কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

জন্মদিন তো হয়েছেটা কী?
এতো লাফালাফি কিসের?
কখন বাজে বারোটা ! রাত বারোটা। আজ থেকে কাল। প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। সময় হলেই ধপাধপ মেসেজ। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ! পর্দায় ঘুরেফিরে হেলেদুলে খোদ ফেসবুকের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন।  হোয়াপ মেসেঞ্জার ফেসবুকে সে এক হইহই ব্যাপার। অতি উৎসাহীদের কেক, থালাভরা মিষ্টির ছবি। এও যেন এক রণক্ষেত্র।। আগে কেবা প্রাণ, করিবেক দান? হোয়াপ মেসেঞ্জারে মেসেজযুদ্ধ।
ব্যাস, মাঝরাতে ফুস ! মোবাইল কেলিয়ে আধখান। হ্যাংড।

সারা দুনিয়া জেনে গেল, আপনার ভুমিষ্ঠ হওয়ার শুভ সমাচার। মধ্যরাতের চার্চে ঘণ্টাধ্বনি যীশুর
জন্মক্ষণে। অতঃপর প্রভু ধরাধামে আবির্ভূত হইলেন! আপনার মোবাইলেও মেসেজের ঘণ্টা বারবার। কম যান না আপনিও। ইতিহাসটা জানলে ওই দিন বেহালা বা হৃদয়পুরে বসেও, নিজেকে মিশরের ফারাও বলেও ভাবতে অসুবিধা হতো না। সে প্রায় খ্রিষ্টজন্মের তিনহাজার বছর আগের কথা। তখন মামুলি লোকজনের জন্মদিন পালন হতো না।
তবে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনে ফারাওদের জন্মদিন উদযাপন হতো না। তা হতো মাথায় রাজমুকুট চড়ার দিনে। মনে করা হতো, সেদিন এক মানবসন্তান দেবসন্তানে পরিবর্তিত হলেন। আপনি সেরকমটাও ভাবতেই পারতেন বৈকি। আসছে বছর ফের জন্মদিন যাপনের সুযোগ পেলে 'ট্রাই' করবেন। নিজেকে যদি এক রাতের রাজা ভাবতে পারেন, মন্দ কী? কি ভাবছেন, ক্ষমতাই মানুষকে ঈশ্বরে প্রোমোশন দেয়?

আপনার পোড়া কপালে লেখা শুধুই হেনস্থা।
অফিসে বসের খেঁচানি। বাসে অন্যের পা মাড়ানোয় খিস্তি। মেট্রোর গুঁতো। অটোর লাইনে চাতকের প্রতীক্ষা। চিনি আনতে ভুলে যাওয়ায় গিন্নির হুমকি- কাল সকালে চা গিলতে চেয়ো, নোলায় গরমজল ঢেলে দোব। জন্মদিনের পূণ্যপ্রভাতে গিন্নির নির্মম উপহার। এসব শুনেটুনে, দু'চামচ জেলুসিল গলায় ঢেলে, বিছানায় শরীর রেখেছিলেন আমাদের নিত্যানন্দবাবু। শরীর আজও উসখুস করে। কিন্তু গিন্নি হিমশীতল। ছুঁতে গেলেই খিঁচুনি- ছাড়ো দেখি। মিনসের কিছু করার মুরোদ তো নেই। তবু হ্যাংলামি যায় না।

অফিসেই বার্থডে পার্টি। সৌজন্যে কুলিগগণ।
বেশ গাবদা কেকের আয়োজন। মিস মারুতি মোমবাতি গুঁজতে গুঁজতে মুচকি হাসি দিলো। "কটা মোমবাতি দেব সোমদা?" মোমের হিসেবে বয়সের হিসেব। মোম গলে আয়ুও গলে।
এরপর হেড়ে, মিনমিনে গলার ঐকতান বেজে ওঠে- হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ !
ফারাও থেকে সোজা ফুয়েরার- এর দেশে।
আপনার জন্য ওই গানটা আমদানি করা হয়েছিল হিটলারের দেশ জার্মান থেকে। তবে ওর যে ইংরেজি ভার্সানটা গাইলেন তা খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। ১৯৩৫ সালের।
কিন্তু এক জায়গায় মার খেয়ে গেলেন তো?  মোমগুলো এক ফুঁয়ে নেভাতে পারলেন না। নেভাতে পারলেই আজ রাতের বিছানায় গিন্নির আদর খেতেন। মনের ইচ্ছা পূরণ হতো এমনটাই বিশ্বাস জার্মানদের।
এরপরেই কেকের বুক চিড়ে ফেলা। কেকের বুকে ছুরি বসানোর রাস্তাও দেখিয়েছিল ওই জার্মানরাই। সেই ১৮৫৯ থেকেই কেকখুনের এই রেওয়াজ চলে আসছে।

- ট্রিটটা কবে এখনও কিন্তু জানতে পারলাম না বস।
- আরে বাবা বেতনটা হোক।
- আর তার আগেই যদি ডেঙ্গু হয়?
নিজের রসিকতাতে নিজেই হেসে উঠলো আরেক কুলিগ। কিন্তু মনটা কেমন যেন পাশ ফিরে শুলো বার্থডে বয়ের। এমন একটা শুভদিনে এমন অশুভ কথা। সবে তো উনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশ। প্লাস দাদামশাইয়ের হাতসাফাইয়ের 'দুই বা তিন'। স্কুলে ভর্তি করার সময় সাত- আটের নিত্যানন্দ সোমের বয়স লেখানো হয়েছিল পাঁচ। দিনক্ষণ সব হুবহু। সালটাকে একটু এগিয়ে আনা হয়েছিল, এই আর কী !
তা যাই হোক, আরেকটা কথাও নিত্যানন্দবাবু জানেন না। আগামী জন্মদিনে তিনি পেতে পারেন এক স্পেশার কেকের উপহার। তবে তারজন্য জন্মদিন পালন করতে হবে রোমে। পঞ্চাশ বছর পেরোলেই স্পেশাল কেকের উপহার পেতেন তিনি। তারজন্য অবশ্য থাকতে হতো দেশ রোমে। এ রেওয়াজ পোপের দেশের।

সত্যানন্দবাবুর মতো ছাপোষা মানুষদের জন্মদিন পালনের পথ দেখিয়েছিল রোম। তবে এই গোটা আয়োজনটাই বরাদ্দ ছিলো পুরুষদের জন্য। মেয়েদের জন্মদিন পালন শুরু হয় দ্বাদশ শতাব্দির পর। জন্মদিন পালনের এই প্রথা ক্রিশ্চানদের পাগান গোষ্ঠি থেকেই এসছিল বলে অনেকের ধারনা।
বাঙালি আন্তর্জাতিক। এই বার্থডে কেক আর মোমবাতির গোটা ব্যাপারটাই ধার করা গ্রিকদের থেকে। চাঁদপানা কেক আর মোমবাতি নিবেদন আসলে চন্দ্রদেব, 'আর্টেমি'কে তুষ্ট করা। কেক যেন মূর্তমান চাঁদ আর মোমের আলো চাঁদের আভা। তবে গ্রিকরাও আবার এই প্রথা ধার করেছিলো মিশর থেকে।

উনিশ শতকে বিত্তবান মার্কিনি প্রোটেস্টান্টরা বাচ্চাদের জন্মদিন পালন শুরু করে। বিংশ শতাব্দিতে সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই তা ছড়ায়। বার্থডে কার্ড পাঠানো শুরু হয় ইংল্যান্ডে। তাও প্রায় একশো বছর আগে। কার্ড পাঠিয়ে নেমন্তন্নতো করা হলো। কিন্তু খালি হাতে নেমন্তন্ন রক্ষা করা যায় নাকি? উপহার দেওয়ার কথা ভাবলো রোম। আবার এই উপহার দেওয়ার নেপথ্যে অন্য এক কারণও ছিলো। রোমানদের ধারণা ছিলো, উপহারের সম্ভার দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে বার্থডে বয়কে। তাহলেই সে রক্ষা পাবে আপদ- বিপদ, অশুভ আত্মার খপ্পর থেকে। আর এই গোটা ব্যাপারটা থেকে মুনাফা লুটতে জন্মদিনের কার্ড, উপহারের বাণিজ্যকরণ করে ফেলে আমেরিকা।

ছোটবেলায় এই দিনটাতে ঘরে একটু পূজাআচ্চার আসর বসতো। সত্যনারায়ণপূজা। আর সত্যনারায়ণপূজা মানেই সিন্নি। সে এক অপূর্ব জিনিস। সঙ্গে পাঁচমিশালি ফলের টুকরো। সেই প্রসাদ বাড়ি আর পড়শি পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়া। আর জন্মদিন মানেই ঠাকুরকে পরমান্ন নিবেদন। চিনি না, বাতাসা দিয়ে পায়েস। আর নতুন গুড় হলে তো কথাই নেই। সঙ্গে কিসমিস।
আজ সেসবের পাট চুকে গেছে। স্বাধীনতার উন্মাদনা কাটতেই ফের পেছনের দিকে এগিয়ে গেছে ভারত। "পেছন দিকে এগিয়ে যান।" সমানে বলে চলে মিনিবাসের কন্ডাক্টর। কেউ কোনদিন জানতে চাইলো না- তা ভাই পেছনদিকে আবার এগবো কিভাবে?
সত্যনারায়ণ ডকে উঠেছে। সিন্নি, পায়েস চুলোয় গেছে। এখন বার্থডে কেক। আর বিরিয়ানির ট্রিট। "কবে খাওয়াবি বল?" এখন আর কেউ বলে না। এখন 'ট্রিট'। অতি উৎসাহীদের আবার একটু রঙিন তরল নাহলে চলে না।

বয়সঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। অবিরাম। কলপ মেরে মাথার চুল কালো করা গেছে। কিন্তু ভেজা চুল আঁচড়াতে গেলেই মাথার খুলি উঁকি মারে। কপালটার বহর বেড়েছে, কিন্তু কপাল ফেরেনি। বছর তিনেক আগেও বিগ বি'র ফ্রেঞ্চ কাট ঝুলতো নিত্যানন্দ সোমের চিবুকে। সেখানে সাদা খাবলা বসাতেই ক্লিন শেভড। কিন্তু হাতের লোম ! বুকভর্তি লোম ! তাদের সামলায় কে?
ডাবল চিন আজ স্পষ্ট। কোমর আজ পূর্ব পাকিস্তান। মানচিত্র থেকে গায়েব। তার দখল নিয়েছে পেট। হাতপা ছড়িয়ে সে এখন ভুঁড়ি। রোজ আয়নার সামনে দাঁড়ান নিত্যানন্দ। আর ভাবেন, ঠাকুমা কেন এমন ফালতু নামটা রেখেছিল। মনে তো একটুও আনন্দ নেই। তবু সবাই ডাকে নিত্যানন্দ। সেই রাজা যযাতি কেস।
বুড়ো হয়ে রাজার মনখারাপ। ছেলের কাছে আবদার করে বসলো, "আমার বার্ধক্য নাও। আমার জড়া নাও। তোমার যৌবন আমায় দাও।" সুবোধ সন্তান শর্মিষ্ঠাপুত্র পুরু। বাপের আবদার রাখলো। পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম !
"মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।"

জন্মদিন মানেটা কী?
অঙ্কের খেলা। এক বছরের পরমায়ু শেষ। কেশববাবুর পাটিগনিতের চৌবাচ্চার অঙ্ক। কিন্তু এখানে একটাই নল। ভরা চৌবাচ্চার জল শুধু বেরিয়েই যায়। হড়হড় করে বেরোতে লাগলে ডাক্তার বদ্যি। নলের ফুঁটো মেরামত প্রভৃতি। জল বেরোয় প্রতি মুহূর্তে আর আমরা হাততালি দিই- আরেকটা জন্মদিন আসছে।
সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই ভুবন। আরও বিচিত্র এই জীবন।
জীবনের সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। টাকা জমা রাখার সুযোগ নেই। তুলতে পারেন। বাজে খরচও করতে পারেন। একদিনে অ্যাকাউন্ট খালি করে দিতেও পারেন। তবে 'হায় হায়' করার জন্য সেদিন আপনি আর থাকবেন না। শুভাকাঙ্খী থাকলে তারা নাহয় আপনার হয়ে, ওই 'হায় হায়' করে দেবে।

জীবন এগিয়ে চলে তার নিজের গতিতে। জীবনের সঞ্চয় থেকে খসে পড়ে আয়ু নামের একেকটি তাস। প্রতি মুহূর্তে। জীবনের লক্ষ সোজা এবং অচুক। মৃত্যু। পা পা হাঁটি হাঁটি করে সেদিকে অবিরত এগিয়ে চলা। তারপর একদিন শেষের সে মুহূর্ত। "জব শালা মর গয়া তো ম্যায়, ম্যায় হি নেহি !" আনন্দের সেই বিখ্যাত ডায়লগ। যেদিন মরে যাব, সেদিন তো আমি আর আমিই থাকবো না। আমি তখন সাদা চাদরে ঢাকা বডি। নাকে গোঁজা তুলো। দু'চোখ ঢাকা তুলসিপাতায়।
তখন জীবন থেকে অনেক দূরে। মানুষের মন থেকেও একটু একটু করে দূরে সরে যাওয়া। আগে ছিলেন ঘরে, বাথরুমে, বারান্দায়। আজ ঝুলছেন দেওয়ালে। ফটোর পেছনে ঝুল। আপনার পেছনে মাকড়সার সংসার। কারুর স্মৃতিতে রয়ে গেলেন নাকি? থাকতে পারেন। আবার নাও থাকতে পারেন।
"ভরা থাক স্মৃতিসুধায়, হৃদয়ের পাত্রখানি।"
স্মৃতির রংও ফিকে হয়ে আসে। স্মৃতির ছায়াও হয়ে আসে খাটো। ধুসর। জীবনমৃত্যু চক্র। ফেসবুকের পাতায়, টাইমলাইনে রয়ে যাবেন। আর আপডেট পড়বে না। আর সবুজ টিপ জ্বলজ্বল করবে না নামের পাশে।

অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন। সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত। বিশ্বটাই রঙ্গমঞ্চ। জীবনটাই নাটক। জন্মদিনে হাসো। মৃত্যুদিনে কাঁদার সুযোগ পাবে না। মধ্যভাগে অভিনয়।
"অল দ্য ওয়ার্ল্ড'স আ স্টেজ
অ্যানড অল দ্য মেন অ্যানড উইমেন মেয়ারলি প্লেয়ার্স !"
শেক্সপিয়ার সাহেবের কথা।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর ভয় পেলেও ভয়ের হাত থেকে পালানোর বিকল্প রাস্তা নেই। অগত্যা হাসো। মরণের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে হাসো। প্রতি বছর মাঝরাতে চিত্রগুপ্ত এসে যখন মৃত্যুর অ্যালার্ম বাজিয়ে যাবে, তখন হাসাটাই তো রীতি।
"ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায় .."
ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করো। ওই দেখ, ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁলো। পরমায়ুর একটা তাস সরিয়ে নিতে, চিত্রগুপ্ত চুপিচুপি ঘরে থাকলেই  তাকে জাপটে ধরো। বলো, "এখনও কয়েক ঘণ্টা বাকী স্যার।" বাংলার দিন শুরু সূর্যোদয়ের পরে।
ততক্ষণ তুমি, নিত্যানন্দবাবু উনপঞ্চাশেই। চিত্রগুপ্তকে বসাও। পায়েস বা কেক যাই হোক না কেন পেটপুরে খাওয়াও। জন্মদিনে অশুভ আত্মাকেও আমন্ত্রণ জানাতো গ্রিকরা। তাদের অন্ধকার দুনিয়ায় আলোর সন্ধান দিতে, জ্বালানো হতো মোমবাতি। এভাবেই বার্থডে বয়কে বাঁচানোর চেষ্টা করা হতো অশুভ আত্মার কোপ থেকে।
চিত্রগুপ্তের ভোজনপর্ব সমাধা হলে মাথা উঁচু করে দৃপ্ত কন্ঠে বলে দাও, "আজ আমার শেষ জন্মদিন হলেও হতে পারে। আমায় নিয়ে যেতে হলে সকালের অপেক্ষা করতেই হবে। তবু যেটুকু সময় বাঁচবো, বাঙালি হয়েই বাঁচবো।"
বাঙালি তার জন্মদিনের আদব কায়দা নিয়েই বাঁচবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours