গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

"মঙ্গলে ঊষা বুধে পা
যথা ইচ্ছা তথা যা"।                                          "যে না শোনে খনার বচন
সংসারে তার চির পচন"৷                                    এ সব ই খনার বচন, আজও ভিশন ভাবে প্রাসঙ্গিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু জনহিতকর সঙ্কেত লুকিয়ে আছে খনার  প্রতিটি ছড়ার মধ্যে।
সত্যিই এক কিংবদন্তী বিদুষী নারীর নাম 'খনা', তাকে নিয়ে অজস্র প্রচলিত কাহিনী ছড়িয়ে আছে আছে সারা বাংলা জুড়ে। খনার জন্ম বা বাসস্থান সম্পর্কে কিন্তু সঠিকভাবে তেমন কিছু তথ্য পাওয়া যায় না, তবে যেটুকু জানা যায়, 800 থেকে 1200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই বাংলাদেশেই তার আবির্ভাব ঘটেছিল। ধারণা করা হয় তাঁর বসবাস ছিল এই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলি গ্রামে। শোনা যায় তাঁর পিতার নাম ছিল অটনাচার্য। অটনাচার্যই যে খনার বাবা ছিলেন, এর ঐতিহাসিক ভাবে কোনো ভিত্তি নেই, শুধু খনার একটি বচনে 'অটনাচার্য' নামটির উল্লেখ আছে বলে, তাকেই খনার বাবা বলে অনুমান করা হয়। বচনটি অনেকটা এরকম:- “আমি অটনাচার্যের বেটি, গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি”                                                                এই ধারণা অনুসারেই মনে করা হয় খনা বেড়ে উঠেছিলেন রাজা ধর্মকেতুর আমলে, এই দেউলি এলাকার মাটি খনন করে বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শনও পাওয়া গেছে, তাই ধারণা করা হয় এই সব ধ্বংসাবশেষই রাজা ধর্মকেতুর রাজ্য, চন্দ্রকেতুর রাজত্বের   হারিয়ে যাওয়া কিছু নিদর্শন। স্থানীয় লোকেরা এখানে বেশ কিছু পাকা সমাধি বা ঢিবির মতো অংশ খুঁজে পান। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢিবির মধ্যে একটিকে খনার সমাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্থানীয় মানুষরা একে 'চন্দ্রকেতু গড়' এবং ‘খনা-মিহিরের ঢিবি’ বলেও জানে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে এখানে দীর্ঘ দিন ধরে খননের কাজ হয়েছে, বহু প্রাচীন পোড়া মাটির সামগ্রী, মূর্তি এবং নিত্যব্যবহার্য জিনিস উঠে এসেছে মাটির তলা থেকে, বহু জিনিস স্থানীয় এক সহৃদয় ব্যক্তির ব্যাক্তিগত সংগ্রহে রাখা আছে।
খনার বচন কেন এতদিন ধরে মানুষ মনে রেখেছে, খনার বচনে অসাধারণ এবং অতি সহজ ভাবে উঠে এসেছে সমাজের জন্য হিতোপদেশ, কোন কাজ কখন করলে ভালো হবে, কখন করলে খারাপ হবে, কোন পরিস্থিতিতে বা কি লক্ষণগুলো দেখলে বোঝা যাবে ঝড়, তুফান বা বন্যা হতে পারে, বিশেষ করে চাষবাস সংক্রান্ত নানান বিধিনিষেধ, যেমন কোন মাসে কোন ফসল ভালো হবে, কি ভাবে কোন ফসলের বীজ বপন করলে উত্তম ফসল হবে, কি ভাবে গাছ লাগালে ভালো ফল হবে ইত্যাদি নানান বিষয়ে অদ্ভুত সব প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে গেছিলেন খনা সেই প্রাচীনকালে, তার সহজ বচন বা ছড়ার মাধ্যমে।
কথিত আছে খনা ছিলেন সে যুগের একজন বিদুষী নারী, তার নামে এখনও বহু ছড়া বা বচন মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই খনার নাকি জিভটাই কেটে নেওয়া হয়েছিল তার বাগ্মিতার জন্য! তার স্বামী ও শ্বশুর মিলেই নাকি খনার জিভ কেটে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেনোই বা খনার এমন পরিণতি হয়েছিল, যদিও এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে, অনেকেই এই ঘটনাকে ভুল বা অতিরঞ্জিত গল্প মনে করে। তবু বিদুষী খনার জিব কেটে নেওয়ার প্রচলিত গল্পটা একটু শুনে নেওয়া যাক, খনার শ্বশুর বরাহ কাজ করতেন রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায়, খনার স্বামী মিহিরও একসময় পিতার সাথে যোগ দেন রাজসভায় কাজে এবং এরা দুজনেই জ্যোতিষবিদ্যায় যথেষ্ট  বুৎপত্তি ও খ্যাতি লাভ করেন। একদিন হঠাৎ তাদের গণনায় একটি সমস্যা দেখা দেয়, কোনোভাবেই সেই সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী পিতা-পুত্র। এমন অবস্থায় অতি সহজেই সেই সমস্যার সমাধান করে দেন লীলাবতী অর্থাৎ খনা। এই ঘটনায় রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রশস্তি লাভ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেছিলেন বিদুষী খনা। এতেই প্রমোদ গুনলেন তার স্বামী ও শ্বশুর, ভাবলেন এবার বোধহয় তাদের সভাসদের পদ চলে যাবে, তাদের জায়গা অধিকার করে নিতে পারে সামান্য এক নারী, তাদের আত্মসম্মান বোধে সাংঘাতিক আঘাত লাগলো, এরপর এই বিষয়ে খনার সাথে তাদের অনেক তর্কও হয়, কিন্তু একজন নারীর সঙ্গে তর্কে এঁটে উঠতে না পেরে এবং রাজার সভাসদের পদ হারানোর ভয়ে বরাহ অর্থাৎ খনার শ্বশুর তার পুত্র মিহির অর্থাৎ খনার স্বামীকে আদেশ দেন খনার  জিভ কেটে নেওয়ার জন্য, যাতে চিরকালের মতো খনার কথা বন্ধ হয়ে যায় আর বরাহ-মিহিরের আধিপত্য রাজসভায় বজায় থাকে! তারপরই স্বামী আর শ্বশুর মিলে খনার জিভটাই কেটে দেন, যেটুকু গল্প জানা যায়, ওই ক্ষতস্থান থেকেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে, আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই নাকি খনার মৃত্যু হয়। কথিত আছে, জিভ কেটে নেওয়ার আগে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন, যেন তাকে শেষবারের মত কিছু কথা বলতে দেওয়া হয়, কারণ জিভ কেটে নিলে সেই কথা গুলো আর কোনোদিন তার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না। খনাকে সেই অনুমতি দেওয়াও হয়েছিল, যতদূর জানা যায়, তখন কোনো একজন সেই সব কথাগুলো লিখে রেখেছিলেন বা কেউ শ্রুতিতে ধরে রেখেছিলেন, পরবর্তী কালে সেই কথা গুলোই 'খনার বচন' হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। খনা সম্পর্কে টিকটিকি নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত আছে, খনার জিভ যখন কাটা হয়, ঘটনাক্রমে সেই জিভের কর্তিত অংশ নাকি খেয়ে ফেলেছিল একটি টিকটিকি, ফলে সেই টিকটিকিও খনার জ্ঞান লাভ করে। সত্য-মিথ্যা যাইহোক বা অতিরঞ্জিত গল্পও মনে হতে পারে তবু আজও মনে করা হয়, মানুষের কোনো কথায় সত্যতা পেলে তাকে সমর্থন করে দেওয়াল থেকে 'টিক-টিক টিক-টিক' শব্দে ডেকে ওঠে  টিকটিকি অর্থাৎ ঠিক-ঠিক ঠিক-ঠিক...


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours