গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

বছর খানেক আগের ঘটনা, বিক্ষোভকারীদের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল কাশ্মীরের সৌন্দর্যের টানে ঘুরতে আসা এক তরুণের, শ্রীনগরের নারবালে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল!
এই ঘটনার জম্মু কাশ্মীরের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি গভীর শোক ও লজ্জা প্রকাশ করেছিলেন, সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন,এই ঘটনায় তাঁর নাকি মাথা হেঁট হয়ে গেছে! বাইশ বছর বয়সী ওই তরতাজা যুবক থিরুমণির বাড়ি ছিল চেন্নাইয়ে, পর্যটকদের একটি বাসে মা-বাবার সঙ্গে সেও ছিলো, বাসটি যখন শ্রীনগর-গুলমার্গ রোড ধরে যাচ্ছিল, সেই সময় বাসের জানালা ভেদ করে একটি পাথর তীর বেগে ছুটে এসে লাগে ওই তরুণের মাথায়, পরে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে স্থানীয় হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। নিরীহ পর্যটক মৃত্যুর ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছিলেন তখন কাশ্মীরের বিরোধী দলনেতা ওমর আবদুল্লাও! বিক্ষোভকারীদের ছোড়া পাথরে এ রাজ্যে আসা এই অতিথির (মেহমান) প্রাণ গেছে, তাই তিনি মেহবুবা মুফতির কড়া সমালোচনা করে বলেছিলেন মেহবুবা মুফতি উপত্যকায় সরকার চালাতে ব্যর্থ! পিডিপি নেত্রীর পদত্যাগেরও দাবি তুলে ছিলেন! কি বিচিত্র এই মহামানবের দেশের এইসব মানুষ!
তারপর আবার 2006 এর এপ্রিল মাসে পাথরবাজদের হামলায় আহত হয়েছিলেন সাতজন পর্যটক, সে বছর মে মাসেই আবার পাথরের ঘায়ে আহত হয়েছিল কাশ্মীরের এক দ্বিতীয় শ্রেণির স্কুলছাত্র। 2006 এর মে মাসেই ডাল গেটের কাছে পর্যটকদের একটি বাস এসে দাঁড়াতেই, এক কাশ্মীরি পোশাক পরিহিত যুবক সেই বাসের জানালা লক্ষ্য করে কিছু একটা ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্কোরণ, তারপর জানা যায় গ্রেনেড হামলা করেছে জঙ্গিরা নিরীহ পর্যটকদের ওপর! আহত বা নিহত পর্যটকদের পরিসংখ্যানে যোগ হোল আরও কিছু নাম! তারপর আবার জুলাই মাসেই কাশ্মীরের লাল চকের মোড়ে পর্যটকদের বাসের জানালা দিয়ে আচমকাই একটি গ্রেনেড এসে পড়লো, সাতজন পর্যটককে বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিল জঙ্গিরা!                                          তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে, কাশ্মীরের মানুষ কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি এইসব ঘটনা, কারণ তারা বিশ্বাস করে কাশ্মীরকে পর্যটক শূণ্য করে দিলে, তাদের সামনে বাঁচার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে, এখন তো পর্যটন এর সঙ্গে আপেল শিল্পেরও সর্বনাশ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি মদতপুষ্ট জঙ্গিরা! দুঃখজনক হলেও সত্য যে এইসব ঘটনা মানবাধিকার কর্মীদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না!                                                                  এবার একটু কাশ্মীরে জেহাদের নামে অত্যাচার আর গণহত্যার ইতিহাসে ফিরে তাকাই:- 1990  সালের মার্চে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একজন বিএসএফ কর্মকর্তার স্ত্রীকে অপহরণ করে, ওই মহিলার ওপর বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় এবং বহুদিন ধরে তাঁকে গণধর্ষণ করা হয়, তারপর ফেলে দেয়া হয় তাঁকে একটি রাস্তায়! 1990 সালের এপ্রিল মাসের 14 তারিখে, শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েনসের এক কাশ্মীরি পণ্ডিত নার্সকে অপহরণ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, সেই নার্সকেও বারবার গণধর্ষণের পর পিটিয়ে হত্যা করা হয়! যতদূর জানা যায় JKLF এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে, কি মহান জেহাদি আন্দোলন!  06 জুন 1990  ত্রেহগামে সরকারি হাইস্কুলের গবেষণাগার থেকে একজন সহকারিণীকে অপহরণ করা হলো, বহুদিন ধরে গণধর্ষণ করা হলো তারপর মহিলাটিকে করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করা হলো! এর থেকে নৃশংসতা আর কি হতে পারে! 1990 সালের নভেম্বর মাসে সোপোরে একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের স্বামী-স্ত্রী কে অপহরণ করে, কয়েকদিন ধরে টানা গণধর্ষণ করা হয় ওই নারীকে তারপর দু'জনকেই হত্যা করা হয়! এরপরও অনেক আছে! 1990 তে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, আগস্ট মাসের 13 তারিখে কাশ্মীরের শিক্ষা বিভাগের একজন মহিলা কর্মকর্তাকে তাঁর নিজের বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের সামনে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়!  30 এ মার্চ, 1992 ক্রালখুদের নায়ি সড়কে সোহনলাল নামের একজন ট্রাকচালকের বাসায় খাদ্য ও আশ্রয় দাবি করে আশ্রয় নিয়ে, প্রথমে ওই ট্রাকচালকের মেয়েকে গণধর্ষণ করে, জঙ্গি ধর্ষকদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে সোহনলালের  স্ত্রীকেও ধর্ষণ করা হয়, শেষে গুলি করে হত্যা করা হয় পরিবারের সবাইকে!  1995 এ কাশ্মীরে প্রথম বিদেশি পর্যটকদের অপহরণ করা হয়,  অনন্তনাগ জেলায় এই ছয় বিদেশি পর্বতারোহীদের অপহরণ করে, তোলপাড় হয়ে গেছিল পুরো বিশ্ব, কিন্তু আটকানো যায়নি কিছুই, পরে তাদের একজনের মুন্ডু কেটে নেওয়া হয়, একজন পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিন্তু চারজনের খবর পাওয়া যায়নি হয়তো তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছিল!  2005 এ  লুরকোটি গ্রাম থেকে এক গুজ্জার কিশোরীকে অপহরণ করে জোর করে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয় এক অপহরণকারীদের ই একজনকে, এরপর সেই কিশোরীর কপালেও জুটে ছিলো গণধর্ষণই ! 1997 সালের মার্চ মাসে সংগ্রামপুর গ্রামে সাত কাশ্মীরি পণ্ডিতকে গণহত্যার স্বীকার হতে হয়েছিল! 1998 সালের জানুয়ারিতে, ওয়ান্দাম গ্রামে চব্বিশ কাশ্মিরি পন্ডিতকে পাকিস্তানি জঙ্গিরা হত্যা করেছিল, জীবিত থাকা একজনের বয়ান অনুযায়ী, জঙ্গিরা প্রথমে নিজেদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার হিসাবে পরিচয় দেয়, তারপর তাদের ঘরে ঢুকে অন্ধকারে নির্লজ্জের মতো গুলি চালায়! এই ঘটনাটির সঙ্গে অনেকটা মিল আছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাঁচ বাঙালী শ্রমিকের মৃত্যুর সঙ্গে! সাতাশ জন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি যেমন এই সময়ে কাশ্মীর সফর করছে, সেই সময়েও প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন কিন্তু আজকের এই বিরোধী দল কংগ্রেস, এই ঘটনাকে 'পাকিস্তান সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ' প্রমাণ করার জন্য নয়া দিল্লিতে এই গণহত্যার কাহিনী, বিল ক্লিন্টনের কাছে সবিস্তারে তুলে ধরেছিল! আর কতো ধর্ষণ গণহত্যার কাহিনী শোনাব! শেষ করতে পারবো না! 1998 এ প্রংকোট গণহত্যা! 2008 এ উধমপুরে হিন্দু গ্রামবাসীদের গণহত্যা করা! 1998 এ চাঁপানিয়ারি গণহত্যা, জঙ্গিদের হাতে পঁচিশ জন হিন্দু গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়!  2000 সালে অমরনাথ তীর্থযাত্রা চলাকালীন নৃশংস এবং নির্লজ্জ গণহত্যা, তিরিশ জন অসহায় হিন্দু তীর্থযাত্রী কে গণহত্যা করেছিল এই জেহাদিরা! কাশ্মীরের গণহত্যার নির্লজ্জ রক্তাক্ত ইতিহাসে এই ঘটনা খুবই উল্লেখযোগ্য। 2001 সালের জুন মাসে জম্মু ও কাশ্মিরের আইন পরিষদের সন্ত্রাসী হামলা!  2001এর অক্টোবর মাসে শ্রীনগরের আইন পরিষদে বোমা হামলায় 38 জনের মৃত্যু! 2002 এর রঘুনাথ মন্দির আক্রমণ, আত্মঘাতী হামলায় তিন জন নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ সহ এগারো জন নিহত হয়! 2008 সালের নভেম্বরে ফের আত্মঘাতী হামলা হয় এই মন্দিরের ওপর, এবং চোদ্দ জন ভক্তকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়! 2002 এর কাসিম নগর গণহত্যা, শ্রীনগরে কাশিম নগর বাজারে হাত-গ্রেনেড আর গুলি ছুড়ে সাতাশ জনকে হত্যা ও সাধারণ  নাগরিকদের আহত করা হয়! ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, যন্ত্রণায় হাত থেমে যাচ্ছে, আর লিখতে ইচ্ছা করছে না তবু , 2003 এর নাদিমার্গ গণহত্যা কাণ্ডে চব্বিশ জন হিন্দু নিহত হয়েছিল লস্কর-ই-তৈয়বার জেহাদিদের হাতে!  2005 এর 20 জুলাই, শ্রীনগরে চার্চ লেন এলাকায় একটি গাড়ি বোমা, সাঁজোয়া গাড়ির কাছাকাছি এসে বিস্ফোরিত হলে চার ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মীর প্রাণ চলে যায়! জঙ্গি গ্রুপ হিজবুল মুজাহিদিন এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল।  2005 এ একটি জঙ্গি হামলায় শ্রীনগরে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাদশা চকে দুজনের মৃত্যু হয়, কমবেশি সতেরো জন আহত হয়, আহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সাংবাদিক! 18 অক্টোবর 2005 এ কাশ্মীরি জঙ্গিরা জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী গোলাম নবী লোনকে হত্যা করে! আল মনসুরিন নামক জঙ্গি গ্রুপ হামলার দায় স্বীকার করে নেয়! 2006 এ জম্মু ও কাশ্মিরের দোডা ও উধমপুর জেলায় জঙ্গিরা পঁয়ত্রিশ জন হিন্দুকে হত্যা করেছিল! 2006 এর 06 জুনে সন্ত্রাসীরা বাস-স্ট্যান্ডে, বৈষ্ণদেবি মন্দিরের বাসে তিনটি গ্রেনেড ছুড়লে, মারা  যান এক ব্যক্তি, আহত হয় 31 জন! কাশ্মীরের জেহাদি আন্দোলনের ফলে যতো গণহত্যা হয়েছে এ শুধু তার হিমশৈলের চুড়া মাত্র! মানবাধিকার কি শুধু একতরফা হতে হবে, মরতে হবে শুধু নিরীহ মানুষকেই বারবার, বাংলার পাঁচ দরিদ্র শ্রমিক পেটের দায়ে কাশ্মীরে কাজ করতে গিয়ে  লাশ ফিরে আসবেন তার হতভাগ্য পরিবারের কাছে,  তবু বিরোধী রাজনৈতিক দলের কেউ পাকিস্তানের নাম মুখে আনছেন না! জঙ্গিদের কড়া ভাষায় নিন্দা করছে না! যত দোষ শুধু কি বর্তমান সরকারের! তাহলে আগের এইসব হত্যালীলা কাদের আমলে ঘটেছিল, তারা তো কোনো ধারার অবলুপ্তি ঘটায়নি, কাশ্মীরে জোর করে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে চায়নি তাহলে কেন ঘটেছিল এতো গণহত্যা সেই সময়কালে! কি রহস্য আছে এতে ঈশ্বরই জানেন!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours