আহসান হাবিব, লেখক, বাংলাদেশ:


সাহিত্যের কাজ কারো পক্ষ নেয়া নয় । কারো মানে কোন শ্রেণির । সমাজে যা ঘটে তার নির্মোহ উন্মোচন এবং তাকে শিল্পিত রুপ দেয়াই সাহিত্যের কাজ । বিজ্ঞান যেমন বস্তুর সত্য উন্মোচন করে, সাহিত্যের কাজ সামজিক সম্পর্কের রুপ এবং তাঁদের লড়াই, অস্তিত্ব এবং সমস্ত আবেগীয় দিকের সত্যতা যতদূর সম্ভব ভাষার সাহায্যে রুপায়ন করাই সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য । একজন সাহিত্যিক সমাজের একজন সভ্য হয়েও তাকে সত্য উন্মোচনের খাতিরে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে হায় । তাকে কখনো দূরে কখনো কাছে ঘটনার মধ্যে উপস্থিত থেকে নিরীক্ষণ করতে হয় এবং যা ঘটে তা সাহিত্যে তুলে আনতে হয় । একটি ঘটনাকে একজন সাহিত্যিক তার মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণনা করতে পারেন না । কি হতে পারতো কিংবা কি হওয়া উচিত- এটা ভেবে নিয়ে সাহিত্যকে সাজানো যায় না । যদি তিনি কোন আদর্শের পক্ষে দাঁড়িয়ে সাহিত্য রচনা করেন, তাহলে তা বিকৃত হতে বাধ্য।

ঘটনাকে তুলে আনার পাশাপাশি একজন সাহিত্যিক মানুষের অবচেতনে জমে থাকা মনস্তত্ত্বের নানা রুপ তুলে আনেন, এই তুলে আনাও হতে হয় মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিকতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে । ঘটনার সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষের সম্পর্ক এবং তার প্রকাশ তার মনস্তত্ত্বকে উন্মোচন করে । একটি শ্রেণি বিভাজিত সমাজে যে কোন মানুষ একটি উৎপাদন সম্পর্কে যুক্ত এবং তার অবস্থানই তার মনস্তত্ত্ব নির্মাণ করে, এর বাইরে সে যেতে পারে না । একজন সাহিত্যিককে তাই সমাজবৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হয় যা দিয়ে তিনি গণমনস্তত্ত্বকে সঠিক ভাবে রুপায়ন করতে পারেন।

একজন সাহিত্যিকের শ্রেণি সচেতনতা বলতে শুধু নিজের শ্রেণি নয়, সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয় । নিজে হয়তো সামজতান্ত্রিক বিশ্বাসী কিন্তু তিনি যখন একজন বুর্জোয়ার চরিত্র অংকন করবেন, তখন তার কাজ তাকে শয়তান বা মুনাফাখোর বানানো নয় বরং তার কাজ তার চরিত্রটি ঠিক যে ভুমিকা পালন করে তা ফুটিয়ে তোলা। উৎপাদন ব্যবস্থার দিক থেকে একজন বুর্জোয়া শয়তানও নয়, একজন দেবতাও নয়, বরং পুঁজির যে চরিত্র তাকে বৈশিষ্ট্য দান করে, লোকটি ঠিক তাই । কিন্তু যদি তাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে একজন শয়তানরুপে দেখানো হয়, সেটা সত্যের বিকৃতি হয়ে দাঁড়ায় । একজন সাহিত্যিকের কাজ সত্য রুপ প্রতিষ্ঠা করা । পাঠক সেই সত্য রুপ থেকে ভাল কিংবা মন্দ, পক্ষ কিংবা বিপক্ষ বেছে নেবে । আমরা জানি একজন বুর্জোয়া পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মুল্য নিজের পকেটে পুরে, এই পুরে বলে একজন সাহিত্যক তাকে শয়তান বলতে পারবেন না, এটা বলবেন একজন শ্রেণি সচেতন পাঠক । পাঠককে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানোয় একজন সাহিত্যকের প্রধান দায়িত্ব।

একজন সাহিত্যিক বানিয়ে কোন চরিত্র নির্মাণ করতে পারেন না । যদি করেন তা ফ্যান্টাসি হয়ে দাঁড়াবে । পাঠক সেটা গ্রহণ করবে না, বরং তাকে সত্যের অপলাপ বলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে । একজন পাঠক কিন্তু সমাজের এই সত্যরুপগুলি সম্পর্কে অবহিত, কিন্তু সাহিত্যিকের মত রুপায়িত করতে পারে না, যখন এটি একজন সাহিত্যিকের দ্বারা রুপায়িত হয়ে পড়ে, সে আনন্দ লাভ করে দুই ভাবে, ভাষার ব্যবহারে এবং ঘটনার উন্মোচনের দক্ষতায় । কিন্তু পাঠক যদি ঘটনার সত্য রুপের ব্যতয় লক্ষ্য করে, বিরক্ত হয় এমনকি মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এটি সত্য । পাঠকের অবচেতনের সত্যটি কি, এটা নিজে না জানলেও যখন সাহিত্যিকের বর্ণনায় উঠে আসে, তার বিচ্যুতি ঠিক শনাক্ত করে ফেলে । সামাজিকভাবে আইডেন্টিটি প্রাপ্ত একজন মানুষ একটি ঘটনার মধ্যে কি ধরণের আচরণ করতে পারে, একজন সচেতন পাঠক তা ধরে ফেলতে সক্ষম । তাই একজন সাহিত্যিক যা রচনা করবেন তা সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দুই ভাবেই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে । পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব এবং পৃথিবীর যাবতীয় মিথে সৃষ্ট চরিত্রগুলি হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে কাল্পনিক ঘটনার জন্য নয়, টিকে আছে মনস্তাত্ত্বিক রুপের অসাধারণ সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।

একজন সাহিত্যিক কখনো রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারেন না, বরং রাজনীতির হাতে সমাজের সত্যকার রুপ তুলে ধরতে পারেন । এই রুপ মানুষকে একটি নির্দিষ্ট শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে তার অবস্থান নিতে সাহায্য করতে পারে । রাজনীতিবিদ তার পক্ষে থাকার আহ্বান জানাতে পারেন । কিন্তু সাহিত্যিক কখনো এই আহ্বান রাখতে পারেন না । একজন সাহিত্যিক কারো পক্ষেও নন, কারো বিপক্ষেও নন, তিনি শুধু সত্যের পক্ষে । রাজনীতি সত্য নিয়ে কাজ করে না, আদর্শ নিয়ে কাজ করে । এখানেই সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদের পার্থক্য । তার মানে এই নয় যে একজন সাহিত্যিক রাজনৈতিক ভাবে একটি পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না, পারেন, কিন্তু সেটা সাহিত্যে নয়, পারেন রাজনীতির মাঠে । একজন সাহিত্যিক তাই বুর্জোয়াও নন, সাম্যবাদীও নন, তিনি জীবনবাদী। সাহিত্যের কাজ কারো রাজনীতির পক্ষ হয়ে লড়াই করা নয় । আগেই বলেছি, বিজ্ঞানের যেমন বস্তুর সত্য বা তার ধর্ম উন্মোচন করা, সাহিত্যিকের কাজ সামাজিক ও মানসিক সত্য উন্মোচন করা।




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours