কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
নারী স্বাধীনতা নিয়ে কোনদিন কি খুব হইচই বাঁধিয়েছিলেন?
মনে হয় না। অন্তত আমার জানা নেই। অথচ নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের প্রাক্তনি। কিন্তু তাঁর পরিচয়ে কোথাও প্রাক্তনের নামটা দরকার হয়নি। তিনি নিজেই নিজের পরিচয়। স্বয়ংসম্পূর্ণা। নবনীতা।
নির্ভেজাল নারীর দৃষ্টিতেই দেখতে চেয়েছিলেন পুরুষকে। রেয়াত করেননি পুরুষশ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রকেও। তবে গায়ের জোর বা মনগড়া কোনও আলট্রা মডার্ন ইউটোপিয়ায় নয়। সীতার চোখ দিয়েই দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী রামচন্দ্রকে। নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন রামকথা নিয়ে। তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির অন্যতম 'চন্দ্রাবতী রামায়ণ'। তাই তাঁর কাজ নিয়ে কোনদিন হইচই বাঁধেনি। চমক না, শিক্ষাদীক্ষার অহঙ্কারও না। তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতো এক দরদী নারীর স্নেহের ফল্গুধারা। এখানেই অনন্য নবনীতা দেবসেন।
"বড্ড জ্বালাতো আমার দুই মেয়ে," এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন নবনীতা দেবসেন। "রাত হলেই বায়না ধরতো গল্প শোনানোর।" বাংলার সেই পরীরা উড়ে আসতো দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান রোডের, 'ভাল-বাসা'র সেই ঘরে। তাদের গল্পই অন্তরা, নন্দনাকে শোনাত মা নবনীতা। আর সেই গল্পই তিনি শেয়ার করে নিতেন বাংলার ঘরে ঘরে গল্প শোনানোর জেদ ধরে বসে থাকা হাজারো মেয়েকে।
শিশু, কিশোরীদের জন্য লেখা সেই গল্পের মেয়েরা হতো লেখিকার মতোই অকুতোভয়, সাহসী। চালাক মিষ্টি মেয়ের দল। আর পরীরাও হতো বন্ধুর মতো। কোনও বাড়াবাড়ি ছিলো না কোথাও। সব জায়গায় 'হ্যাপি এন্ডিং'। উত্তেজনাহীন। যাঁরা তাঁকে সামনে থেকে চিনতেন, বলতেন চিরকিশোরী নবনীতা। ছিলেন প্রতিবাদী। তবে কোনও তথাকথিত ঝাঁজ থাকতো না সেই প্রতিবাদে। জীবনের সামনেও আয়ুভিক্ষায় হাঁটু গেড়ে বসেননি তিনি। "আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি !" ক্যানসারের জুজুকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন।
ক্যানসারের খবর শুনে প্রিয় লেখিকাকে দেখতে আসা কোনও অনুরাগীকে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়াতে দেখলেই খিলখিল করে হেসে উঠতেন একাশির কিশোরী নবনীতা। কিছুদিন আগেই, বাংলার এক প্রথম শ্রেণির দৈনিকে ভারী সুন্দর এক কথা বলেছিলেন তিনি- "আমার তো হৃৎকমল থেকে শ্বাসকমল- সব দরজাই আধখোলা। তো এই কর্কটকমলের এত মাতব্বরি কিসের? লাঠিসোঁটা একটু বেশি আছে বলে?" তবে জীবনের শেষদিকে, নবনীতার সেই হাসিতে ক্লান্ত বেহাগের সুর শুনতে পেতেন অনুরাগীরা।
বাবা নরেন্দ্রনাথ দেব, মা রাধারানি, দুজনেই সাহিত্য জগতের মানুষ। শিল্প সংস্কৃতির সেই ধারাই বয়ে গেছিল মেয়ে নবনীতার মধ্যেও। প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা। পরে বিদেশে পড়াশোনা, অধ্যাপনাও। বিষয় ছিল তুলনামূলক সাহিত্য। দেশে ফিরে নবনীতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে ছাত্রছাত্রীদের 'ম্যাডাম'। বাইরে আবদারের দিদি। মাতৃসমা অধ্যাপিকা।
বয়স যখন মাত্র কুড়ি একুশ, তখনই বিয়েটা সেরে ফেলেছিলেন। পাত্র অমর্ত্য সেন। কিন্তু টিকলো না সেই বিয়ে। ষোল সতেরো বছর ঘর করার পর অবশেষে, দুজনের মধ্যে উঠলো দেওয়াল। শুরু হলো জীবনের আরেক লড়াই।
দীর্ঘমেয়াদি লড়াই চালিয়েছিলেন অসুস্থতার সঙ্গেও। কোনও আপোষে যাননি নবনীতা। লিখে ফেলেছেন আশিখানা বই। উপন্যাস থেকে নিয়ে কবিতা, সংবাদপত্রের কলাম থেকে নিয়ে ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য। সবেতেই তিনি বন্দিত। স্বীকৃতিতে মিলেছিলো পদ্মশ্রী, সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড।
কেমন ছিল তাঁর অসীম প্রাণশক্তি?
"মনে হতো যেন ডায়নামোর পাশে বসে আছি," বলেছিলেন লেখকবন্ধু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কথাটা যে কতদূর সত্যি তা বুঝেছিলাম বহুদিন আগের এক অভিজ্ঞতায়। আজ আর সাল, তারিখ মনে নেই। স্মৃতিও ধূসর এতদিন পরে। কলকাতার এক বাংলা দৈনিকে তখন ছবি আঁকি। রবিবারের পাতায় নবনীতা লিখেছিলেন রাস্তাঘাটে, রোজনামচার জীবনে মেয়েদের হেনস্থার শিকার হওয়া নিয়ে। "দ্রৌপদী সভাগৃহে একা"। একটা চাপ কাজ করছিলো আমার মধ্যে। বয়স, অভিজ্ঞতা সবদিক থেকেই অনেকখানি পিছিয়ে আমি। এক প্রতিষ্ঠিত লেখিকার শব্দকে চিত্ররূপ দেওয়া। সেই চাপ কেটে গেছিলো নবনীতা দেবসেনের সহজ সরল, মজলিশি কথাবার্তায়। এমনকি পরে যখন শুনলাম ছবি তাঁর পছন্দ হয়েছিলো, সেতো এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
শেষদিকে হাসপাতালে দেখা যেত তাঁকে। চোখের চিকিৎসা করাতে যেতেন। প্রবীণা নবনীতা মেয়ের হাত ধরে যেতেন। সময় ছোবল বসিয়েছিল শরীরে। মন অক্ষত। তখনও সতেজ। হয়ত চিরসবুজও।
শ্বাসকষ্টেও ভুগতেন। দিন দশ বারো ক্যানসারের দাপট গেছিল বেড়ে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পরবাসে পাড়ি দিলেন নবনীতা। সেখানেই হয়ত এবার সুনীল, শক্তি, সমরেশের সঙ্গে নরক গুলজার করবেন সবার ভালবাসার মানুষ, একাশির নবনীতা দেবসেন।
মাসখানেক আগেও বলেছিলেন, "এখনই চলে যাব না।"
"কেউ কথা রাখেনি !"
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার আনন্দবাজার পত্রিকা)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours