কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ইন্টারনেটের চোখ মিটমিট। মোবাইল স্ক্রিনে চাকা গোলগোল ঘুরেই চলেছে। এদিকে নাছোড়বান্দা মিসেস বোস। ইলিশ-ভাপার ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট করেই ছাড়বেন।
চাকা ঘোরে। মেজাজের পারদও চড়ে। একসময় মেজাজ পৌঁছয় সপ্তমে। তারপরেই আধুনিকা, সম্ভ্রান্ত মিসেস বোসের চিল চিৎকার- "খুকু একটু আয় তো।"
একটু দেরি হতেই ফের চিৎকার। "কথা কানে গেলো না বুঝি?"
- গলাটা নামাও তো মাম্মি। বলো এবার।
- দেখ তো, কিছুতেই পোস্টটা হচ্ছে না কেন?

শহিদ মিনারের হাইটটা ঠিক কতো? ঠিক মনে পড়ছে না বাবার। অগত্যা, পুত্রের দ্বারস্থ।
- খোকা, একটু গুগল সার্চ করে দেখ তো!
- কী দেখব?
- শহিদ মিনারের হাইটটা ঠিক কত। মনে পড়ছে না।


এমনি আরও শত সমস্যার সমাধান জানা আছে বাড়ির খোকা-খুকুদের। কিন্তু সেই সমাধান সূত্র মা- বাবাকে হাতেকলমে শেখাতে গেলেই বিপদ।
- "নাক টিপলে এখনও দুধ বেরোয়। তুই এসব কি বুঝবি রে?"
পাছে গুরুজনের অজ্ঞতা ধরা পড়ে যায় !
হেরে যাওয়ার এতো ভয়? তা বলে, নিজেদের চারদিকে অহমিকার এই মিথ্যা চীনের পাঁচিল তুলে ধরা কেন? দরকারে অদরকারে খোকা খুকুদের রাগ দেখানো। ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না।

"তেলের শিশি ভাঙলে বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ কর .."

আবার স্কুলের খোকা যখন কলেজের অর্ক, তখন ঝামেলা আরেকটু গড়ায়।
আজ ইলেকট্রিক বিলটা জমা না দিলেই নয়। অথচ ব্যস্ত বাবার হাতে সময় নেই। আজ আর কাল করে, বিল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
- "অর্ক, কলেজ যাওয়ার পথে বিলটা জমা দিয়ে দিসতো।"
- "সেতো উল্টো রাস্তা বাপি।"
- "বাড়ির কোনও কাজে লাগে না বাবু।"
বাবার খোঁচার ঘায়ে, এবার মেজাজ বিগড়ে যায় অর্কর।
- "ফালতু বোকো নাতো বাপি। তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা বলো। এখনই জমা দিয়ে দিচ্ছি।"
আপনি নেট ব্যাঙ্কিং জানেন না। অর্ক জানে। ফের অজ্ঞতা ফাঁস বাবার।

তবু এই খোকাখুখুরা নাকি ঘরের কোনও কাজে লাগে না।
- "ঘরের খেয়ে বনের মোষ চড়ায়।"
- "এই বয়সেই এঁচোড়ে পেকেছে!"
- "উচ্ছনে গেছে। আর কিছু হবে না।"
এমনসব হাজারো চোখা- চোখা মন্তব্য। আর সবশেষে মান্ধাতা আমলের সাতপুরনো ডায়লগ।
"এই তো আজকালের ছেলেমেয়ে। এরা আবার বাপ-মাকে দেখবে? সেই আশা করি না।"

আধুনিক প্রজন্মের কাছে প্রাচীনরা যত হারেন, ততই খেপে ওঠেন। তাদের ধারনা, ওরা তো ছোট। বয়সে ছোট মানে, জ্ঞান বুদ্ধিমত্তা সবেতেই খাটো। কিন্তু সময়ে সময়ে নিজেরাই প্রশ্নের মুখোমুখী দাঁড়ান গুরুজনরা। যখন কম্পিউটরের মনিটর থেকে দুম করে হারিয়ে যাওয়া কপিটা খুঁজতে হয়। বা ঘরে বসেই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সটা দেখে নিতে হয়। হঠাত ট্যুরে যাওয়ার সময় অনলাইন ইন্ডিগোর টিকিট কেটে নেওয়ার সময় ভরসা ওই খোকাখুকুরাই।

একেক সময় নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে নিজেরাই সন্দিহান। অযথা এক 'ইগো'তে বেজায় ভোগেন গুরুজনরা। অথচ নিয়ন্ত্রণের রশি ছাড়তে বেজায় আপত্তি। সবসময় সর্বত্র ক্ষমতায় থাকতে চান। সংসারে, রাজনীতিতে, মন্দির মসজিদ গির্জাতে।

সবজান্তা সাদাচুলোরা।
কী হাল করেছে দেশটার, দেখুন। পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধাঁয় যাচ্ছি না। নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন!

রাজনীতিতে বৃদ্ধতন্ত্র। প্রয়াত রাজীব গাঁধীর জমানায় আশা জেগেছিল। মনে হয়েছিল এবার 'ইয়ং ইন্ডিয়া'। বাস্তুঘুঘুদের বিদায় আসন্ন। শেষপর্যন্ত অকালে প্রাণ দিলেন রাজীব। ফের উল্টো ঘুরলো কালচক্র। কায়েম হলো পক্ককেশতন্ত্র, আরও একবার। টেকোতন্ত্রও বলা যেতে পারে। মগজের প্যাঁচে পড়ে চুল পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিদায় নেয়। নাকি আরশির সামনে দাঁড়িয়ে চুল ছিড়ে, নিজেরাই নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন কে জানে?

রাজ্য-রাজনীতিতেও লালদূর্গ পতনের পর মনে হয়েছিল, এবার খানিকটা তরতাজা হাওয়া বইবে। বয়নি। বয়সে নবীনরাও চট করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন সেই মান্ধাতা রীতিনীতি। বৃদ্ধতন্ত্রের প্যাঁচ-পয়জার। স্বাদ পেয়ে গেলেন সংসদের ক্যান্টিনের সস্তার মহার্ঘ্য খাবারের। এভাবেই বেশ তো সুখের পরমান্ন খেয়ে তোফা জীবন কাটানো যায়। শেষ পর্যন্ত বদলালো না কিছুই।

এবার বিজেপি। বাস্তুঘুঘু'রা সেখানেও আছেন। তরুণ কেউই না। এবার অপেক্ষা, রামরাজ প্রতিষ্ঠার।

"কী আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে!"

দিগগজরা আবার বলেন, ব্যক্তি বদলে কিছু হবে না। বদলাতে হবে সিস্টেমটাকেই। বেশ। তাহলে এবার বলুন, সিস্টেমটা কে বদলাবে? ভগবান না শয়তান।
যে যখন শাসকের ছড়ি ঘুরিয়েছেন, নিজের সুবিধা মতো সিস্টেম তৈরি করে নিয়েছেন। ইন্দিরা জমানায় বেসরকারি শিল্পের সরকারীকরণ হলো। মনমোহন জমানায় শুরু হলো আর্থিক উদারনীতি। বিলগ্নিকরণ। উল্টোমুখী পথে হাঁটা। মোদি ষোল কলা পূর্ণ করার রাস্তায় হাঁটলেন।

সবাই সিস্টেম বদলের গান শোনালেন। তারপরেই সেই বদলের রাস্তাতেও হাঁটলেন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে কোথায় পৌঁছলেন?
ফের আওয়াজ উঠলো, এ ভুল রাস্তা। এ ওকে খিস্তি মারলেন। ও তাকে। বিরক্ত জনগণ। বিদ্বজ্জনের মহাসভা ফের রায় দিলো, চলবে না এই সিস্টেম। সিস্টেম বদলাতে হবে। এবার প্রশ্ন দাঁড়ালো, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
আঁচড়ে, কামড়ে দিলেই তো গেল। কোন বৃদ্ধের এমন বুকের পাটা যে ওই সিস্টেম 'হুলো'র সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়?
আছে নাকি কেউ?
সবমিলিয়ে তো এক বৃহত্তর অচলায়তন।

"ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।"

কিন্তু ঘা মারলেই হলো নাকি?
মুখে যতোই 'ইয়ং ইন্ডিয়া'র তাপ্পি মারুন না কেন, পক্ককেশদের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়। পরিসংখ্যান মন্ত্রক জানাচ্ছে, 2016 সালে দেশে ষাটোর্দ্ধদের সংখ্যা ছিল এগারো কোটি ছাব্বিশ লক্ষ। আগামিদিনে কিন্তু ওই সংখ্যা আরও বাড়বে। 2020 সাল নাগাদ, দেশের প্রতি একশোজনের মধ্যে কুড়িজনই হবে সিনিয়র সিটিজেন।

কবির কল্পনার সেই নবীনরা, দৌড়চ্ছে ওই মাননীয় গুরুজনদের দেখান পথেই। ছলে বলে কৌশলে তৈরি করে নিতে চাইছে নিজেদের নিরাপদ বৃত্ত।
উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া লোভ চরিতার্থ করতে তারাও কম যায় না। বিবেকের শাসন আজ রূপকথা। তবু আজও সময়ে অসময়ে দু-একজন জ্বলে ওঠে। তাদের শায়েস্তা করতে কড়া পদক্ষেপ করে রাষ্ট্রযন্ত্র। নিন্দিত হয় সমাজেও।

শৈশব থেকে শাসন শুধু শাসন। কেন? নিজেরা তো কিছুই করে উঠতে পারলেন না প্রবীণরা। কী রেখে গেলেন উত্তরাধিকারীর জন্য? দমবন্ধ দিল্লি। অশান্ত ভারত।
তারপরেও শাসন করেন কোন মুখে?

"নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ/ তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর/ ফুসফুস ভরা হাসি..."

প্রত্যেকটি বিজের মধ্যেই মহিরুহের সম্ভাবনা। তাকে নিজের মতো বাড়তে দিন। সাদাচুলোদের স্বপ্নপূরণের দায় নিয়ে কোনও নবীনের জন্ম হয় না।

যদি জীবন-সঞ্চয় জমাখাতা জিরো ব্যালেন্স না হয়ে থাকে। একটুও ভালবাসা বেঁচেখুঁচে থাকে। যাওয়ার আগে নবীনদের দিয়ে যান। ঠিক যেমন কবি দিয়েছিলেন, ফুসফুস ভরা হাসি। কাছে টেনে নিন ওদের। ওরা তার বদলে আপনাদেরও উজার করে দেবে। ভুলে যান, কে কবে আপনাদের চোট দিয়েছিলো। একবার চশমাটা চোখে চড়িয়ে পেছন ফিরে তাকান। দেখবেন আপনারাও অনেকের মন ভেঙেছেন। বয়স হলেই সব দোষ মাফ হয়ে যায় না। সাধুপুরুষ বা সাধ্বীমহিলাও হয়ে যায় না। ওসব বুজরুকি। হিপোক্রেসি।

ঘৃণা রেখে যাবেন না যেন উঠতিদের জন্য। পারলে ভালবাসা রাখুন। নিজেদের পৃথিবী গড়ুক একদল দামাল। ভুল ওরাও করবে। আবার ভুল থেকে শিক্ষাও নেবে। কচি মগজ শেখে বেশি, ধারণ ক্ষমতাও বেশি। তারচেয়েও বড় কথা, একটা ঝুঁকি নিতেই বা ক্ষতি কোথায়?এখনই বা কোন পরমসুখে আছি আমরা?

পারলে ওই নতুনেরাই পাড়বে।
বুড়োমাথাদের সাধ্য কি নতুন দিশা দেখানোর?




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours