শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:  

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে অকিঞ্চিৎকর এই লেখকের শোকজ্ঞাপন ক'রে কিছু লেখা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমি তাঁর বন্ধুতালিকায় ছিলাম আর পাঁচজনের মতো। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব আমার পাঠানো অনুরোধ রেখেছেন, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। আসলে তাঁর মুখমন্ডলে আমার চোখ সবসময়ই স্নেহ খুঁজে পেয়েছে। চিরদিন মনে হয়েছে মারাত্মক ডানপিটে ছেলেটিকেও তিনি তাঁর স্নিগ্ধতায় শান্ত, স্থিতধী করে তুলতে পারেন এক লহমায়। তাছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পিতৃদেব যখন অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করছেন, তখন তিনিও অন্য বিভাগের ছাত্রী এবং পিতৃদেবের শিক্ষকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছেন অল্পদিনের মধ্যেই। তাই তাঁকে আগাগোড়াই ভীষণ আপন মনে হ'ত। এবাদেও তিনি ছিলেন নামী শিক্ষক। সরাসরি তাঁর মুখোমুখি বসে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাইনি তো কী হয়েছে? তিনি তো শিখিয়েছেন সবসময়- তাঁর লেখায়, তাঁর কথায়, তাঁর পাহাড়প্রমাণ কাজে। তাঁর মনন, ভাবনা ও মতামত আসলে এমন একজন ব্যক্তিত্বের মনন, ভাবনা ও মতামত যিনি আজীবন আমাদের মতো নিঃস্বদের সমৃদ্ধ করে তোলে। তাই 'পৃথিবীতে শূন্যস্থান থাকে না' মেনে নিয়েও, দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারি যে, সব শূন্যস্থান যথার্থভাবে ভরে না। ফাঁক পূরণে ফাঁকি রয়ে যায়। নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণেও সেই ফাঁক পূরণে ফাঁকি রয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস করি। 

টেলিভিশান, খবরের কাগজ, নিউজ পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে, নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর একমাত্র কন্যাসন্তান নবনীতা দেবসেনের  জন্ম ১৯৩৮ সালে কলকাতার হিন্দুস্থান রোডে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক নবনীতা দেবসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি পরবর্তীতে সামলেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগটি। এই ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত এবং তিনি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, নরেশ গুহ প্রমুখের যোগ্য উত্তরসূরি। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে হার্ভার্ড, ক্যালিফোর্নিয়া ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণা এই ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পড়িয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুপ্রাচীন ও বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়েও। পেয়েছিলেন রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলোশিপ। ধারে ও ভারে তাঁর সমকাল তো বটেই, উত্তরযুগেও তিনি ছিলেন অনন্যা। প্রখর মেধার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার মিলনে জন্ম নিয়েছিল এক অন্য নবনীতা দেবসেন, যিনি নিজেই ছিলেন নিজের পরিচয়। কারো পরিচয়ে তাঁকে বেঁচে থাকতে হয় নি।

১৯৫৯ সালে 'প্রথম প্রত্যয়` কাব্যগ্রন্থ দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস 'আমি অনুপম'। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৫৯ সাল ছিল তাঁর বিবাহের বছর, আর ১৯৭৬ সালে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা আশির ওপর। প্রতিটি গ্রন্থই নিজেদের মতো করে আলাদা। তবে 'মসিয়েঁ হুলোর হলিডে', 'করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে`, 'বামা-বোধিনী` তাঁর অসাধারণ প্রতিভার প্রামাণ্য দলিল বলেই মনে করি। 'দ্বিরাগমন', 'ভালো-বাসার বারান্দা', 'অভিজ্ঞান` ইত্যাদিতেও আমরা যেন অন্য নবনীতা দেবসেনকে পাই। শিশু সাহিত্যেও তাঁর পারদর্শিতা পাঠককূলকে বারবার মুগ্ধ করেছে। ভ্রমণ সাহিত্যেও তিনি এক নতুন দিক দেখিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি প্রবোধকুমার সান্যাল, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সাহিত্য-সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদের দ্বৈত ভূমিকায় তাঁকে ছাড়া যেন আর কাউকেই ভাবা যেত না। জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, রবীন্দ্র পুরস্কার ইত্যাদি কমিটির সদস্য হিসেবে যেমন দায়িত্ব সামলেছেন তেমনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। আবার দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ জি সি-এর সিনিয়র ফেলো হিসেবেও তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ফেলো হিসেবে ষোড়শ শতকের চন্দ্রাবতীর রামায়ণের টিকা-সহ ইংরেজি অনুবাদ তাঁর এই মেধার আর একটি পরিচয়। পাশাপাশি মহিলাদের জন্যও তাঁর নানাবিধ কাজ স্মরণযোগ্য। দিল্লির 'সেন্টার ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ'-এর ফেলো বা পশ্চিমবঙ্গ মহিলা লেখক আসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর কাজের মূল্যায়ন অবশ্যই আগামীদিনে বোঝা যাবে। আর তাঁর এইসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্মাননার পাশাপাশি সাহিত্য একাডেমি ও পদ্মশ্রী সম্মান প্রমান করে যে কতটা বড় মাপের প্রতিভা ছিলেন তিনি। অথচ তাঁকে দেখলে বা তাঁর সঙ্গে মিশলে কে বলবে যে, তিনি এতো বিদূষী ছিলেন! নিরহঙ্কার, মাটির মানুষ নবনীতা দেবসেন সকলের অনুরোধ রাখবার চেষ্টা করতেন। ফেরাতেন না কাউকেই। আসলে বড় হতে হলে এমনটাই হতে হয়। মনে রাখতে হবে যে, উচ্চতা বেশি হলে পতনের অভিঘাতটি বেশি হয়। কিন্তু সেই অভিঘাতকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায় যদি মাটির ওপর পা শক্ত করে আটকানো থাকে। নবনীতা দেবসেন তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রমান। তাঁর পাহাড়-প্রমান উচ্চতা কখনোই উদ্ধত মনে হত না, কেননা তাঁর বাঁধন ছিল মাটির সঙ্গে, সাধারণের সঙ্গে। তাঁকে স্পর্শ করা যেত, অকপটে বলা যেত অন্তরের কথা।  

বাংলা সাহিত্যের আর একজন কিংবদন্তির কালের নিয়মে এই চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হলেও, তা স্বীকার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে সাহিত্য জগতে কিংবদন্তি সৃষ্টি হওয়া সত্যি সমস্যার। সবকিছু বিকেন্দ্রীকরণের এই সময়ে সাহিত্যও আজ নানাভাবে টুকরো ও বহুমুখীন। এরকম একটি অবস্থা থেকে কোনো একজন সাহিত্যিক সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ভাবাটা বাতুলতা। বেড়ালেও তার কতটা গ্রহণযোগ্য ও কালজয়ী হচ্ছে বা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নবনীতা দেবসেনের  প্রয়াণ তাই সেদিক থেকেও এক অসহনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করল। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যজগৎ এক অসামান্য আলোকপ্রাপ্ত সাহিত্যিককে হারালো। 

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে শোকপ্রকাশ হোক অন্তরের, দেখনদারির নয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours