সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্রছাত্রীরা স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি ভেঙে এবং তাকে বিজেপির লোক বলে দেগে দিয়ে আর একবার প্রমাণ করল তারা এখনও কমিউনিস্ট, ভদ্রলোক নয়। বহু বছর আগে ঠিক যেমনটা দাবি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং ‘আপিলা চাপিলা’ নামক গ্রন্থের লেখক অশোক সেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হোস্টেলের ফি বাড়ানোর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মেজাজ ভালো ছিল না। প্রতিবাদ জানানোর জন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মামিদালা জগদীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে ছিল। দেখা না পেয়ে ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা উপাচার্যের নামে শ্লোগান দেয়, জগদীশ কুমার তুমি আমাদের ভিসি নও। জে এন ইউ ছেড়ে সঙ্ঘে চলে যাও। অভিযোগ, এদিনই বিকেলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের সামনে জওহরলাল নেহরুর মূর্তির উল্টোদিকে রাখা স্বামীজীর মূর্তি ভাঙা হয়। শুধু তাই নয়, মূর্তির বেদীতে ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা বিজেপিকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ লিখে রাখতেও পিছপা হয়নি। স্বামীজীকে বিজেপির লোক বলে দেগে দিয়ে তারা ফিরে যায় কমিউনিস্টদের ঢঙেই।
একে প্রতিবাদ বলা যায় কিনা সেই তর্কে গিয়ে লাভ নেই। কারণ প্রতিবাদের নামে দেশের বরেণ্য মহাপুরুষদের মূর্তি ভাঙার রাজনীতি বামপন্থীরা আজ নতুন করছে না। ধরে নেওয়া যেতে পারে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত আজকের বাম ছাত্রছাত্রীরা যথার্থই বাপ কা বেটা। ভারতবর্ষের জাতীয় গৌরবের প্রতিমূর্তি যারা তাদের অসম্মান করার অসুখ তারা পিতৃপুরুষের জিন থেকেই পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই অসুখের সূত্রপাত সত্তরের দশকে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাংশ ধার করে বলা যেতে পারে, সে বড়ো সুখের সময় নয়। সে সময় চীনা বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শুনে বাঙালি ছেলেমেয়েরা মুড়িমুড়কির মতো হয় মরত নয় মারত। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন অবশ্য ধোপে টেকেনি। উলটে কয়েক বছরের মধ্যে বিপ্লব হয়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত নয়তো গোষ্ঠীবদ্ধ বদলার ফিল্মি গপ্প। সে সময় আর একটা জিনিসও বাঙালি প্রত্যক্ষ করেছিল। মহাপুরুষদের মূর্তিভাঙা! বিদ্যাসাগরের মূর্তি একাধিকবার ভাঙা হয়েছে। মস্তকহীন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মূর্তিও দেখেছে কলকাতা। মূর্তিভাঙার যুক্তিটাও ছিল সাংঘাতিক। বাম নেতা সরোজ দত্ত বলতেন, বিদ্যাসাগর রামমোহন রায় এরা নাকি ব্রিটিশের পদলেহনকারী। সুতরাং মঙ্গল পাণ্ডে বীরসা মুন্ডা প্রমুখের মতো যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন তাদের মূর্তির পাশে এদের মূর্তি থাকতে পারে না। তা ছাড়া নবীনকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে নাকি প্রাচীনকে ধ্বংস করতে হয়। এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বাম নেতারাই বলতে পারেন। কারণ দেশের এবং দেশের মানুষের ভালোমন্দের কোনও দায় তাদের নেই। এই নেতারা একদিন চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান বলে আকাশ ফাটাতেন। এরাই যৌথ খামার গড়ার গোলাপি স্বপ্ন দেখিয়ে শ’য়ে শ’য়ে তাজা যুবককে অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। দেশভাগের সময় এদের মুখ থেকেই শোনা গিয়েছিল, পাকিস্তান মানতে হবে তবে ভারত স্বাধীন হবে। সুতরাং এদের উত্তরপুরুষেরা যে টুকরে টুকরে গ্যাঙের সদস্য হয়ে ভারত ভাঙার পরিকল্পনা করবে, স্বামীজীর মূর্তিকে কলংকিত করবে—তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
অস্তিত্ব এবং অস্মিতা ব্যতিরেকে কোনও জাতি টিকে থাকতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় ভারতবর্ষের জাতিসত্তার আধারস্বরূপ। এরা যখন আক্রান্ত হন, তখন ধরে নিতে হয় আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের জাতীয়তার ভিতটিকে দুর্বল করা। কখনও সন্ত্রাসবাদী আফজল গুরুর স্মরণসভা করে আবার কখনও স্বামীজীর মূর্তি ভেঙে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রছাত্রীরা সেই চেষ্টাই করে চলেছে। যাতে ভারতবর্ষ দুর্বল হয়। যাতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আবার ফিরে আসে কোনও নখদন্তহীন সরকার। যাতে দেশীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আশার কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যারা দেশের ভালো চান তারা সকলেই বুঝতে পেরেছেন এদের থামানো না গেলে ভারতবর্ষ ভেতরে ভেতরে দুর্বল হতেই থাকবে। কিছুতেই তার পচন এবং পতন রোধ করা যাবে না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours