কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
যাদের দেখে এই ঢপবাজি শেখা, এবার একটু সেই গুরুজনদের কথা বলি।
একশোর মধ্যে ষাটজন বড়োই দশ মিনিট পরপরই অন্তত একটা ঢপ মারেন। তবে কিছু নিপাট যুধিষ্ঠির আছেন। আবার অনেকের গুলতাপ্পি মারার সুযোগ, সুবিধাও কম। তবু গড়পরতার হিসেবে প্রতি বয়স্ক রোজ কমপক্ষে চারটি গুল মারেন। নইলে পেটের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে। মোচড় মারে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজদর্শনের অধ্যাপক এম ডিপাওলো'র মতে, নিছক দু-চারটা ঢপ মেরেই শান্তি পান না বয়স্করা। রোজ কমপক্ষে দুটো সাজানো গল্প শোনাতে পারলে তবেই স্বস্তি। ছয় থেকে সাতাত্তর বছরের লোকজনকে নিয়ে সমীক্ষায় তিনি দেখেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে গুলবাজির দক্ষতাও বাড়ে। তবে এদের মধ্যে সেরা আঠারো থেকে উনত্রিশেরা। একেবারে চ্যাম্পিয়ন। তবে পঁয়তাল্লিশের পর থেকে এই দক্ষতায় লাগে ভাটার টান।
গুল মারায় মহিলারা পিছিয়ে।
পুরুষরা যা ঢপের চপ দেয়, তার আধাও দিতে পারে না মহিলারা। এরমধ্যেও নারীপুরুষ বৈষম্য, বা পিতৃতন্ত্রের কলকাঠি নাড়া আছে কিনা কে জানে? এরপরের প্রশ্নটা হলো, পুরুষরা কোন ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ঢপ মারে? গবেষকরা বলেন, কথা দেওয়া আর ডেটিংয়ে কথার খেলাপ করায়।
তবে ঢপ কখনও একতরফা না। একেবারে গণতান্ত্রিক রীতি মেনেই ঢপের 'দেওয়া নেওয়া'। যারা ঢপ দিতে ভালবাসে, ঢপ খেতেও তেমনি ভালবাসে। তবে একটা ব্যাপার থাকে। কোন ঢপটা খাবে আর কোনটা উগরে দেবে, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত। পছন্দের ঢপ হলে তবেই হজম। ও নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা মানা। খবরকাগজ, নিউজ চ্যানেলের হাজারো খবর। আপনার অভিজ্ঞতাতেই হয়ত আপনি নিজেও জানেন কোন খবরটা সত্যি, আর কোনটা রং চড়ানো। তবু আপনি সেই খবরটাই বিশ্বাস করেন, যেটা আপনার পছন্দসই। তাতে যতই জল মেশানো থাকুক না কেন, চলবে।
আসলে অন্যের মুখে ঝাল খাওয়া। এটাই আমাদের অভ্যাস। তবে বাস্তবে ক্রমেই যেন সত্যমিথ্যার লক্ষণ রেখাটা ধুসর হয়ে আসছে। তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। এরজন্য কি হাজারো পরিসংখ্যান, সোশ্যাল মেডিয়া বা অন্য গণমাধ্যমগুলিই দায়ী? এর উত্তর আপাতত কালের গর্ভে।
তবে গুলবাজি, ঢপবাজি মানেই কিন্তু চাপ। যদি ঢপের বেলুন চুপসে যায়?
কিন্তু ওই যে কথা আছে, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলি কিন্তু মিথ্যার ঝড়ে অস্থির হয়ে ওঠে। ভীষন চঞ্চল হয়ে ওঠে মগজের 'প্রিফ্রন্টাল কোর্টেক্স'। তার নির্দিষ্ট কিছু অংশে বান ডাকে রক্তস্রোতের। অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে সেই অংশ। 'প্রসেসিং' করতে অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ব্রেনের 'এক্সিকিউটিভ পার্ট'। গবেষকরা জানাচ্ছেন, যখনই আপনি সাধুসম নির্বিকার বদনে সামনেরজনকে গুলপট্টি গেলাচ্ছেন, তখনই সবার অলক্ষ্যে আপনার মগজের তিন- তিনটি অংশ ভীষন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। প্রথমত, 'ফ্রন্টাল লোব' যা সত্যকে ধামাচাপা দেয়। এরপর 'লিম্বিক সিস্টেম' উদ্বেগে ভোগে। সবশেষে 'টেম্পোরাল লোব', যেখানে স্মৃতি মজুত থাকে।
ওদিকে সত্যের পথ সহজ সরল। কিন্তু সত্য বলেনটা কে?
যাকে নিয়ে আমাদের এত নাচানাচি, সেই সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরই বা শেষমেশ কী কান্ডটাই না করে বসলেন ! মাত্র একটা ঢপ। যা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো কুরুক্ষেত্রের মুখ।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যুদ্ধশেষের বাঁশি বাজিয়েছে রেফারি। জটিল অবস্থা যুদ্ধের। কৃষ্ণের কপালেও ভাঁজ। কী হয় কী হয় ! তিনি পান্ডব শিবিরে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিলেন, দ্রোনাচার্য নিধন জরুরি। ছলে বলে কৌশলে যে ভাবেই হোক। কোনও অপশন নেই। সুতরাং ছক কষা হলো। দ্রোনাচার্যের কাছে একটা ঢপ মারতে হবে- অশ্বত্থামা হত। কারণ গুরু দ্রোনের দুর্বলতার জায়গা ওই একটাই, পুত্র অশ্বত্থামা। যে কথা সেই কাজ।
সেই সন্ধ্যায় দ্রোনের শিবিরের কাছে উপস্থিত হলেন ভীম। চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন- "অশ্বত্থামাকে বধ করেছি।" চমকে উঠলেন দ্রোনাচার্য। একী খবর! পরমুহূর্তেই ভাবলেন, এ অসম্ভব। ভীমের সাধ্য কী অশ্বত্থামাকে মারার ! তবু বাপের মন তো !
ভরসা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির।
তাঁকে ডেকে সত্যমিথ্যা জানতে চাইলেন গুরু দ্রোন। মহা দোটানায় পড়ে গেলেন যুধিষ্ঠির। তেলের শিশি ভাঙ্গার কথা স্বীকার করলেই ভারত ভাগের কথা স্বীকার করা। নিজের ঘাড়ে দোষ নেওয়া। ঠিক সেরকম, সত্য বলা মানেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জেতা অনিশ্চিত করে তোলা। যুদ্ধ হারলে তার দায় নেওয়া। এমনি সাতপাঁচ ভেবে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির গুরু দ্রোনাচার্যকে বললেন- "অশ্বত্থামা হত ইতি গজ।" শেষের দুটি শব্দ চালাকি করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। কাজ হলো। প্রিয়পুত্রের চিন্তায় অস্থিরচিত্ত দ্রোনাচার্যের কানে শেষের দুটি শব্দ, "ইতি গজ" আদৌ কানে ঢুকলো না।
এক ঐতিহাসিক ছলকপট। ভয়ঙ্কর চাতুরি করে বসলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। শেষের দুটি শব্দ হাওয়ায় ভাসিয়ে অর্ধসত্য বললেন। অথবা সত্যের মোড়কে মিথ্যা। যা নিপাট মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
অর্ধসত্য কেন? কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অশ্বত্থামা সেদিন সত্যিই মারা গেছিল। তবে এই অশ্বত্থামা দ্রোনপুত্র ছিলো না। ছিলো এক গজরাজ। অবন্তির রাজা ইন্দ্রবর্মার সওয়ার হাতি। সেদিন যুদ্ধে ভীমের হাতে মারা পড়েছিল সেই গজ। আসল কথাটা চাপতে যুধিষ্ঠির 'ইতি গজ' শব্দবন্ধ এমনভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, যাতে তা দ্রোনের কানে না যায়।
দ্রোনাচার্য মারা যাওয়ার পর কুরুক্ষেত্র জেতার পথ সুগম হয়ে গেছিল পান্ডব শিবিরের কাছে। এতকিছুর পরেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ ! ওই যে আগেই বলেছি, ঢপ মারা ঢপ খাওয়া দুটোই মানবস্বভাব। শর্ত একটাই, পছন্দসই ঢপ চাই। তাহলে সব জেনেশুনেও টক করে ঢপ গিলে নেব। বত্রিশ পাটি বিকশিত করে ভোটের লাইনে দাঁড়াবো। কোনও ওজোর আপত্তি চলবে না।
কাজ হাসিল করতে ঢপবাজিতেই ভরসা রাখতেন স্বর্গবাসী দেবতারাও। খোদ বিষ্ণুদেবের কথা বলি। দেবতারা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরতেন সত্যের পূজারি, বীর বাহুবলীকে দেখে। একদিন তিনি স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে বসলেন। ক্ষমতা হারানোর ক্ষোভে, দুঃখে দিশাহারা হয়ে গেলেন দেবতারা। শুরু হলো ছক কষা।
বাহুবলীর সামনে পৌঁছে গেলেন বিষ্ণু। তবে গোপন করে গেলেন তাঁর পরিচয়। ছোট্টখাট্ট লিলিপুট, এক বামনের রূপ নিলেন দেব। আমরা তাঁকে চিনি 'বামন অবতার' নামে। প্রজাবৎসল বাহুবলীর কাছে সেই বামন এক টুকরো জমি চাইলেন। কথা হলো বামনরূপধারী বিষ্ণু তিন পা চলবেন। আর যতটুকু চলবেন, মহারাজ তাঁকে সেই জমিটুকুই দান করবেন। সম্মত হলেন উদারচেতা বাহুবলি। ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না, কতবড়ো মিথ্যার জালে ফাঁসতে চলেছেন তিনি।
এবার নিজের রূপ ধরলেন বিষ্ণু। এক পা চলেই দখল নিলেন মর্তের। আর দু'পা চলে স্বর্গ, মর্তের। বীর, সত্যনিষ্ঠ মহাবলীর হাতে রইলো পেনসিল। গোটাটাই ভন্ডামি আর মিথ্যার উপাখ্যান।
যুগ যুগ ধরেই ত্রিলোকে চলছে ঢপবাজির রাজ। ছলে বলে কৌশলে মতলব হাসিল। জেতাটাই শেষকথা। তা সে কুরুক্ষেত্র হোক অথবা ত্রিলোক, অথবা দিল্লির মসনদ।
জয় ঢপবাজির জয়।
যাদের দেখে এই ঢপবাজি শেখা, এবার একটু সেই গুরুজনদের কথা বলি।
একশোর মধ্যে ষাটজন বড়োই দশ মিনিট পরপরই অন্তত একটা ঢপ মারেন। তবে কিছু নিপাট যুধিষ্ঠির আছেন। আবার অনেকের গুলতাপ্পি মারার সুযোগ, সুবিধাও কম। তবু গড়পরতার হিসেবে প্রতি বয়স্ক রোজ কমপক্ষে চারটি গুল মারেন। নইলে পেটের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে। মোচড় মারে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজদর্শনের অধ্যাপক এম ডিপাওলো'র মতে, নিছক দু-চারটা ঢপ মেরেই শান্তি পান না বয়স্করা। রোজ কমপক্ষে দুটো সাজানো গল্প শোনাতে পারলে তবেই স্বস্তি। ছয় থেকে সাতাত্তর বছরের লোকজনকে নিয়ে সমীক্ষায় তিনি দেখেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে গুলবাজির দক্ষতাও বাড়ে। তবে এদের মধ্যে সেরা আঠারো থেকে উনত্রিশেরা। একেবারে চ্যাম্পিয়ন। তবে পঁয়তাল্লিশের পর থেকে এই দক্ষতায় লাগে ভাটার টান।
গুল মারায় মহিলারা পিছিয়ে।
পুরুষরা যা ঢপের চপ দেয়, তার আধাও দিতে পারে না মহিলারা। এরমধ্যেও নারীপুরুষ বৈষম্য, বা পিতৃতন্ত্রের কলকাঠি নাড়া আছে কিনা কে জানে? এরপরের প্রশ্নটা হলো, পুরুষরা কোন ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ঢপ মারে? গবেষকরা বলেন, কথা দেওয়া আর ডেটিংয়ে কথার খেলাপ করায়।
তবে ঢপ কখনও একতরফা না। একেবারে গণতান্ত্রিক রীতি মেনেই ঢপের 'দেওয়া নেওয়া'। যারা ঢপ দিতে ভালবাসে, ঢপ খেতেও তেমনি ভালবাসে। তবে একটা ব্যাপার থাকে। কোন ঢপটা খাবে আর কোনটা উগরে দেবে, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত। পছন্দের ঢপ হলে তবেই হজম। ও নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা মানা। খবরকাগজ, নিউজ চ্যানেলের হাজারো খবর। আপনার অভিজ্ঞতাতেই হয়ত আপনি নিজেও জানেন কোন খবরটা সত্যি, আর কোনটা রং চড়ানো। তবু আপনি সেই খবরটাই বিশ্বাস করেন, যেটা আপনার পছন্দসই। তাতে যতই জল মেশানো থাকুক না কেন, চলবে।
আসলে অন্যের মুখে ঝাল খাওয়া। এটাই আমাদের অভ্যাস। তবে বাস্তবে ক্রমেই যেন সত্যমিথ্যার লক্ষণ রেখাটা ধুসর হয়ে আসছে। তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। এরজন্য কি হাজারো পরিসংখ্যান, সোশ্যাল মেডিয়া বা অন্য গণমাধ্যমগুলিই দায়ী? এর উত্তর আপাতত কালের গর্ভে।
তবে গুলবাজি, ঢপবাজি মানেই কিন্তু চাপ। যদি ঢপের বেলুন চুপসে যায়?
কিন্তু ওই যে কথা আছে, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়াগুলি কিন্তু মিথ্যার ঝড়ে অস্থির হয়ে ওঠে। ভীষন চঞ্চল হয়ে ওঠে মগজের 'প্রিফ্রন্টাল কোর্টেক্স'। তার নির্দিষ্ট কিছু অংশে বান ডাকে রক্তস্রোতের। অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে সেই অংশ। 'প্রসেসিং' করতে অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ব্রেনের 'এক্সিকিউটিভ পার্ট'। গবেষকরা জানাচ্ছেন, যখনই আপনি সাধুসম নির্বিকার বদনে সামনেরজনকে গুলপট্টি গেলাচ্ছেন, তখনই সবার অলক্ষ্যে আপনার মগজের তিন- তিনটি অংশ ভীষন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। প্রথমত, 'ফ্রন্টাল লোব' যা সত্যকে ধামাচাপা দেয়। এরপর 'লিম্বিক সিস্টেম' উদ্বেগে ভোগে। সবশেষে 'টেম্পোরাল লোব', যেখানে স্মৃতি মজুত থাকে।
ওদিকে সত্যের পথ সহজ সরল। কিন্তু সত্য বলেনটা কে?
যাকে নিয়ে আমাদের এত নাচানাচি, সেই সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরই বা শেষমেশ কী কান্ডটাই না করে বসলেন ! মাত্র একটা ঢপ। যা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো কুরুক্ষেত্রের মুখ।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যুদ্ধশেষের বাঁশি বাজিয়েছে রেফারি। জটিল অবস্থা যুদ্ধের। কৃষ্ণের কপালেও ভাঁজ। কী হয় কী হয় ! তিনি পান্ডব শিবিরে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিলেন, দ্রোনাচার্য নিধন জরুরি। ছলে বলে কৌশলে যে ভাবেই হোক। কোনও অপশন নেই। সুতরাং ছক কষা হলো। দ্রোনাচার্যের কাছে একটা ঢপ মারতে হবে- অশ্বত্থামা হত। কারণ গুরু দ্রোনের দুর্বলতার জায়গা ওই একটাই, পুত্র অশ্বত্থামা। যে কথা সেই কাজ।
সেই সন্ধ্যায় দ্রোনের শিবিরের কাছে উপস্থিত হলেন ভীম। চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন- "অশ্বত্থামাকে বধ করেছি।" চমকে উঠলেন দ্রোনাচার্য। একী খবর! পরমুহূর্তেই ভাবলেন, এ অসম্ভব। ভীমের সাধ্য কী অশ্বত্থামাকে মারার ! তবু বাপের মন তো !
ভরসা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির।
তাঁকে ডেকে সত্যমিথ্যা জানতে চাইলেন গুরু দ্রোন। মহা দোটানায় পড়ে গেলেন যুধিষ্ঠির। তেলের শিশি ভাঙ্গার কথা স্বীকার করলেই ভারত ভাগের কথা স্বীকার করা। নিজের ঘাড়ে দোষ নেওয়া। ঠিক সেরকম, সত্য বলা মানেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জেতা অনিশ্চিত করে তোলা। যুদ্ধ হারলে তার দায় নেওয়া। এমনি সাতপাঁচ ভেবে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির গুরু দ্রোনাচার্যকে বললেন- "অশ্বত্থামা হত ইতি গজ।" শেষের দুটি শব্দ চালাকি করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। কাজ হলো। প্রিয়পুত্রের চিন্তায় অস্থিরচিত্ত দ্রোনাচার্যের কানে শেষের দুটি শব্দ, "ইতি গজ" আদৌ কানে ঢুকলো না।
এক ঐতিহাসিক ছলকপট। ভয়ঙ্কর চাতুরি করে বসলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। শেষের দুটি শব্দ হাওয়ায় ভাসিয়ে অর্ধসত্য বললেন। অথবা সত্যের মোড়কে মিথ্যা। যা নিপাট মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
অর্ধসত্য কেন? কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অশ্বত্থামা সেদিন সত্যিই মারা গেছিল। তবে এই অশ্বত্থামা দ্রোনপুত্র ছিলো না। ছিলো এক গজরাজ। অবন্তির রাজা ইন্দ্রবর্মার সওয়ার হাতি। সেদিন যুদ্ধে ভীমের হাতে মারা পড়েছিল সেই গজ। আসল কথাটা চাপতে যুধিষ্ঠির 'ইতি গজ' শব্দবন্ধ এমনভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, যাতে তা দ্রোনের কানে না যায়।
দ্রোনাচার্য মারা যাওয়ার পর কুরুক্ষেত্র জেতার পথ সুগম হয়ে গেছিল পান্ডব শিবিরের কাছে। এতকিছুর পরেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ ! ওই যে আগেই বলেছি, ঢপ মারা ঢপ খাওয়া দুটোই মানবস্বভাব। শর্ত একটাই, পছন্দসই ঢপ চাই। তাহলে সব জেনেশুনেও টক করে ঢপ গিলে নেব। বত্রিশ পাটি বিকশিত করে ভোটের লাইনে দাঁড়াবো। কোনও ওজোর আপত্তি চলবে না।
কাজ হাসিল করতে ঢপবাজিতেই ভরসা রাখতেন স্বর্গবাসী দেবতারাও। খোদ বিষ্ণুদেবের কথা বলি। দেবতারা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরতেন সত্যের পূজারি, বীর বাহুবলীকে দেখে। একদিন তিনি স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে বসলেন। ক্ষমতা হারানোর ক্ষোভে, দুঃখে দিশাহারা হয়ে গেলেন দেবতারা। শুরু হলো ছক কষা।
বাহুবলীর সামনে পৌঁছে গেলেন বিষ্ণু। তবে গোপন করে গেলেন তাঁর পরিচয়। ছোট্টখাট্ট লিলিপুট, এক বামনের রূপ নিলেন দেব। আমরা তাঁকে চিনি 'বামন অবতার' নামে। প্রজাবৎসল বাহুবলীর কাছে সেই বামন এক টুকরো জমি চাইলেন। কথা হলো বামনরূপধারী বিষ্ণু তিন পা চলবেন। আর যতটুকু চলবেন, মহারাজ তাঁকে সেই জমিটুকুই দান করবেন। সম্মত হলেন উদারচেতা বাহুবলি। ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না, কতবড়ো মিথ্যার জালে ফাঁসতে চলেছেন তিনি।
এবার নিজের রূপ ধরলেন বিষ্ণু। এক পা চলেই দখল নিলেন মর্তের। আর দু'পা চলে স্বর্গ, মর্তের। বীর, সত্যনিষ্ঠ মহাবলীর হাতে রইলো পেনসিল। গোটাটাই ভন্ডামি আর মিথ্যার উপাখ্যান।
যুগ যুগ ধরেই ত্রিলোকে চলছে ঢপবাজির রাজ। ছলে বলে কৌশলে মতলব হাসিল। জেতাটাই শেষকথা। তা সে কুরুক্ষেত্র হোক অথবা ত্রিলোক, অথবা দিল্লির মসনদ।
জয় ঢপবাজির জয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours