গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

শীত চলে এলো আবার দলে দলে আন্দামান ভ্রমণ শুরু হয়ে যাবে আর এই ভ্রমণের সাথে যখন নির্ভেজাল নগ্নতা দেখার আকর্ষণ যুক্ত হয় তখন বোধহয় ভ্রমণ অন্য একটা মাত্রা পায়! তাই হয়তো নগ্ন-জারোয়া দেখানোর এই ঘৃণ্য ‘হিউমেন সফারি’ চালু হয়েছে! সভ্যতার আলো থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা বিশ্বের এই আদিমতম নগ্ন মানুষগুলিকে দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে এক আজব 'হিউমেন সফারি'।
বিদেশি পর্যটকরাই এ ব্যাপারে সবথেকে বেশি উৎসাহি, যদিও ভারতীয় পর্যটকদের আগ্রহ কিন্তু এতটুকুও কম নয়, কয়েক বছর আগে ব্রিটেনের মিডিয়ায় আসা একটি ভিডিও ফুটেজে হঠাৎ দেখা গেল, বিদেশি পর্যটকদের সামনে এক নগ্ন-জারোয়া যুবতীকে নাচতে বাধ্য করা হচ্ছে!  সারা বিশ্ব জুড়ে এরপরই প্রবল বিতর্কের ঝড় উঠতে শুরু করে, ভারতবর্ষেও সেই বিতর্কের আঁচ এসে পৌছোয়। তবু আজও এই ভাবেই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবুজ দ্বীপে নীল সমুদ্র, জল-জঙ্গল আর সমুদ্রতটে ছুটি কাটানোর মজার সঙ্গে যোগ হয়েই আছে নগ্ন-জারোয়া দেখার এই আদিম উল্লাস! বেশিরভাগ ভ্রমণ সংস্থাই তাদের ভ্রমণ package এ এই প্রলোভন নির্লিপ্ত ভাবে দেখিয়ে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে, আর  ব্যবসাও রমরমিয়ে চলছে।                   
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা হল এই জারোয়ারা, সঙ্গে সম্পেন, ওঙ্গি, সেন্টিনেল প্রভৃতি উপজাতির মানুষরাও আছে, যারা এখনো সভ্যতাকে বরণ করে নেয়নি, বরং সভ্য মানুষজনকে ঘৃণার চোখেই দেখে। জঙ্গলই তাদের প্রিয় বাসস্থান, আর নগ্নতাই তাদের সাধারন প্রবৃত্তি, এখনো তাদের হাতে থাকে অস্ত্র হিসেবে তীর-ধনুক, খাবারের জন্য শিকারের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলের বুক চিরে একদিক থেকে আরেক দিক, বুনো শূয়র, সামুদ্রিক মাছ আর জঙ্গলের ফলমূলই এখনো এদের খাবার। অদ্ভুত ভাবে এদের একান্ত নিজস্ব জীবনযাত্রা আর মুলত নগ্নতাই কবে যেন হয়ে গেলো আন্দামানে আসা অধিকাংশ পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ! তাই নগ্ন-জারোয়া দেখানোর কথা প্রচার করে নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় নেমেছে সব টুর অপারেটররা, আবার তাদের উৎসাহ দিতে যখন এগিয়ে আসে সয়ং আন্দামান প্রশাসন তখন তো কথাই নেই! তবে একটা ব্যাপার অনস্বীকার্য যে এ ব্যাপারে পর্যটকদের আগ্রহ এতটুকুও কম নয়!  পর্যটকদের এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই হয়তো উৎসাহিত হয়ে অনেক বিতর্ক সত্ত্বেও,  প্রশাসন জারোয়াদের সংরক্ষিত অঞ্চল ফুঁড়ে তৈরী করেছে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড নামের হাইওয়ে, এই হাইওয়ে দক্ষিণ আন্দামান থেকে মধ্য আন্দামান হয়ে উত্তর আন্দামানে যাওয়া ফলে জারোয়ারা এখন অনেকটাই বেআব্রু হয়ে পড়েছে, ফলে তারা এখন প্রায়ই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে চলে আসছে হাইওয়ের উপরে, সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের চাহিদাও বেড়েছে নানান সভ্য আধুনিক বস্তুর উপর।
দেশে বিদেশে এই ‘হিউমেন সফারি’ কথাটা কিন্তু প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছে।  বিজ্ঞাপন দিয়ে এই 'হিউমেন সফারি' যদিও দেশে-বিদেশে প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ায়, এখন আইনের কড়াকড়ি কিছুটা হলেও বেড়েছে। ইদানিং পর্যটকদের কোনও গাড়িকেই এই সংরক্ষিত এলাকায় সকাল নটা থেকে বিকেল তিনটের পর আর যেতে দেওয়া হয় না, সংরক্ষিত অঞ্চলের প্রবেশের মুখে বসেছে চেকপোস্টে, মোটর সাইকেলে পুলিশ  সংরক্ষিত অঞ্চলের পথ  পাহারা দেয়, সংরক্ষিত অঞ্চলে কোনও গাড়ি দাঁড় করানো নিষেধ, গাড়ির   গতিবেগও বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চল্লিশ কিলোমিটারের নীচে কোনো ভাবেই রাখা চলবে না গাড়ির গতিবেগ, ছবি তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ধরা পড়লে বড়ো অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে। তবুও কিন্তু চলছে 'হিউমেন সফারি', ছবি তোলা না যাক, দেখা তো যাবে এক ঝলক নগ্নতা!
  জঙ্গল থেকে এই জারোয়ারা যখন মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে, প্রশাসন তাদের নিয়ে গিয়ে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে, এই পথে নগ্ন-জারোয়াদের সঙ্গে, সভ্য জগতের থেকে পাওয়া হাফ প্যান্ট পরা জারোয়া যুবকদের ও দেখা মেলে আজকাল, যদিও এদের হাতে এখনো থাকে সেই আদিম তীর-ধনুক।                     
একুশ শতকে পৌঁছেও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা জারোয়া, সম্পেন, ওঙ্গি, সেন্টিনেল প্রভৃতি উপজাতির মানুষরা সভ্য জগতের মানুষদের থেকে এখনো দুরে থাকতেই পছন্দ করে। যদিও জারোয়াদের কিছু অংশ এখন সভ্যতার ছোঁয়া পেতে আগ্রহী হয়েছে, তবে গভীর জঙ্গলের জারোয়াদের  কাছে পৌঁছানো এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তেমনিই সম্ভব হয়নি সেন্টিনেলদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা।
সাম্প্রতিককালের এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, কমতে কমতে এখন জারোয়ারা সংখ্যায় মাত্র তিনশোর কাছাকাছি, ওঙ্গিদের সংখ্যা মাত্র একশো, সেন্টিনেলদের সংখ্যা দুশো পঞ্চাস, সোম্পেনদের সংখ্যা খুব বেশি হলে দুশো পঞ্চাশ,আর গ্রেট-আন্দামানিজদের সংখ্যা মাত্র পঁয়তাল্লিশ।  এই সব আদিমতম মানুষগুলিকে টিকিয়ে রাখাই এখন সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্চ হয়ে উঠেছে। জারোয়াদের এই গভীর জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসার পেছনেও রয়েছে একটি ঘটনা, এনমাই নামে এক জারোয়া যুবক পা ভেঙ্গে খুব কষ্ট পাচ্ছিল, প্রশাসন এই খবর জানতে পেরে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোনমতে নিয়ে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে, তারপর সেখানে তার দীর্ঘ চিকিৎসা চলে, আর এই এনমাই এর মাধ্যমেই পরবর্তী কালে জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি সূত্র খুঁজে পায় প্রশাসন। এই এনমাইকে সভ্য সমাজের মাঝে বেশ কিছুদিন রেখে তারপর তাকে আবার ফেরত পাঠানো হয়েছিল সে সময় আবার তার আদি বাসস্থান জঙ্গলে, সে জঙ্গলে গিয়ে নিজেই উৎসাহের সঙ্গে সভ্য সমাজের কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিল তার নিজের সমাজকে, তারপর থেকেই ধীরে ধীরে বাইরের জগতের সভ্য মানুষ সম্পর্কে জারোয়াদের উৎসাহ শৃষ্টি হতে শুরু করে, এই এনমাই আবার জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার আগে বেশ কিছু হিন্দি শব্দও শিখে যায়! তারপর থেকে জারোয়ারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সড়কের আশেপাশে চলে আসতে শুরু করে, মাঝেমধ্যেই সাহস করে তারা খাবার ও নেশার জিনিস ইত্যাদি চুরি করে খেতেও সুরু করে। প্রশাসনের কর্তারা প্রথমে এই ঘটনাকে জারোয়াদের সঙ্গে সভ্য সমাজের যোগাযোগের এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। জারোয়ারা ক্রমশই সভ্য সমাজের ছোঁয়া পেয়ে  বিভিন্ন নেশা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করে আর বর্হিজগতের সংস্পর্শে এসে জারোয়ারা মিজলস, মামস, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি নানান রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে, যেসব রোগ তাদের মধ্যে আগে কখনো দেখা যায়নি। এমনও গুরুতর অভিযোগ মাঝে মাঝেই উঠে আসছে যে জারোয়া যুবতীদের নিয়ে যৌনতায় উৎসাহ দিচ্ছে একশ্রেণীর বর্বর মানুষ, যার ফল হতে পারে মারাত্মক, ভাবলে গা শিউরে উঠবে !
1974 এ নৃতত্ববিদ ত্রিলোকনাথ পন্ডিত উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে গিয়ে অধিবাসীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রথম চেষ্টা করেন, তার সাথে ছিল ওদের জন্য খাবার হিসেবে যথেষ্ট ফল, শুকর ইত্যাদি, কিন্তু সেবারের চেষ্টা সফল হয়নি, দ্বীপবাসীরা তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে অভ্যর্থনা করলে, তিনি প্রাণভয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপর আবার 1981এ হংকং এর একটি জাহাজ 'প্রাইমরস' নোংগর করে সেন্টিনেল দ্বিপের কাছে, দ্বীপবাসীরা সশস্ত্র আক্রমনের প্রস্তুতি নিলে, আতঙ্কিত জাহাজের ক্যাপ্টেন বেতারে অস্ত্র সাহায্যের আবেদন করেন, কিন্তু কোনো সাহায্য সঙ্গে সঙ্গে এসে পৌছোয় না, উৎকন্ঠা আর মৃত্যু ভয় নিয়ে আটকে পড়ে সেই দল, যদিও ভাগ্য সহায় থাকায়, সে সময়ে সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে অধিবাসীরা শেষপর্যন্ত জাহাজের কাছে এসে পৌছোতে না পারায় শেষরক্ষা হয়েছিল, তারপর এক সপ্তাহ বাদে ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে তাদের সবাইকে উদ্ধার করে। অবশেষে 1991এ ভারতীয় নৃতাত্বিক ত্রিলোকনাথ ই প্রথম এদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন।                          আদিবাসীদের কল্যাণের কাজের সাথে যুক্ত মানুষরা অবশ্য মনে করেন, জারোয়াদের মত আদিম মানুষগুলিকে যতদিন সভ্য সমাজের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা যাবে ততই তাদের মঙ্গল, এনথ্রোপলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আন্দামান শাখার প্রধানেরও মত একই রকম, জারোয়াদের মতো আদিমতম মানুষগুলোকে জোর করে সভ্য সমাজের সঙ্গে সহাবস্থানের করানোর  চেষ্টা করা মানে, এই আদিম প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মানুষদের  গণহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া।
সভ্য সমাজের নানান সভ্য আচরণ প্রতিদিন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে, একটা কথাই মনে হয় নগ্ন-জারোয়া দেখার অভিযান ‘হিউমেন সফারি’ অবিলম্বে বন্ধ করাই উচিত, তাতে হয়তো জারোয়ারা বেঁচে যাবে, জোর করে জারোয়াদের সভ্য করতে গিয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে না দেওয়াই ভালো, থাক না ওরা ওদের মতো।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours