কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

মামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো!

অ্যাকুয়ামেরিন, মুক্তো আর নীলা। হাতে জ্যোতিষসম্রাটের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিশ্চিন্তে ভদ্রাসনে ফিরলেন মাবাবা। এবার আর মামনের ডাক্তার হওয়া আটকায় কে? একবার আড়চোখে আকাশের দিকে তাকালেন বাবা। চোখাচোখি হয়ে গেলো চাঁদের সঙ্গে। "কেমন টাইট খাবি এবার দেখ !" মনে মনে বললেন বাবা।

মা বাবা মামনকে ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বে।

আর সেই মেয়ে কিনা মোবাইল ঘেঁটেই কূল পায় না। বকাবকি ঝকাঝকি করেও বইয়ের পাতায় মন ফেরানো যায়নি মেয়ের। অগত্যা, শহরের এক দামী জ্যোতিষির শরণাপন্ন। গিরীশ পার্কের চেম্বারে বসে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের গেরোমিকে গুঁড়িয়ে শায়েস্তা করার বিধান দিলেন জ্যোতিষ মহারাজ। অ্যাকুয়ামেরিন, মানসিক অস্থিরতার মোক্ষম দাওয়াই। চন্দ্রের অশুভ দৃষ্টিকে টাইট দিতে, ডানহাতের কনিষ্ঠাতে মুক্তা। সঙ্গে নীলা। শান্ত করবে অশুভ শনি মহারাজকে। পৃথিবী থেকে একশো কুড়ি কোটি কিলোমিটার দূরে শনিদেবের অবস্থান। কলকাতায় বসেই জ্যোতিষবাবাজি দিলেন শনিদেবকে শায়েস্তা করে। চাঁদতো কোন ছার! ওই তো, মাত্র তিন লক্ষ চুরাশি হাজার চারশো কিলোমিটার দূরে ঝুলছে। জ্যোতিষসম্রাটের ক্ষমতার বহরখানা বুঝুন ! আর মামনের মাবাবার কল্পনার দৌড়ও ! দুইয়ে মিলে দক্ষিণাও সেরকম। প্রায় হাজার তিরিশের ধাক্কা।

"তবে ডাক্তারি পড়ার যোগ দুর্বল।" বাস্তব সম্মত নিদানটা অবশ্য দিয়ে রেখেছেন জ্যোতিষসম্রাট। তবে বাবার যখন টেঁকের জোর আছে, সরকারি না হলেও বেসরকারি কলেজে মামনের ডাক্তারি পড়া হতেই পারে। মোট কথা বাঘ মারুক না মারুক, জ্যোতিষি মামুনের ভাগ্যে শেয়াল শিকারের সম্ভাবনাটা জিইয়ে রাখলেন। এটাই মজা জ্যোতিষের। অপশনটা হাতে রেখেই ভবিষ্যদ্বাণী। আর মক্কেলের হাল, আশায় মরে চাষার মতো।

কিন্তু ওসব চাঁদ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্রের ধার পারতো না ভারতের ভূমিপুত্ররা। দ্রাবিড় সভ্যতার এই মানুষরা দিব্য চাষবাস করতো। খেতো-দেতো, ঘর সংসার করতো। আর আকাশ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামাতো আর্যরা। যাযাবরের জীবন। আজ এখানে তো কাল সেখানে। ওই তারা দেখেই অন্ধকার রাতে দিক ঠাহর করতো তারা। পারি দিতো অভীষ্টের দিকে। তারাই দেখাতো চলার পথ। এই নির্ভরতা থেকেই তাদের দৈনিক জীবনের নানা ঘটনাকে আর্যরা জড়িয়ে ফেলেছিলো তারার সঙ্গে। ওই ঘটনাতেই কি লুকানো ছিলো জ্যোতিষবিদ্যার ভ্রূন? ভারতে জ্যোতিষচর্চা কিন্তু ঢুকে পড়েছিল এই আর্যদের হাত ধরেই।

তবে জ্যোতিষবিদ্যার আতুরঘর ব্যাবিলন। সেখান থেকে ছড়িয়ে গ্রিকে। তখন জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষবিদ্যাকে খুব একটা আলাদা করে দেখা হতো না। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। জ্যোতিষচর্চায় যে ব্যাপারটা সবচেয়ে গুরুত্ব পায়, তা হলো সময়। ওই সময় ধরেই গ্রহের অবস্থান বুঝে ফেলেন জ্যোতিষিরা। আর ওই গ্রহদের কারসাজিতেই নাকি ঠিক হয়ে যায় জাতকের ভবিষ্যত। সময় যতো নির্ভুল, জাতকের ভবিষ্যত গণনা, ঠিকুজি- কোষ্ঠিও তত নিখুঁত।

মজার জায়গা এটাই।

ইতিহাসবিদদের মত,  প্রায় দু'হাজার বছর আগেই ব্যাবিলনে শুরু হয়ে গেছিলো জ্যোতিষ গণনার কাজ। কিন্তু কিভাবে? ঘড়ির বয়স তো সবে তিনশো তেষট্টি বছর। ১৬৫৬ সালে পেন্ডুলাম ক্লকের আবির্ভাব। তাহলে সেই দু'হাজার বছর আগে সময়ের চুলচেরা হিসেব-নিকেশ করতেন কিভাবে আদি জ্যোতিষিরা?

তার আগেও ঘড়ি ছিলো বটে। জলঘড়ি, ছায়াঘড়ি। দিল্লির যন্তর-মন্তরে ঠিক যেমনটা দেখা যায়। কিন্তু তাতে একটা গোটা দিনরাতকে সমান চব্বিশটা ভাগে ভাগ করা যেত কি ? তারপর তো আছে মিনিট, সেকেন্ডের চুলচেরা হিসেব, গণৎকাররা ঠিক যেমনটি চান। ঠিকুজি-কোষ্ঠির কোথাও কিছু ভুলভাল হলেই দোষ পড়ে সময়ের ঘাড়ে।

তাহলে ঘড়ি আবিষ্কারের আগেই জ্যোতিষবিদ্যার চল হলো কিভাবে ?

এতো আগে মুরগি, নাকি আগে মুরগির ডিম?

আর্যর আকাশ, অনার্যের মাটি। দুই ভিন্নমুখী সভ্যতা।

দুই বিপরীতমুখী স্রোত জীবনচর্চার। একটা হলো, অনুমান নিয়তি ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকা। অন্যটা, বাস্তবের শক্ত উর্বর জমির ওপর দাঁড়িয়ে বাঁচা। আধুনিক দুনিয়াতেও ওই দুই স্রোতে ভেসে চলেছি আমরা। তবে অনেকেই আছে যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সাধ্য থাকলেও সাধ্যে কুলায় না। পরিশ্রমেও বিমুখ। শর্টকাট মারার গ্রহশান্তি। অগত্যা ভরসা মাদুলি, কবচ, পাথরের। ঠিক যেমনভাবে মামনকে যেতে হলো অ্যাকুয়ামেরিন, মুক্তো আর নীলার ভরসায়।

সারাক্ষণ নাকি মামনের মুখগোঁজা মোবাইলে। কেন?

সোশ্যাল মেডিয়াতেই হয়তো নিজের একটা ছোট্ট দুনিয়া বানিয়ে ফেলেছে সে। উঠতি বয়স। মাথায় কিলবিল করছে অজস্র প্রশ্ন। সেসব মাবাবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। কারণ মাবাবার কাছে ক্লাস টুয়েলভের মামন আজও কামগন্ধহীন এক দেবশিশু। তাই মামন আজ নিঃসঙ্গ।

ব্যাপারটা মানসিক। কিন্তু তা পাত্তা দেয় কে ? তাই সব দোষ বর্তালো ওই চাঁদ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্রের ওপর।মনোবিদের বদলে মুশকির আসান হলো জ্যোতিষ।

শনি মহারাজের কলকাঠি নাড়া না। আসল চক্রান্ত হয়ত করে চলেছে মামনের লিম্বিক সিসটেম। এই সিস্টেমের জন্যই আবেগে সাড়া দেয় আমাদের শরীর। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে মাত্রই আবেগপ্রবণ। কেউ কম কেউ বেশি। এই আবেগই মারাত্মক সব ভুলভাল কাজ করিয়ে নেয় মামনদের দিয়ে।

পড়াশোনায় মন না বসার এই ঘটনা হতে পারে 'অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি)'। বাচ্চার থেকে নিয়ে বড়রাও এই সমস্যায় ভুগছে এখন। তাল কেটে যায় ব্রেনের। সমস্যা দেখা দেয় আবেগ নিয়েও। এন্ডোক্রিনোলোজিক ডিসটার্বেন্সের খেসারত দিতে দুর্বল হয়ে যায় পড়াশোনা বা জ্ঞান বাড়ানোর স্বাভাবিক প্রবণতা। সবমিলিয়ে চেপে বসে দারুণ অমনোযোগ।

এই যাবতীয় সমস্যার দাওয়াইয়ের সন্ধান নিয়ে বসে আছেন ডাক্তার বৈদ্যরা। তাদের আয়োজনও রাজকীয়। আছে কাউন্সেলিং। তাঁরা যে কাজটা অনায়াসেই করে দিতে পারতেন, তা হলো মামনের নিজের দুনিয়ায় পুনর্বাসন। ফিরিয়ে দিতে পারতেন মামনের মনসংযোগ। কিন্তু কোনও মতেই মামুনকে ডাক্তারি পড়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন না বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও।

কিন্তু মেয়ের অসুস্থতা চোখেই পড়লো না মাবাবার। তাদের দুচোখ ঢাকা গলায় স্টেথো ঝোলানো মামনের স্বপ্নকল্পে। মেয়ের স্বপ্নপূরণে না, আসলে নিজেদের স্বপ্নপূরণেই ব্যস্ত মাবাবা। কেউ জানতেও চাইলো না মামনের মনের কথা। তার স্বপ্নের কথা। অতএব, জ্যোতিষের প্রেসক্রিপশনেই মতলব হাসিলের চালাকি। তার ঘটকালিতেই মিতালি গ্রহ, নক্ষত্রের সঙ্গে। তারপর স্বপ্নপূরণের রাস্তায় এগিয়ে যাওয়া। নির্ঝঞ্ঝাট। মসৃণ যাত্রাপথে পারি। ওলা উবেরে ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে অফিস টাইমের ভিড়ভাট্টার রাস্তায়, দমদম থেকে গড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চিন্তি। তাতে পঁচিশ ত্রিশ হাজার যায় তো যাক না!

বিজ্ঞানের এই শত সহস্র যুক্তি, বিশ্লেষণের মধ্যে গিয়ে হবেটা কী? বড্ড জটিল। ডাক্তার বৈদ্যর যুক্তিগুলিও কেমন যেন খটমটে। নীরস। তারচেয়ে অনেক বেশি মজার জ্যোতিষির ডায়াগনসিস। সুন্দর সুন্দর সব পাথর নিয়ে কারবার। দারুণ এক রহস্যে ঘেরা গ্রহ, তারা, নক্ষত্র, নীহারিকার ওই সংসার। সেই ঘন কালো আদি অন্তহীন অন্ধকারে বাস শনি, মঙ্গল, রাহু, কেতুর। তাদের হাতেই মামনদের জীয়নকাঠি, মরণকাঠি। দারুণ রোমান্টিক ব্যাপার- স্যাপার। আঙুলের ডগায় দু'রতি, পাঁচরতির নীলা, পোখরাজ ঝুলিয়ে সরাসরি সেই অজানা দুনিয়ায় ঢুকে পড়া। গা ছমছমে রোমাঞ্চ!

অজানার ওপর আমাদের টান তো জন্মগত।

"বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান আকাশ ভরা সূর্য তারা।"

এই সূর্যই একমাত্র তারা। যার ভ্রূকুটিতেই নিমেষে উধাও হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্ব। আমাদের ওপর খানিকটা দাদাগিরি চালায় চাঁদও। আর সব ফেকলু। দিনের শেষে, আমরাই আমাদের নিয়ন্ত্রণকর্তা। কিন্তু মামনের মাবাবা ভালভাবেই জানেন, মেয়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই বাঁকা রাস্তায় হাঁটা ছাড়া উপায় কি ?

আমরাই সূর্যকে নিয়ে গান বাঁধি। কাব্য করি চাঁদকে নিয়ে। কারণ আমরাই 'অমৃতস্য পুত্রা'।  সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।

মামন এবার চাঁদ ছোঁবেই ছোঁবে।

(তথ্যসূত্র ডাক্তার সোহিনী মুখার্জি চক্রবর্তী)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours