কেয়া ঘোষ, ফিচার রাইটার, আসানসোল:
গতকাল রাতেই ঘটে গেছে সেই অবশ্যম্ভাবী মর্মান্তিক ঘটনাটা।শ্রদ্ধেয়া সাহিত্যিক শ্রীমতী নবনীতা দেব সেন তাঁর নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করে অ-মর্ত্যলোকে পাড়ি দিয়েছেন। এখন হয়ত তাঁর শেষকৃত্যের তোড়জোড় চলছে।
খবরটা শোনার পর থেকেই অনেক কথাই হুড়মুড় করে মনে চলে আসছে। নবনীতা দি মানেই যেন একগাল হাসি, কখনো কলপ না করা এলোমেলো চুল, অনেক অনেক কথা গল্প আর অফুরন্ত ভালবাসা।বাবা ছিলেন সাহিত্যিক নরেন দেব আর মা সাহিত্যিক রাধারানী দেবী। এই দুয়ের সমন্বয় ছিলেন নবনীতা দি।মস্তবড় একটা হৃদয় ছিল তাঁর যেখানে বৃক্ষ থেকে তৃণগাছাটির প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা।
যেতে তো তাঁকে হতই। ক্যান্সার কিংবা বার্ধ্যক্য কেউই তাঁকে ছেড়ে কথা বলত না।তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাঁচার মত বেঁচেছিলেন।বুকে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে লেখার তাঁর পরিচিত অভ্যাস শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল কিনা আমার জানা নেই।
আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয় প্রায় বছর চল্লিশ আগে এক নরম সন্ধ্যায়।আমরা তখন লেডি ব্র্যাবোর্ণ কলেজে পড়ি।কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম দিকের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম আমরা দুই বন্ধু। সেই ব্যাপারেই আলোচনা করতে। এক আমি আর দ্বিতীয় জন নবনীতাদির কাকার মেয়ে আমাদের বন্ধু ইন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শ্রীহরি গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। "ভালবাসার বারান্দায় " যাকে তিনি ' মুন্নু' নামে সম্বোধন করেছেন।বড় আদরের বড় ভালবাসার বোন ছিল মুন্নু।অথচ ওদের মধ্যে কোন আত্মীয়তার সম্পর্কই ছিল না ছিল অদ্ভুত এক আত্মিক সম্পর্ক যা দুই পরিবারের মধ্যে আজ ও অটুট।
যে কথা বলছিলাম সেটা হল আমি ওনাদের বাড়ীতে ঢোকামাত্রই হৈ হৈ করে ওনার প্রথম সংলাপ ," আরে, ওকে তো একদম জয়া ভাদুড়ীর মত দেখতে,আমি ওকে মোটেই কেয়া বলব না, জয়া বলব"।সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরার জোরালো প্রতিবাদ "মোটেই না ওকে রেখার মত দেখতে "। আসল কারণটা ছিল আমি ওনার মতই বড় গোল টিপ পরি।
জয়া নাকি রেখা আসলে আমি কার মত দেখতে সেটা রহস্যই থেকে গেল তবে এরপর আমি যতবার ওনার বাড়ীতে গেছি উনি আমাকে জয়া বলেই ডেকেছেন, কেয়া নয়। অমর্ত সেন এবং নবনীতাদির বিচ্ছেদোত্তর বন্ধুত্ব সে যুগে ছিল এক বিরল নিদর্শন। কি অনায়াসে তিনি নিজেদের বৈবাহিক জীবনের সরস বর্ণনা দিতেন আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতাম। সেই হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকা কান্না ছিল কিনা সেটা সেই বয়সে বুঝতে পারি নি।
তখনো শ্রদ্ধেয়া রাধারানী দেবী জীবিত।গোলগাল ,নাদুসনুদুস ,সুন্দরী রাধারানী বিছানায় শুয়ে আছেন। কন্যা নবনীতা ছোট শিশুর মত তাঁকে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ রেখেছেন।মা হাসছেন মেয়ে দুলছেন এবং হাসছেন এবং হেসেই যাচ্ছেন।তাঁর সেই হাসি সমস্ত মুখ ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে তার বুকে এবং সমস্ত শরীরে। ছোট ছোট দুটি কন্যা এবং বৃদ্ধা মাকে নিয়ে একাকী নবনীতার সংসারে সদস্য সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কাজের লোক ছাড়াও ভালবাসায় থাকার আরো অনেক সদস্য ছিল।তারা সবাই বাইরের লোক হয়েও নবনীতাদির অন্তর জুড়ে তারাই ছিল আত্মার আত্মীয়।
ছোট বোন মুন্নুর কোলন ক্যান্সারে মৃত্যু ওনার মনকে অনেকখানি ভেঙে দিয়েছিল যেমনভাবে ভেঙে দিয়েছিল আমাদের তিন বন্ধুর হৃদয়।হয়ত বা সেদিন থেকেই ক্যান্সারের সঙ্গে তাঁর সত্যিকারের যুদ্ধটা শুরু হয়ে গিয়েছিল।কলকাতায় ইন্দিরার শোকসভা ওনার বাড়ীতেই হয়েছিল। আমরাও আমন্ত্রিত ছিলাম সেখানে।মুন্নুর আদরের খুকু দি এতক্ষণে হয়ত ওর কাছে পৌঁছে গেছে।
সেদিন কোন মোবাইল বা ক্যামেরা ছিল না যে সেদিনের সেই মুহুর্তটাকে বন্দী করে রাখতে পারতাম ।মনের ভেতরেই সযতনে রক্ষিত ছিল।কাল নবনীতা দেব সেনের মৃত্যু আমাকে ৪০ বছর আগের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।এ আমার একান্ত আত্মোপলব্ধির কথা।আদ্যন্ত জীবনমুখী,সদাহাস্যময়ী,সুরসিকা এক সাহিত্যিকের প্রয়ানে আমি গভীর ভাবে শোকাহত।সব ক্ষতি বোধহয় পূরণ হয় না। আর একজন নবনীতা ফিরে আসবেন না। নিজেকে নিয়ে রম্যরচনা লেখার জোর কি সবার থাকে? তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours