গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

মিরজাফর আর বিশ্বাসঘাতক এই দুটি শব্দ পৃথিবীর ইতিহাসে সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে, মিরজাফরের জীবনীর প্রতিটি পাতায় লেখা হয়ে আছে শুধু চক্রান্ত,শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। মিরজাফরের বীরত্বের কোনো কাহিনী ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না, সারাজীবনে তিনি একটি যুদ্ধেও তিন জয়লাভ করতে পারেননি! অথচ এক দিকে বাংলার মসনদ দখলের তিব্র লোভ আর অন্যদিকে তার চুড়ান্ত ব্যক্তিত্বহীনতা আর অক্ষমতা, ফলে তিনি ইংরেজদের উপর চুড়ান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন এটা তো সবাই জানে , আর ইংরেজদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসবার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা তার একেবারেই ছিল না। এমনকি সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের কারনে তার কুখ্যাতি বিখ্যাত, সেই ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ছাড়াও তাকে অনেকের সাহায্য নিতে হয়েছিল, এই ষড়যন্ত্রে তার প্রধান ও মুখ্য সঙ্গিনী ছিলেন ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ কুচক্রী নারী 'ঘষেটি বেগম' যার প্রকৃত নাম মেহেরুন্নেসা বেগম, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মৃত্যুর পর তার কপালে কিন্তু কবরের মাটি টুকু পর্যন্ত জোটেনি! এই ঘষেটি বেগমের। আজ এই ঘষেটি বেগমের ছোট্ট গল্প বা যেটুকু ইতিহাস থেকে জানা যায় সেই গল্প করবো:-
নবাব আলীবর্দী খাঁ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার নানা,  তার ছিল তিন কন্যা, তাদের নাম যথাক্রমে মেহেরুন্নেসা ওরফে ঘষেটি বেগম, মায়মুনা বেগম এবং সিরাজউদ্দৌলার মা আমেনা বেগম। অর্থাৎ  সম্পর্কে সিরাজের মাসি ছিলেন মিরজাফরের থেকেও ভয়ংকর এই নারী 'ঘষেটি বেগম। স্বামীর অকালে মৃত্যুর পর নিঃসন্তান ঘষেটি বেগম স্বাভাবিক ভাবেই স্বামীর অগাধ সম্পদের মালিক হন কিন্তু তাতে তার মন ভরেনি!  অন্দরমহলে সারাক্ষণ তার চক্রান্তের পাশাখেলা চলতেই থাকত। অত্যন্ত লোভী এই ঘষেটি বেগম সব সময়ই চেয়েছিলেন সিরাজ যাতে কিছুতেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব না হতে পারে। মেজ বোন মায়মুনা বেগমের পুত্র শওকত জং কে ই তার নবাব করার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, কারণটা খুবই পরিস্কার, শওকত ছিলেন প্রকৃতপক্ষে এক মেরুদণ্ডহীন ব্যাক্তি,  প্রায় সারা দিনই মদ্যপানের মধ্যে ডুবে থাকতো, বিচার বুদ্ধিহীন শওকত শুধুমাত্র তোয়াজে বিশ্বাস করত, তাই ঘষেটি বেগম বুঝতে পেরেছিলেন শওকতের ওপর প্রভাব বিস্তার করা তার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হবে, শওকত নবাব হলে তাকে পেছন থেকে চালনা করা তার জন্য সহজ কাজ হবে এবং যতোই মিরজাফর থাকুক শেষপর্যন্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তার হাতের মুঠোয় থাকবে! কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হাওয়ায় তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় নি, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হওয়া হয় নি   মায়মুনা বেগমের পুত্র শওকত জং এর ও।  আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর,তার ইচ্ছায় এবং তার অত্যন্ত প্রিয় সিরাজউদ্দৌলাই মসনদে বসেন। এই ব্যাপারটা ঘষেটি বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, আর তাই সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদ থেকে সরানোর সব রকম চেষ্টা আর চক্রান্ত শুরু করে দেন তখন থেকেই , এই উদ্দেশ্যেই ঘষেটি বেগম আর মিরজাফর অর্থাৎ দুই কুচক্রী একজোট হয়েছিলেন সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন জগত শেঠ।  সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসার পর থেকেই শওকত জং ক্রমশ নবাবের বিরোধীতা করতে শুরু করেন ঘষেটি বেগমের প্ররোচনায়। এমনকি শওকত জং পৌছে যান দিল্লির দরবারে, সম্রাট দ্বিতীয় আরওরঙ্গজেবের কাছে, তৎকালীন দুই কোটি রুপি ঘুষের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সম্রাট দ্বিতীয় আওরঙ্গজেবের কাজ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হওয়ার ফরমানও আদায় করে নেন। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিশ্বস্ত এবং সাহসী সেনানায়ক মহন লালকে পাঠান সৈন্য-সামন্ত সহকারে  পুর্নিয়ায়, রাজা শওকত জংকে শায়েস্তা করার জন্য, পলাশীর যুদ্ধের মাত্র আট মাস আগে 1756 এ মহন লাল ও সিরাজের সৈন্যদের হাতে শওকত জং মাতাল অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় ঘষেটি বেগমের ক্রোধ চরমে ওঠে, প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে তার মনে, এমনই এক প্রেক্ষাপটে  মীরজাফরের মাধ্যমে লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে গোপন হাত মেলান ঘষেটি বেগম, তার বিপুল সম্পত্তির আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে লর্ড ক্লাইভের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, মসনদের স্বপ্ন চোখে নিয়ে মিরজাফর আর  প্রতিহিংসার আগুন বুকে নিয়ে ঘষেটি বেগম শেষপর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে  নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতায় সফল হন। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে সেবারও নড়ে ছিল, মীর জাফর ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে হয়তো সামান্য কিছু সময়ের জন্য মসনদে বসেছিলেন কিন্তু ক্ষমতালোভী ঘষেটি বেগম যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা কার্যত পূরণ হয় নি এই ইংরেজদের ই কারনে, প্রতিশ্রুতি মতো অর্থ না দিতে পারায় ইংরেজদের প্রবল চাপে, ঘষেটি বেগমের সঙ্গে শেষপর্যন্ত চরম দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মীর জাফর এবং তার পুত্র মীর মিরন। এরপর ঘষেটি বেগমকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে, বন্দি দশায়ও ঘষেটি বেগম চুপ করে বসে থাকেন নি, শুরু করেন নতুন চক্রান্ত মীর জাফর এবং মিরনের বিরুদ্ধে। সেই খবর মিরনের কানে পৌছে যাওয়ার পর ক্ষিপ্ত মিরন বুঝতে পারেন ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে ঘষেটি বেগমকে ফেলে রাখলে ভবিষ্যতে আরও বড়ো বিপদ হতে পারে, তাই মিরন ঘষেটি বেগমকে বন্দী অবস্থায় নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে ফেরত আনার নির্দেশ দেন। নৌকা ঘষেটি বেগমকে নিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদ ছেড়ে রওনা হলেও  মুর্শিদাবাদে এসে পৌছোয়নি আর কোনো দিনও, মাঝ নদীতেই নৌকা ডুবে কুচক্রী ঘষেটি বেগমের সলিল সমাধি ঘটে বলে ধারণা করা হয়, যদিও এর মধ্যেও চক্রান্তের গন্ধ আছে! থাকাটাই স্বাভাবিক!  বাংলায় ইংরেজদের ডেকে এনে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে এতো নোংরা চক্রান্ত করেও শেষপর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকিনী ঘষেটি বেগমের কপালে কিন্তু মৃত্যুর পর সাড়ে তিন হাত মাটিও জোটেনি!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours