গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

কালো সাহেবের মেয়ে কালো মেম 'ম্যারি অ্যান' যার সঙ্গে শেষপর্যন্ত বিয়েটা আর হয়নি অঞ্জন দত্তের গানে, কারন হয়তো সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছিল বলেই !
কলকাতার বৌবাজার থানার ঠিক পিছনেই পাঁচিলঘেরা এক টুকরো ছোট্ট খেলার মাঠ, আর তার মুখোমুখি লাল ইটের প্লাস্টার খসে যাওয়া কিছু বাড়ি, কলকাতার 'বো ব্যারাক', সাবেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিজের মহল্লা, দুটো ঘর সিঁড়ির তলা নিয়ে যেখানে আজও সেখানে ম্যারি অ্যানরা অর্থাৎ না ইংরেজ না ইন্ডিয়ান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বাস করে।
অনেকরই জানা নেই, অনেক দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যেও এরা কতো আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়, জম-জমাটি সন্ধ্যার আড্ডা-আসরে এক-একটা রঙিন দিন পার করে দেয়।
কলকাতার মধ্যেই আর এক মজাদার রঙিন কলকাতা এই 'বো ব্যারাক'। শোনা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে আমেরিকান সেনাদের বসবাসের জন্যই এই ব্যারাক তৈরী করা হয়।
এক সময় ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের গড়া এই জরাজীর্ণ বাড়িগুলো ভেঙে ফেলার কথাও হয়েছিল কিন্তু শেষমেশ ভাঙ্গা পড়েনি অতীতের স্মৃতি বিজড়িত ইট বেরিয়ে থাকা এই বাড়ী গুলো। বাড়িগুলো আছে বটে কিন্তু  কোনও সংস্কারের বালাই নেই। বাসিন্দাদের থেকে কেউ ভাড়া নেয় না, তাই সরকারি রক্ষণাবেক্ষণও নেই! আজও 'বো ব্যারাক' টিকে আছে কলকাতার ক্রমশ ক্ষীয়মান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এমন কসমোপলিটন মহল্লা কলকাতার আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।
ভাঙাচোরা লাল ইটের বাড়িগুলোয় এক কামরা, দু’কামরা বা তিন কামরার ছোট্ট ছোট্ট খুপরি ফ্ল্যাটে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটি পরিবারের বাস, এখানেই  কলকাতার অসংখ্য কালো সাহেব-মেমরা একসাথে গা-ঘেঁষাঘেষি করে বাস করে, তবুও কারও মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি নেই, যে যার মতো করে আছে, মোটের উপর 'বো ব্যারাকে' দিব্যি হাসিখুশি ফুর্তিতে আছে।
অঞ্জন দত্তের ‘বো ব্যারাক ফরেভার’-ছবিটা দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল, শুধুমাত্র উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের নামই বুঝি বো ব্যারাক, তাই হয়তো এখানকার বর্তমান বাসিন্দাদের অনেকেরই ছবিটা বিশেষ পছন্দ হয়নি! তবে হ্যাঁ সত্যিই অফুরন্ত আনন্দ আর রঙের প্রাচুর্য আছে এখানে। ক্রিসমাসের সময় কচিকাঁচা থেকে বুড়োবুড়ি সবাই মিলে সকাল থেকে রাত অবধি নাচ গান হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে, তাছাড়া বছর শেষের ডিনার-পার্টি তো আছেই। এছাড়াও বো ব্যারাকের সামনের ছোট্ট মাঠে গরম কালের ছুটির সময় চলে এক হকি প্রতিযোগিতায়। এছাড়া আছে জমজমাট রবিবারের বিকেল, চোখ জুড়োন মেরি-যিশুর মূর্তির সামনে ভিড় জমে যায়।                                                        এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ইতিহাসে একটু চোখ রাখি :- সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে যেসব ইংরেজ বণিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারতে আসতো, দেশে ফিরে যাবার পর তাদের অ্যাংলো-ভারতীয় নামে অভিহিত করা হতো। এদেরকে আবার 'পূর্ব ভারতীয়'ও বলা হতো এবং খুব ধনীদের বলা হতো 'নবাব'। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আবার এই পূর্ব ভারতীয়রা ছিল বেশ শক্তিশালী। অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন ইংরেজি সাহিত্যে এই ব্রিটিশ 'নবাবদের' উল্লেখ পাওয়া যায়।                          ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বরাবরই ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, এক পৃথক্ জনগোষ্ঠী, এরা প্রায় সবাই ব্রিটিশ পিতা ও ভারতীয় মাতার সন্তান। অথচ ভারতীয় বা ইংরেজ উভয়ের চোখেই এরা শংকরজাত বলে বরাবরই অবজ্ঞার পাত্র, এদের সঙ্গে কোনো রকম সামাজিক সম্পর্ক পরিহার করেই চলেছে ভারতীয়রা এমনকি ইংরেজরাও।
ইতিহাস বলছে স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ব্রিটিশ বা মুগল এই সমস্ত বিদেশীদের শাসনকালেই এই বিদেশীরা যে দেশেই বসতি স্থাপন করেছে সেখানেই অপরিহার্যভাবে সৃষ্টি হয়েছে  এই শংকর-সম্প্রদায়, আর বাংলাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। উনিশ শতকের একদম প্রথম দিকে যে সব ব্রিটিশ নাগরিক সামরিক বা বেসামরিক কর্তা কিম্বা ব্যবসায়ী বাংলায়  বসবাসের জন্য আসতো, তারা নিজেদের ভোগ-বিলাসী জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য অনেক সময়ই রক্ষিতা বা দাসী রাখতো, আবার এদের অনেকেই এদেশীয় মহিলাদের বিয়েও করে নিয়েছে, ধীরে ধীরে উনিশ শতকের শেষের দিকে এসে এদের বংশধররা বড় আকারের একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলে। এই সব বংশধরদের একটা অংশ মাঝে মাঝে শিক্ষার জন্য ব্রিটেনে পৌছেও যেতো কোনোভাবে, কিন্তু ব্রিটিশ সমাজ তাদের খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে তো দেখেই নি বরং যে কোনো অছিলায় লাঞ্ছিত করতে ছাড়তো না!   তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই তারা উপার্জন এবং পাকাপাকিভাবে বসবাসের জন্য নিজেদের জন্মভূমি অর্থাৎ ভারতবর্ষে ফিরে আসতো। এদেশে এসে এদের চাকরি পেতে বা বসবাস করতে কোনো অসুবিধাই হতো না, রেলওয়ে, শিপিং কম্পানি, নিম্নস্ত সরকারি চাকরি এবং প্রাইভেট মার্চেন্ট কম্পানিতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা সহজেই কাজ পেয়ে যেত। পরে তারা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক সংস্থায় ও চাকরি করতে শুরু করে।
বিশ শতকের প্রথম দশকের পর্যন্ত এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষদের  সামাজিক পরিচয়ের জন্য কোন আইনগত অধিকার ছিল না। তারা বর্ণসংকর, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান,  ইউরেশিয়ান, ইন্দো-ব্রিটন, ইত্যাদি নানান নামে পরিচিত হতো। 1911 সাল পর্যন্ত আদমশুমারিতে তাদের ইউরেশিয়ান হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে, ইউরেশিয়ান বলতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাড়াও ইউরোপীয়, মধ্যএশীয় এবং অন্যান্য এশীয় দেশের নাগরিকদেরও বোঝাত। শেষপর্যন্ত 1911 তে আদমশুমারির সময় ভারত  ও বাংলার তৎকালিন সরকার সরকারিভাবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচয়ের উল্লেখ করেন, সেই অনুযায়ী কোনো সন্তানের বাবা যদি ব্রিটিশ হয় আর মা যদি ভারতীয় হয় এবং সে যদি বাংলায় বসবাস করে তার পরিচয় হবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।  আজকের পরিস্থিতি যাইহোক না কেন কোনো এক সময়  অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা সংখ্যায় কম হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী আর আজও হাজার দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা নিয়েও মনের আনন্দে উচ্ছল-উজ্জ্বল।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours