কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

দল যাদের ওপর বিশ্বাস করতে পারে না, তাদের ওপর ভরসা করতে হবে মহারাষ্ট্রকে।

অবিশ্বাসের মেঘ ছেয়ে ফেলেছ আরব সাগরের আকাশ। এ এক অন্য সুনামির পূর্বাভাস। যার ভয়ে কাঁপছে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিমন্ডল। বেইমানি আর অর্থলালসা ঘুরিয়ে দিতে পারে হাওয়া মোরগের মুখ। সেই ঝঞ্জায় কোন শিবির উড়ে যাবে, কেউ জানে না।

প্রত্যেকের চোখে আজ সন্দেহের ছায়া। একই দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। দলের সুপ্রিমো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না তাঁর দলের বিধায়কদের নিয়ে। কে জানে কখন কখন কোন বিধায়ক ঘোড়া কেনাবেচার বাজারে নিজেদের বিক্রি করে বসেন। সেই আতঙ্কের থেকে বাঁচতে মাননীয় বিধায়কদের হোটেলবন্দি রাখছে দল। তাতেও বা স্বস্তি কোথায়? বন্দি বিধায়কদের চালান করা হচ্ছে, এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে। চব্বিশ ঘণ্টার নজরদারি। ফাঁক দিয়ে যাতে মাছিও না গলে। কোথাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে মোবাইল। দিব্যি খাওয়ানো হচ্ছে। সমানে আবেগের ঘরে বাতাস দিয়ে উসকে দেওয়া হচ্ছে দলীয় আনুগত্য।

এভাবেই মহারাষ্ট্রে নিজেদের শিবির অক্ষত রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছে শিবসেনা, এনসিপি আর কংগ্রেস। ভয় বিজেপি জুজুর। কিজানি কখন ঘর ভাঙিয়ে নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসেব মিলিয়ে ফেলেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। এদিকে বিজেপি এখনও বলে চলেছে এনসিপির বিধায়করা তাদের সঙ্গে। প্রথম পর্যায়ে ফড়নবিস জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি সরকার গড়তে অসমর্থ। কিন্তু তারপর থেকেই পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে চলেছিলো বিজেপি।

এরপর কয়েকদিন কাটতে না কাটতেই বল চলে আসে বিজেপির কোর্টে। এনসিপি'র প্রতিষ্ঠাতা শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ারের কথাতেই রবিবার সাতসকালে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেন দেবেন্দ্র। অজিত হন উপমুখ্যমন্ত্রী। ইডি'র কেস থেকে বাঁচতেই অজিত বিজেপির শরণ নিয়েছেন বলে রাজনৈতিক মহলের মত। এর আগেই তিনি মহারাষ্ট্র স্টেট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন। তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষার হুমকি দিয়েছিলেন ফড়নবিস। কিন্তু সেই ফড়নবিস কলঙ্কিত অজিতের সমর্থনে সরকার গড়তে চাওয়ায়, রাজনৈতিক মহল এক অন্য রহস্যের গন্ধ পেয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, নেপথ্যে ব্ল্যাকমেলিংয়ের খেলা চলছে।

রবিবার এনসিপি'র সমর্থনে বিজেপি'র সরকার গড়ার খবর কানে যেতেই, ময়দানে নেমে পড়েন এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ার। দেবেন্দ্র, অজিতের কথা উড়িয়ে দিয়ে তিনি জানান, এনসিপি শিবসেনা কংগ্রেসের সঙ্গেই আছে। এরপরেই আরও একবার প্রকাশ্যে চলে এলো কাকা ভাইপো শরদ, দেবেন্দ্র পাওয়ারের লড়াই।

অবিশ্বাসের এই বাতাবরণ তৈরি করলো কে? ক্ষমতার লোভ। যেই লোভের সামনে ম্লান হয়ে যায় রাজধর্ম। নীতিজ্ঞান। যোগ্য মানুষ পান না যোগ্য সম্মান। প্রাধান্য পায় রক্তের সম্পর্ক। মসনদ দখলের পরিবারতন্ত্র। কলির চোখওয়ালা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্ররাই এক নতুন কুরুক্ষেত্র বাঁধান। আবার ওদিকে উচ্চাশাপূরণে বাধার মুখে পড়লেই জেহাদ। কাকা- ভাইপোর সম্মুখসমর।

কাকা ভাইপোর এই লড়াই মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে কোনও নতুন কথা নয়। বরং বলা যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সেদিনের সেই রণক্ষেত্র ছিলো 'মাতুশ্রী'। কাকা ছিলেন মহারাষ্ট্র রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বালাসাহেব ঠাকরে, ভাইপো রাজ ঠাকরে। নিজে বরাবরই ক্ষমতার সিংহাসন থেকে দূরে থেকেছিলেন। বালাসাহেব ছিলেন 'কিংমেকার'।
কাকা বালাসাহেবের ছায়া ছিলেন ভাইপো রাজ। সবাই রাজের মধ্যেই বালাসাহেবকে দেখতে পেতেন। দুজনেই ফায়ারব্র্যান্ড। সে তুলনায় বালাসাহেবের ছেলে উদ্ধব ছিলেন বেশ শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক। বালাসাহেব আর রাজের চলন-বলন, রাজনীতির এই মিল ছিলো চোখে পড়ার মতো। সবাই ধরে নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে বালাসাহেবের হাতে তৈরি শিবসেনার লাগাম যাবে ভাইপো রাজের হাতেই।
কিন্তু অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো কাজ করে বসলেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ বালাসাহেব।
সবাইকে চমকে শিবসেনার সিংহাসন তিনি তুলে দিলেন ছেলে উদ্ধবের হাতে। সালটা ছিল ২০০৪। ওই ঘটনাই উসকে দিয়েছিলো রাজ ঠাকরেকে। এর ঠিক দু'বছর পরেই, তিনি তৈরি করে বসলেন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা। টাকাপয়সা না, সম্পত্তি না, সেরেফ ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে সেদিন ফাটল দেখা দিয়েছিলো ঠাকরে পরিবারে।

এবার ফাটল দেখা দিলো পাওয়ার পরিবারেও। কারণ সেই একই। ক্ষমতার শীর্ষে বসা। পরিবার আর দলে ফাটলের কথা সরাসরি ট্যুইট করে জানিয়েছেন শরদ পাওয়ার তনয়া সুপ্রিয়া সুলে।
শরদ পাওয়ার অজিত পাওয়ারের মধ্যে চাপা ক্ষোভ জমেছিলো অনেকদিন ধরেই। কাকা রাজনীতির ওস্তাদ খেলোয়াড় শরদ পাওয়ারের কাছেই হাতেখড়ি ভাইপো অজিতের। কাকার হাত ধরেই ভাইপোর চলতে শেখা। স্বাভাবিক ভাবেই কাকা ভাইপো মিলে মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে এক স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরি করেন। অজিতই শরদের রাজনৈতিক উত্তরাধাকারী, এরকমটাই ভেবে বসেছিলেন মানুষ। কিন্তু সেখানেও অশান্তি দেখা দেয় শরদের মেয়ে সুপ্রিয়া সুলেকে নিয়ে।

অজিতের সন্দেহ হয় এনসিপির ক্ষমতা দখল করে নিচ্ছে সুপ্রিয়া। এবারের ঘটনা অজিতের সেই চাপা ক্ষোভের প্রতিফলন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এ বছরই ভাইপোর চাপে শরদ পাওয়ারের দূর্গ বলে পরিচিত মাওয়েল লোকসভা কেন্দ্র থেকে সরে আসতে বাধ্য হন এনসিপি সুপ্রিমো। শরদ পাওয়ারের জায়গায় প্রার্থী হন ভাইপোর ছেলে পার্থ অজিত পাওয়ার। তবে শেষরক্ষা হয়নি। শিবসেনার কাছে হার মানতে হয় পার্থকে।

দলভেঙে ক্ষমতা দখলের এই খেলা কাকার থেকেই শিখেছিলেন ভাইপো। আজ যেভাবে এনসিপি ভেঙে অজিত পাওয়ার নিজে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসলেন, একদিন শরদও ওরকম বাঁকাপথেই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে চড়ে বসেছিলেন। সাল ১৯৭৮। জনতা দলের মদতে নিজের দল কংগ্রেস (ইউ)কে ভেঙে নিজের উচ্চাশা পূরণ করেছিলেন। মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে বালাসাহেব 'কিংমেকার' বলে পরিচিত হলেও, শরদ পাওয়ারের পরিচিতি 'চাণক্য'র। দল ভাঙাগড়া, ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত তিনি।

শুধু মহারাষ্ট্রেই না, কাকা ভাইপোর আরেক কুরুক্ষেত্র দেখেছিলো উত্তরপ্রদেশ। সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিংয়ের পরে দলের ক্ষমতা হাতানো নিয়ে সম্মুখসমর দেখা গেছিলো কাকা শিবপাল ভাইপো অখিলেশের। মুলায়ম ছেলে অখিলেশের দিকে ঝোঁকায়, শিবপাল তাঁর নিজের দল প্রগতিশীল সমাজবাদী পার্টি বানিয়ে ফেলেন। হরিয়ানাতে পাঞ্জা কষেছিলেন কাকা অভয় চৌতালা ভাইপো দুষ্মন্ত চৌতালা। পঞ্জাবে একই দৃশ্য দেখা গেছিল কাকা চরণজিত সিং ভাইপো অঙ্গদ সিংয়ের মধ্যে।

মোট দুশো অষ্টআশি আসনের মহারাষ্ট্রে সরকার যেই বানাক, আজকের এই হোটেলবন্দি বিধায়কদেরই অভিষেক হবে বিধানসভায়। কেউ হবেন মন্ত্রী আবার অন্যেরা পাবেন নানা দায়- দায়িত্ব। শাসক বিরোধীদের সমন্বয়েই চলবে ভারতের আর্থিক ভরকেন্দ্র মুম্বাই। গোটা মহারাষ্ট্র। নিজেদের দলের কাছেও এই বিধায়করা যতোই অবিশ্বাসের পাত্র হোক না কেন, রাজ্যের ভরসা রাখতে হবে এঁদের ওপরেই। আগামী পাঁচ বছর এঁরাই ঠিক করবেন মহারাষ্ট্রের চলার পথ।





Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours