শুটিং ফ্লোরে পা রাখবো।"

মনের মতো মানুষকে বলিউডেই খুঁজে পেয়েছিলেন রাখী। গুলজার। ফের চার হাত এক হলো। সালটা ছিল ১৯৭৩। কিন্তু এবারেও সুর কেটে গেল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই পাঁচিল উঠলো দাম্পত্যে। আলাদা ঠিকানা হলো দুজনের। এরমধ্যেই মা হলেন রাখী। তবে শরীর দূরে সরলেও মনের তারটা বাঁধা থাকলো সেই পুরনো সুরেই। এমনকি আজ ছেচল্লিশ বছর পরেও।

কলাতায় বসেও রাখীর মৎস্যপ্রেম নিয়ে কথা উঠতেই বললেন, "আমার স্বামী গুলজার ইলিশ খেতে ওস্তাদ।" তবে যে কথাটি তিনি চেপে গেলেন, সে কথাটা গতবছর ফাঁস করে দিয়েছিলেন খোদ গুলজার। তাও আবার মেয়ে মেঘনার লাঞ্চ পার্টিতেই। পার্টি চলছিলো মুম্বইয়ের রয়াল অপেরা হাউসে, বাবার আত্মজীবনী নিয়ে মেঘনার 'বিকজ হি ইজ' রিলিজ উপলক্ষ্যে।

"রাখীর রান্না মাছ খেতে ইচ্ছে করলেই ঘুষ দিতে হতো," হাটে হাঁড়ি ভেঙেছিলেন গুলজার। "শাড়ি হাতে ঘর ঢুকতাম। সেদিনও যা, আজও তা। আমরা কেউ নিয়ম ভাঙিনি আজও।" রাখীর কাছেই জেনেছিলেন ঢাকাই আর তাঁতের শাড়ির সৌন্দর্য, আভিজাত্য।

তবু গুলজার, রাখী এতো দূরে দূরে কেন?

"মেঘনার জন্মের পর থেকে আজও প্রতিটা মুহূর্তে, উৎসব পার্বনে আমরা পাশাপাশি। কথা কাটাকাটি থেকে মান অভিমান, হাসাকাঁদাতেও আমরা শরিক।" পাল্টা সওয়াল করেন গুলজার, "এরপরেও যদি কেউ বলেন আমরা বিচ্ছিন্ন, তাহলে সহবাস কাকে বলে তা জানতে চাইবো।"

মন কষাকষি নেই এমন ভালবাসাও আছে নাকি মশাই? প্রশ্ন রাখীময় গুলজারের।

মুক্তির পূজারি দুজনেই। মুক্তির মাঝেই হয়ত 'মনের বন্ধন' খুঁজে পেয়েছিলেন, এই দুই কল্পলোকের বাসিন্দা। রাখী নিজের বাড়ির নাম রেখেছিলেন মুক্তাঙ্গন। পরে অবশ্য পাশের এক ফ্ল্যাটে উঠে যান। যশ খ্যাতি অর্থ, অনেক কিছুই পেয়েছেন তিনি। তবু আজও কিছু খুঁজে চলেছেন।

কী খুঁজে চলেছেন রাখী? কোন সে পরশপাথর? তা তিনি নিজেও জানেন না। তা কি সামাজের রক্ষনশীলতার থেকে মুক্তি? হতে পারে। তাই হয়ত তিনি এত বছর পরেও বিজুলিবালা হয়ে ফিরে এলেন পর্দায়। গৌতম হালদারের নির্বাণে। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা। যে চায় এক মুসলিম বাচ্চাকে পোষ্য নিতে। এই ঘটনার সঙ্গে ভয়ঙ্কর রকমের এক মিল আছে রাখীর অতীতের এক ঘটনার।

মুম্বইয়ের এক অনাথাশ্রমে তখন সময় পেলেই ছুটে যেতেন রাখী। সেখানে তাঁর মনটানে সোনালি চুলের এক বাচ্চা। তাকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু এক মহিলার ভরসায় আশ্রম কর্তৃপক্ষ, বাচ্চাটাকে রাখীর হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। সেই ঘটনার রেশ কি আজও সংগোপনে রয়ে গেছে রাখীর মনের অন্তরালে? নিজের কাছে নিজের ফিরে যাওয়ার চেষ্টাতেই  নির্বাণের বিজুলিবালা !

নাকি আত্মানুসন্ধান? নিজেকেই নিজে খুঁজে চলেছেন দিনে, রাতের অন্ধকারে। গাছের শেকড়ে, বৃষ্টিভেজা পাতার ডগায়।

হয়ত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না খোদ রাখীও ! তাই তাঁর খোঁজার কোনও শেষ নেই। অন্তহীন খোঁজে একাকী এক নারী।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours