কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

দ্য ব্লু লেগুন। ১৯৮০ এর রিলিজড।
সাউথ প্যাসিফিকের এক নির্জন দ্বীপ। এক কিশোর কিশোরীর বেড়ে ওঠার গল্প। বেড়ে উঠছে তাদের শরীর, মন। শরীর বদলে যাওয়ার অপার বিস্ময়। যৌনতার প্রথম স্বাদ। নিখুঁত ডিটেলস। তবে তারচেয়েও বেশি আকর্ষণ, চোদ্দ বছরের ব্রুক শিল্ডসের কচি শরীর। টপলেস। কিশোরীর নগ্ন শরীর। আর তখন বলিউড থেমে আছে জিনাত আমনের যৌবনে। রাজ কপুরের 'সত্যম শিবম সুন্দরম'(১৯৬৮)। সর্বক্ষণ শাড়ির ফাঁকফোকর খুঁজতে ব্যস্ত ক্যামেরা। সাইড থেকে বুকের এক ঝলক যদি দেখানো যায়। তাতেই সারা দেশজুড়ে ঝড়। উসখুস সেন্সর বোর্ডের কাঁচি। তাই ক্যামেরাও আটকে থাকতো রেখা রাখীর ক্লিভেজে।
সত্তর শেষ হয়ে তখন আশির দশক শুরু। পঁচাশিতে একটু চালাকি করলেন রাজ কপুর। মন্দাকিনীর বুক দেখাতে এক অজুহাত খাড়া করলেন। পর্দায় নায়িকাকে দেখা গেল, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে। নইলে বলিউডে তখন রাজেশ খান্না শর্মিলা ঠাকুর গা ঘেঁষাঘেঁষি করলেই আমদানি হতো প্রজাপতি। ফুলে বসে মধু খেতো।
প্রজাপতির বদলে হিরো হিরোইনের মধু খাওয়া-খাওয়ি দেখতেই হলিউড মুভি।

হলে আলোটা নিভলে ঢুকতাম। কোথায় কে বসে আছে কে জানে ! কোন দাদা বা কোন কাকা। সে এক ভীষণ সুরসুরি। হলিউড মুভি। বিদেশি সিনেমা বলে কথা। হট সিন। হিন্দি সিনেমার দৌড় তখন ওই 'রূপ তেরা মস্তানা' পর্যন্ত। বা 'কভি কভি'র 'সুহাগ রাত হ্যায়, ঘুঙ্ঘট উঠা রহা হুঁ ম্যায়'। ব্যাস জাম্প কাট শট।

সেখানে হলিউড অনেক দুরন্ত। 'লভ সিনস', 'এরোটিক গেমস'- এর বেপরোয়া সব দৃশ্য। সোহাগ রাত- টাত লাগতো না। ইচ্ছে করলেই হতো ! যখন তখন চকাস- চুকুস চুমু। রগরগে বেড সিন। লাইট- টাইট নিভতো না। পর্দার সামনের দিক থেকে সিটির ঝড়। আর পেছন দিকের দর্শকজন চাপা উত্তেজনায় থরথর। পাশে বসা সঙ্গিনীর আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে চেপে ধরতো সঙ্গী। সঙ্গিনীর হাতের চেটো তখন ঘামে জবজবে।
আর হিরোইনদের ড্রেস। যত না লুকতো, তারচে' বেশি দেখাতো। আর সেই দেখতেই আমরা ভাইপোরা কোন ছার, কাকুরাও লোভী চকচকে চোখে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম। হয়তো বা কারও নালও গড়াতো। তবে অন্ধকার হলে তা চোখে পড়তো না। মুশকিল হতো সিনেমা হলে কাকু ভাইপোরা মুখোমুখী হয়ে গেলে। কাকু এমন ভাব করতো, যেন হলে ঘুরতে এসছেন। অথবা 'জয় সন্তোষী মা'য়ের শো কটায় জানতে এসছেন। আর ভাইপোরা চটজলদি অন্যদিকে কেটে পড়তো। চোখাচোখী হলেও কেউ কাউকে চিনতো পারতো না। এও এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

কলকাতায় বিদেশি সিনেমার নিয়মিত বা দু- তিনটে শো হলেও, মফস্বলে তা হতো না। মর্নিং শো বরাদ্দ ছিলো হলিউডি মুভির জন্য। বাদবাকী রেগুলার ম্যাটিনি ইভনিং নাইট শোয়ে হিন্দি। আবার কোথাও ম্যাটিনি ইভনিংয়ে বাংলা। অনেক জায়গায় আবার নাইট শোতে দেখানো হতো দক্ষিণী সিনেমা। হিন্দিতে বিচ্ছিরি রকমের ডাব। হান্টারওয়ালি, রাত কা চামেলি। সরাসরি যৌনদৃশ্য না থাকলেও ঠারেঠোরে যৌনতার সুরসুরিতে ভরপুর। সবকিছুই মোটাদাগের।
এরপর শুরু হলো এক চালাকি। সিনেমায় ভেজাল।

হলিউডের সিনেমাগুলির হট সিন বাদ পড়তো সেন্সরশিপের শাসনে। বেশকিছু হলে ওই বাদপড়া জায়গাগুলিতে কায়দা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো পর্নোর 'খুল্লম খুল্লা' যৌনদৃশ্য। হিরো, হিরোইন বিছানায় গেল। শুরু হলো আদর। আর তারপর ঘটনার জল যেদিকে গড়াবার সেদিকেই গড়াল। পর্দায় হিরোইনের অর্গাজমে ব্যস্ত হিরো। আর পর্দার এপারে যৌন আবেগে হাবুডুবু কাকা ভাইপো সবাই। যৌনতার নেশায় তখন চোখে এরকম রং ধরেছে যে কারা যৌনতা করছে তা আর চোখে পড়তো না। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখতেন, হিরো হিরোইনের চেহারা বদলে যেত। তাতে অবশ্য আর কী যায় আসে? কাকা ভাইপোরা তো হিরো হিরোইনের চেহারা দেখতে যেতো না। যা দেখতে যেত, সেই যৌনতার আয়োজনে ঘাটতি না পড়লেই হতো। এসব কাণ্ডবাণ্ডর জন্য হামেশাই হলে পুলিসহানার খবরও মিলতো।

তবে শুধুই যে সেক্সের জন্য হলিউড মুভি হল কাঁপাতো তা বললে মিথ্যে বলা হবে। 'ব্ল্যাক অ্যাঞ্জেল', 'স্টার ওয়ার্স', আবার 'দ্য স্পাই হু লভড মি'র মতো নানারকম অদ্ভুত সব গল্প নিয়ে তৈরি হতো সেসব সিনেমা। সায়েন্স ফিকশন, হরর, অ্যাকশন মুভিও বেশ ভিড় টানতো। 'জস', 'টিনটোরিরা', 'দ্য ইভিলস ডেথ', 'টাইটানিক'- এর মতো যৌন উত্তেজনাবিহীন মুভিও সে সময় ঝড় তুলেছিল। বলিউড তখনও গোলগোল চক্কর মেরে চলেছে, হিরো হিরোইন ভিলেন আর ছিচকাঁদুনে চিরদুঃখী মায়ের ফর্মূলায়। আর টলিউডেও বাঙালির নীরবপ্রেম আর গরম ভাতের সমাজ সচেতন গপ্প।
তবে এই অবস্থাটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল নয়া শতাব্দির ইন্টারনেট জমানায়।

তখন হলিউড মুভি দেখার সময়, আরেকটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো। সেটা ছিল সাব টাইটেলের যুগ। বিদেশি বা হলিউডের মুভিতে সাব টাইটেল দেওয়া থাকতো ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু সে সাব টাইটেল পড়ে, বাংলায় ট্র্যান্সলেট করে মগজে ঢোকাতে গেলে আর সিনেমা দেখা হতো না। মনে হতো অর্গানিক কেমিস্ট্রির ক্লাসে বসে আছি। তাই কিছুদিন সেই চেষ্টা করে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু মুশকিলটা হতো অন্য জায়গায়। মুভির কোনও এক দৃশ্যে হলে বেশ হাসির আওয়াজ উঠলো। বাঁ পাশের সিটে বসে থাকা লোকটাও দেখলাম হেসে উঠলো। হাসার কারণটা কী, বোঝার চেষ্টা করতাম। কিছুই মাথায় ঢুকতো না। অগত্যা আমিও হেসে উঠতাম। আমাকে হাসতে দেখেই, পাশের সেই লোকটা আমার দিকে কেমন আড়চোখে তাকাতো। কখনও সেসব পাত্তা না দিয়েই হেসে যেতাম। তবে মনটা গুটিয়ে যেত। 'মরে যাই সে কী লজ্জা !'
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আমার হাসার টাইমিংটা মেলেনি। কেন? আসলে ওই খটমটে ইংরেজি মাথায় না ঢুকে ওপর দিক থেকে বেরিয়ে যেত। তাই কখন হাসবো কখন কাঁদবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। আর পাশের লোকটাকে দেখে যখন হেসে উঠতাম, ততক্ষণে দেরি হয়ে যেত। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, হলিউড মুভি দেখতে আসা দর্শকদের মধ্যে আমার মতো লোকের সংখ্যা নেহাত কম ছিলো না। তবে তারা আমার মতো হাসার চেষ্টা করতো না। গম্ভীর মুখে যা দেখার দেখে বাড়ি চলে যেত। এই অস্বস্তিকর অবস্থা কেটে গেল সিনেমার নয়া জমানায়।

হলিউড হিরো হিরোইনরাও দিব্য হিন্দিতে কথা বলতে লাগলেন। প্রযুক্তি তখন অনেক এগিয়ে গেছে। সিনেমা তৈরি, প্রদর্শনেও। আর ডাবিংয়ের কাজটাও হতে লাগলো বেশ যত্ন করে। নয়া শতাব্দিতে বদলে গেল সিনেমার গোটা কনসেপসনটাই। ছারপোকার কামড় আর ঘামে ভিজতে ভিজতে সিনেমা দেখার দিন শেষ। হলের জায়গা নিলো মাল্টিপ্লেক্স। ঝকঝকে তকতকে মাল্টিপ্লেক্সে বসে হলিউড মুভি দেখার মজাই আলাদা।

নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের দৌলতে সহজ হয়ে গেল হলিউড মুভিদর্শন। গোটা বিশ্বের মুভি তখন হাতের মুঠোয়। একলাফেই যেন দর্শক বেড়ে গেল বিদেশী মুভির। বদলে গেলো আরও অনেক কিছু। এখন হলিউডে রিলিজ করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ঘরে বসে সেই মুভি দেখে ফেলি। অপেক্ষার দিন শেষ। দেশের প্রযোজকরা সরাসরি হলিউড মুভি আমদানি করে ফেলছেন। এই ব্যবস্থা শুরু হতেই বন্ধ হয়ে গেল আরেকটা জিনিস। একসময় হলিউড মুভির থেকে আইডিয়া চুরি করে বলিউডে সিনেমা তৈরি হতো। কারণ হলিউডে সিনেমা রিলিজ করলেও ভারতে তা আসতে অনেক সময় নিতো। নয়া জমানায় বন্ধ হলো সেই সব ধান্দাবাজি।

আজ মেজাজে হলিউড মুভি দেখি। শুধু ইংরেজি না, চীন জাপান রাশিয়া সবার। মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়ার সময় সুযোগ মেলে না। টিভিতে, ইচ্ছে হলে মোবাইলেও দেখেনি। আজ আর আমি ভাইপো না। নিজেই কাকু। তবে আজও ওই খটমটে ইংরেজি মাথায় ঢোকে না। হলিউডের হিন্দি ডাবিং চলে আসায়, আগের অসুবিধাও আর নেই। বরং ওই হট সিনগুলি একা ঘরে বসেই দেখি বারবার। যতবার খুশি ততবার। মাঝরাতের ঘর ভরে ওঠে আঁসটানি গন্ধে। কোনও ভাইপো সে খবর জানতে পারে না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours