নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

বিরলতা পেয়ে গেছি, যেমন ফেলে আসা স্মৃতি, খসে পড়া স্বপ্ন এই নিয়ে কদিন বেশ সময় কাটাবার ফন্দি হিসেবে স্মৃতি বৃত্তান্ত লিখতে শুরু করেছিলাম। পেছন ফিরে তাকানো স্মৃতি মন্থন করে মজা নেওয়াটা বড়ই প্রাত্যহিক যেন জীবন নদীর স্রোত বেয়ে চলা।
কিছুটা সোজা সাপটা কিছুটা বাঁকা । যখন লিখতে যাই স্মৃতির ফ্লুয়িডের ধরণ কেমন যেন পাল্টে যায় । মানুষের সবচাইতে বড় টান স্মৃতি। ভালও কিছু নির্মল সময় যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তখন কেবল ভালও স্মৃতির কথা ভেবে নিজেক সান্ত্বনা দেবার মতো একটা ছল মাত্র।

তখনও আমি স্কুলের গণ্ডি ছাড়িনি, ক্লাস সেভেনের বছর শেষের পরীক্ষা শেষ করেই আমি পড়লাম জ্বরে । সেকি জ্বর, দিন কতক বলে কয়ে গেলো । জ্বরের ঘোরে যখন কাৎরাচ্ছিলাম আব্বা নিছক ভোলাবার জন্য বলেছিলেন মনে হয় , তুই ভালো হয়ে গেলে রে বেটি এবার তোকে রাজবাড়ি দেখাবো।
ভাল হয়ে যাওয়ার পর যে প্রতিশ্রুতি বিফলে যেতে দেওয়ার মত মানুষ আমি মোটেও নই । যেমনই বায়না অমনি কান্না । অবশেষে বাপ বেটি একদিন ঠিক ঠিক রাজার বাড়ির ফটকে হাজির হলাম ! তবে সেদিন  বুঝলাম -রাজবাড়ির রাজকীয় জৌলুস হারিয়ে গেছে। বিশাল বিশাল প্রাসাদের দেয়ালে পড়েছে কালো কালির দাগ , পলেস্তরা খসে লাল লাল ইট গুলো বিদ্রুপে  হাসছিল যেন । এখানে সেখানে ঝুলছে মাকড়সার জাল। রাজবাড়ির শীরে নেই সোনার চকচকে ঘড়ি কিংবা পরী ! কোথাও বাজছিল না নহবত। জ্বলছিল না ধূপ। কেউ গাইছিল না মল বাজিয়ে গানের সাথে ঘাঘডা় ঘুরানো নাচ । সেই রাজবাড়িতে হঠাৎ জ্বলে উঠবে না আলো। নড়ে উঠবে না দমপাখা ,  অন্দর মহলের খিলখিল হাসির আওয়াজ যেন হারিয়ে গেছে । ক্ষয়িষ্ণু দেয়ালের গায়ে কেবল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ঘুরে ঘুরে নিজের কানেই শুনছিলাম । আব্বার কাছে রাজ রাজরার অত্যাচার , বীরত্ব কত কত গল্প শুনছিলাম আর  হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম দেয়ালের কারুকাজ প্রদীপ্ত ক্লান্ত মুখে মৃদু হাসির রেখা  রাজবাড়ির কক্ষে কক্ষে অপলক দৃষ্টি আমি আগন্তুকের।
দেখতে দেখতে যখন রাজবাড়ির প্রধান নর্তকীর কাছে কক্ষে  আমি। নানান সিনেমায় দেখা নতর্কীর কাছে এসেছেন রাজা বিস্ময়ে প্রধান প্রহরী আবারও কুর্নিশ করে, হে মহামান্য রাজবাড়ির, প্রতিটি ইট ধূলিকণা কেবল আপনারই আগমনের অপেক্ষা করে আছে। রাজামশাই বিস্ময়ে বলছেন হেসে চকচকে আঙ্গারাক্ষার আস্তিন গুটাতে গুটাতে আমারই অপেক্ষায়? বাহ বেশ ! তবে কোথায়  আমার সুরা ও সাকি ?  চারদিক যেন একটা আনন্দ ভৈরবী বেজে যাচ্ছে ...বিশাল রাজপ্রাসাদের কোটরে কোটরে জ্বলে  ওঠলো আলো। নানান  রঙের আলো। লাল আলো। নীল আলো। সবুজ আলো। বেগুনি আলো।  হলুদ আলো। মনে হচ্ছে- রাজবাড়িজুড়ে আলোর ফোয়ারা বইছে। রাজ দরবারে বাজতে থাকে নহবত। নারী ফোয়ারায় উঠছে ঝিরঝিরে পানি। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভেসে আসছে নির্মল সুগন্ধ বেলী হাস্নাহেনা কাঠালীচাপার। নর্তকীর বাঁকা ঠোটে ঝিকমিকি হাসির সাথে ঢেলে দেয়া সুরা ! চারপাশটা বিহ্বল আনন্দে অবগাহনে টইটুম্বুর। বিভ্রান্ত দর্শক আমি , বর্তমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে অতীত দেখছি চর্তুদিকে তাকাচ্ছি আর হাঁটছি। হাঁটছি  আর তাকাচ্ছি । হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি অতুলনীয় প্রাসাদ কোন কাব্যকলার শরীর থেকে তুলে আনা হয়েছে? নাকি কোন বিভ্রম বিভঙ্গের মৈথুন লগ্নের উদ্ভাস ! যেন নিমিষেই হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেলাম আব্বার ডাকে । মা আমরা এখন বের হবো...এসে পড়েছি প্রধান ফটকে । রাজবাড়ির বিশাল আয়তন পার হয়ে যখন দাঁড়ালাম মূল প্রাসাদের দরজায়।

সেই ক্ষয়ে যাওয়া রাজ বাড়ির পয়লা ফটক দেখে কেবলই বঙ্কিমচন্দ্রের এক প্রবন্ধের কথা মনে হলো যা না বললেই নয় । বলেছিলেন 'বাঙালির ইতিহাস নাই, যে জাতির ইতিহাস থাকে না, তাদের মধ্যে স্বভাবতই এসে পড়ে বিস্মৃতির ঝোঁক' । আর তাই 'সিটি অব প্যালেস মানে' কোলকাতার অসংখ্য প্যালেস বা প্রাসাদের সৌন্দর্য ঐতিহ্য যে আজ ধ্বংসের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে , সে সম্পর্কে কলকাতার নাগরিকদের সচেতনতা খুবই কম। তেমনি বাংলাদেশের প্রাসাদ স্থাপত্য ধ্বংসের অতলে চলে গেছে । এখানে নাগরিক সচেতনতা যতো কম তার চেয়ে কম সরকারের সচেতনতা।

গ্রীক কবি সেফেরিস বলেছিলেন 'গ্রীস গো'জ অন লিভিং ফর বেটার, ওর ফর ওয়ার্স', ইট ইজ ইন লাইফ, হ্যাজ নট এক্সপায়ারড ইয়েট'।

আমার চোখে শত বিক্ষত দিনের গভীর ব্যথাভার এবং অনুভবের রক্ত তীলক। তাকিয়ে আছি অবিচল নিষ্ঠা, অুনরাগে আর কল্পনার সরল উপমায়, কবিতার সকল দ্রাঘিমা যোগ বিয়োগ সরল ঐকিক ঐকান্তিক চোখে ক্ষয়িষ্ণু  প্রাসাদের ইতিহাসের দেয়ালে ঝুলানো তৈল চিত্রে !


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours