গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

‘ক্যাসিনো রয়্যাল’..... সালটা 1953, সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, বিশ্বজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে ক্যাসিনো রয়্যাল সিনেমার নায়ক ব্রিটিশ গুপ্তচর 007 জেমস বন্ডের গল্প নিয়ে, ফ্লেমিংয়ের গল্পের নায়ক ব্রিটিশ গুপ্তচর এই 007 জেমস বন্ড কি নেহাতই এক কাল্পনিক চরিত্র না কি সত্যিই বাস্তবে তাঁর কোনো অস্তিত্ব ছিল!  হয়তোবা ছিল!  কিম্বা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এই গোয়েন্দা চরিত্রটি,  যদিও অনেকেই মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়  ইয়ো-টমাস নামে এক ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিলেন, যার সঙ্গে আশ্চর্য মিল ওই গল্পের নায়ক জেমস বন্ডের সাথে।  ব্রিটিশ নথি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অন্তত তিন-তিন বার গুপ্তচরবৃত্তির জন্য এই ইয়ো টমাসকে জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল,  ধরাও পড়েছিলেন তিনি, কিন্তু সিনেমার গল্পের মতো সেখান থেকে পালিয়েও এসেছিলেন ইয়ো-টমাস। কাকতালীয় ভাবে এই ইয়ো টমাসের সঙ্গে 007 জেমস বন্ডের বেশ কিছু মিলও লক্ষ্য করা গেছিলো, তারও ছিল 007 এর মত নায়ক সুলভ চেহারা, আচার-আচরণ, তিনিও বন্ডের মতোই সুন্দরী নারী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা পছন্দ করতেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
পৃথিবীর বাস্তব গোয়েন্দাদের জীবন কিন্তু একেবারেই জেমস বন্ডের মত নয়, সিনেমার নায়ক 007 এর সঙ্গে বাস্তবের গোয়েন্দার জীবনের বিস্তর ফারাক, যদিও সাধারণ মানুষের ধারণা এই সব গোয়েন্দারা সবাই এমনই সিনেমার মতো গোয়েন্দাগিরি করে বোধহয়!  আসল জীবনে গোয়েন্দারা ঠিক কতটা সিনেম্যাটিক! ব্রিটেনে গোয়েন্দা সংস্থা 'GCHQ' এর প্রধান কার্যালয় 'MI-6' যেখানে সিনেমায় নায়ক জেমস বন্ড কাজ করেন দেখানো হয়, সেটি মূলত ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান। সেখানে যারা সত্যিকারের গোয়েন্দা বা দেশের হয়ে  গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেন তাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু মোটেই সিনেমার জেমস বন্ডের মত নয়, এমনকি তাদের জীবন-যাপন, কর্মপদ্ধতি 007 এর ধারেকাছেও পৌছবে না।
ব্রিটেনে গোয়েন্দার চাকরি পাওয়াটা ভীষণ কঠিন ব্যাপার, অন্যান্য যোগ্যতার সঙ্গে আছে নানান বিধিনিষেধ, যেমন মাদক গ্রহণ করা একদম চলবে না, এইজন্য নিয়োগের সময় কঠিন ড্রাগ টেস্ট নেওয়া হয়, তাতে উত্তীর্ণ হতেই হবে। চাকরির অন্যতম শর্ত হলো পেশা সম্পর্কে কাউকে কিছু জানানো যাবে না, আর এই গোয়েন্দার চাকরির সবচেয়ে বড় অসুবিধা এটাই!  চুড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে যেতে হবে পুরো চাকরি জীবন ধরে, বাবা মা  এমনকি নিজের স্ত্রীর কাছেও নিজের চাকরি জীবন সম্পর্কে সব তথ্য গোপন করে যেতে হবে! প্রয়োজনে মিথ্যে বলতে হবে! পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ তো রাখাই যাবে না!            এবার আসি ভারতের জেমস বন্ড, অজিত ডোভালের প্রসঙ্গে, এই মূহুর্তে ভারতবর্ষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব, টেলিভিশন সেটে চোখ  রাখলেই যাকে সংবাদ শিরোনামে দেখা যায়, বিশেষত কাশ্মীরের জঙ্গি দমনের বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পেছনে মনে করা হয় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।জীবন্ত কিংবদন্তী, ভারতের সুপার গোয়েন্দা এজেন্ট অজিত ডোভাল, এই 'ইন্ডিয়ান 007'  কিন্তু পাকিস্তানের কট্টর পন্থী জঙ্গিদের কাছে এক আতঙ্ক, তার নাম শুনলে রীতিমত ভয় পেয়ে যায় অধিকাংশ জঙ্গিদের দল এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা! শোনা যায় এই অজিত ডোভাল পাকিস্তানে গুপ্তচর হিসেবে সাত-সাতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন নির্বিঘ্নে, সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো তিনি ওখানে মুসলমান হিসেবেই সাত বছর কাটিয়েছিলেন এবং ভারতকে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সফলভাবে সরবরাহ করে গেছেন সম্পূর্ণ গোপন ভাবে। এটা যে কতো কঠিন কাজ সিনেমা হলে জেমস বন্ডের ছবি দেখে বোঝা সম্ভব নয়!  এই মূহুর্তে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সব থেকে ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি হলেন এই অজিত ডোভাল।                    আজকের মিডিয়ার দৌলতে অজিত ডোভালের নাম অনেকেই শুনে থাকলেও, ভারতবর্ষের আর এক অসামান্য মহিলা গুপ্তচরের নাম কিন্তু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে!  যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য মাত্র ষোল বছর বয়সেই নিজের জীবন বাজি রাখতে ভয় পান নি। তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ বাহিনীর একজন অকুতোভয় মহিলা গুপ্তচর,  তার নাম ছিল "রাজামনি"। নেতাজী যখন দিনের পর দিন সিঙ্গাপুরের অনাবাসী ভারতীয়দের সামনে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখাতেন তার জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে, সেই রকম কোনো এক দিনে, ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত নেতাজীর বক্তব্য শুনছিলেন এক যড়শী কিশোরী,  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে, স্বাধীনতা যুদ্ধের খরচের জন্য নেতাজী অনাবাসী  ভারতীয়দের কাছে সাহায্যের প্রাথনা করছিলেন, নেতাজীর বক্তৃতা শুনে কিশোরীটি সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করেন নি, ছুটে চলে আসেন বাড়ীতে, তারপর বিয়ের জন্য রাখা তার সমস্ত অলঙ্কার গুলি বাড়ী থেকে নিয়ে সোজা এসে  তুলে দেন সেইসব মুল্যবান অলঙ্কার সামগ্রী আজাদ হিন্দ বাহিনীর এক সেনার হাতে, গ্রাহক সেনা জওয়ানটি আশ্চর্য হয়ে তার নাম জিজ্ঞাসা করেন, জানতে পারেন কিশোরীটির নাম "রাজামনি ",  এরপর  বাড়িতে ফিরে রাজামনির আরও অবাক হওয়ার পালা, ঘরে ফিরে দেখেন, তার বাবার সাথে বসে আছেন সয়ং নেতাজি আর সামনের টেবিলে রাখা আছে, কিছুক্ষণ আগে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে দান করা তার সমস্ত অলঙ্কার গুলি।  আসলে নেতাজি আগে থেকেই এই রাজামনির পরিবারকে চিনতেন, অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি পরিবার।  এরপরও রাজামনি কিন্তু ফেরত নিতে চাইলেন না তার দান করে দেওয়া অলঙ্কার এবং তারপর নেতাজিকে প্রায় জোর করেই রাজী করিয়ে, তিনি যোগ দিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীতে। নেতাজী তার নতুন নামকরণ করলেন "স্বরস্বতী রাজামনি" আর তাকে দিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্য নার্সিং এর কাজ, কিন্তু রাজামনি সেই কাজে মোটেই খুশি থাকতে পারেন নি,  তার ইচ্ছে ছিল দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়া, কিন্তু নেতাজী রাজি হলেন না, তাই অনেক ভাবনাচিন্তা করে রাজামনির সাথে আরো পাঁচজন মহিলাকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য দিলেন বিশেষ প্রশিক্ষণ, পরে তাদের পুরুষের পরিচয়ে কৌশলে ঢুকিয়ে দিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি যে প্রায় দু বছর ধরে এই ছয়জন মহিলা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে মিশে থেকে নেতাজীকে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং  নথিপত্র, অনেকের মতে যার ভিত্তিতেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর পক্ষে  ব্রিটিশ বাহিনীকে ইম্ফল থেকে পিছুহটতে বাধ্য করা অনেকটাই সহজ হয়েছিল, পরবর্তী কালে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যান তাদের মধ্যে একজন মহিলা গুপ্তচর,  কিন্তু রাজামনি ঠিক করলেন তিনি তার গুপ্তচর সঙ্গীনীটিকে মুক্ত না করে কিছুতেই পালাবেন না! এই কাজে তিনি সফল হলেও, পালানোর সময় এক ব্রিটিশ আর্মি-অফিসারের ছোড়া গুলি এসে লাগলো রাজামনির পাঁয়ে, যদিও শেষপর্যন্ত তিনি পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিস্ময়ে অবাক হওয়ার মতো কাহিনী, যে যুগের ঘটনা এটা সে যুগে অধিকাংশ মহিলা পর্দার আড়ালেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত ছিল! এই বীরাঙ্গনা স্বরস্বতী রাজামনি ভারতীয় গুপ্তচরদের মধ্যে একজন কিংবদন্তী, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি গান্ধীবাদী বা দিল্লীর মসনদের নেতাদের কাছাকাছি না হয়ে সুভাষপন্থী হওয়ায়, তার এই দুঃসাহসিক কীর্তিকলাপ, তার আত্মত্যাগের কাহিনী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে, মুছে গেছে তার নাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা থেকে! যতটুকু জানা যায়,  তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা-গুপ্তচর, যিনি তার আরাম ঐশ্বর্যের জীবন ত্যাগ করেছিলেন শুধুমাত্র দেশমাতৃকার সেবার উদ্দেশ্যে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার শেষ জীবন কেটে ছিল চেন্নাইয়ের একটি এক কামরার ফ্ল্যাটে, শেষপর্যন্ত অখ্যাত, অসহায় ভাবে, চরম দারিদ্র্যের মধ্যেই তাকে এই সুজলা সুফলা স্বাধীন ভারতের বুক থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল!





Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours