পারমিতা দাস, লেখিকা, কলকাতা:
বেশ ছোটবেলায়, যখন সদ্য গল্পের বইয়ের নেশা শুরু হয়েছে তখন থেকেই নবনীতা দেবসেন আমার কাছে পরিচিত নাম। তাঁর গল্পের সুত্রে তিনি তখন আমার পাশের বাড়ির গল্প বলা পিসি মাসী, যিনি পা ছড়িয়ে বসে গল্প বলতে শুরু করলেই নিমেষে তার চারদিকে গোল করে এসে বসে সবাই, এমনই তার গল্পের টান। তাঁর বসন মামা, মূলতানী কামধেনু, মেজকাকীমার গল্প বোধহয় সেই সময়ের পড়া। অনেক পরে তাঁর পান্ডিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই। কবি দম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী দেবীর এই বিদুষী কন্যা ছিলেন প্রেসিডেন্সী কলেজের স্নাতক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। পরবর্তীকালে তিনি হাভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি, বার্কলে ইউনিভার্সিটি ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁর ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা শেষ করেন। তিনি ইউ জি সির সিনিয়র ফেলোও ছিলেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লেখক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। তিনি অসংখ্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিনি বহু ভাষাবিদও ছিলেন। বাংলা এবং ইংরাজি ছাড়াও তিনি হিন্দী, ওড়িয়া, আসামিজ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, সংস্কৃত ও হিব্রু জানতেন। লেখক জীবনের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি বহু পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে সাহিত্য একাডেমী,২০০০ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার ছাড়াও কমল কুমারী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান প্রভৃতি বহু পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আশি। অথচ এই বিদগ্ধ মানুষটি যখন লিখতেন, তাঁর লেখায় এতটুকু পাণ্ডিত্য ফলাবার প্রয়াস দেখা যেত না।
বরং নিজেকে একজন এলোমেলো, বাউন্ডুলে, সব ভুলে যাওয়া, সব ব্যাপারে ভুল করে ফেলা অতি সাধারণ মানুষ হিসাবে তুলে ধরতেই পছন্দ করতেন। নিজেকে নিয়ে এভাবে মজা করতে তাঁর মত বোধহয় আর কেউ পারবে না।
রোজকার জীবনের ছোটখাট ঘটনা অসাধারণ কৌতুকে পরিবেশন করার কৌশলটিই নবনীতার লেখার ইউএসপি। তাঁর পাঠক মাত্রেই জানেন নিজের জীবন থেকে ছেনে নেওয়া সেইসব গল্পে কি অসাধারণভাবে তিনি বুনে দিয়েছেন হাস্যরস। অল্প বয়সী প্রফেসর আর তাঁর সদ্য বিবাহিত বউয়ের বিদেশে সংসার পাতার গল্প, বড় মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা, স্কুটার শেখা, মেয়ের বিয়ে প্রভৃতি ঘটনা ভোলার নয়। হায়দারাবাদের সেমিনার থেকে হঠাৎ কুম্ভমেলায় পৌঁছে যাওয়া, সেখানে তাঁবুতে থাকা, সেখানের মানুষজন, আর তাঁর তর্পণ, ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ লেখায় কি অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন কুম্ভমেলাকে! আর তাওয়াং ভ্রমণ নিয়ে লেখা তাঁর ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’ আমার পড়া অন্যতম সেরা ভ্রমণকাহিনী। ভুল ফ্লাইটে উঠে পড়া থেকে তাওয়াঙের বর্ণনা সবটাই অত্যন্ত সুখপাঠ্য আর তাঁর অসাধারণ লেখনীর যাদুতে জীবন্ত।
তিনি অবশ্যই নারীবাদী ছিলেন। কিন্তু তাঁর নারীবাদ কখনই উচ্চকিত নয়। তিনি ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলায় লেখা চন্দ্রাবতী দেবীর রামায়ন ইংরাজীতে অনুবাদ করেছিলেন। ‘সীতা থেকে শুরু’তে তিনি পৌরানিক সময় ও আধুনিক সময়ে মেয়েদের জীবন নিয়ে অসাধারণ সব গল্প লিখেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সই’ (বাংলার লেখিকাদের প্রতিষ্ঠান) আগামী ৩০শে নভেম্বর একুশ বছরে পা দেবে।
অনেকদিনধরেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন কিন্তু সেই অসুখ বিসুখকেও তাঁর থোড়াই কেয়ার। নাহলে ‘অলরাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইটে’র মত প্রবন্ধ লেখা যায়! আর তাঁর প্রাক্তন স্বামী অমর্ত্য সেন নোবেল পাওয়ার পর তাঁর লেখা ‘জরা হটকে জরা বাঁচকে ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’! এই রচনা বোধহয় একমাত্র নবনীতার পক্ষেই লেখা সম্ভব। জীবন নিয়ে কোন অভিযোগ নয়, কোন অসন্তোষ নয়, ভরপুর আনন্দে হাসি মজায় জীবন উদযাপন করার নাম নবনীতা দেব সেন। তাঁর অসামান্য মেধা এবং পাণ্ডিত্যকে ছাপিয়ে তিনি তাঁর পাঠকদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রয়াণে বাংলার পাঠক সমাজ শুধুমাত্র একজন সুলেখিকাকেই হারাল না একজন অভিভাবককেও হারাল। যেখানেই থাকুন আপনার অননুকরণীয় জীবনবোধ নিয়ে ভালো থাকবেন। আপনাকে শ্রদ্ধা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours