Bitorko ojodhya-ram mondin
গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

বিজেপির বা নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার ফলেই হিন্দুদের এতো বাড়বাড়ন্ত কিম্বা আরএসএসের উত্থানকে যারা শুধুমাত্র দায়ী করে আসছেন রামমন্দির বিতর্কের জন্য তারা হয় ইতিহাস জানেন না, না হয় সত্যের অপলাপ করছেন!  ‌স্বাধীনতার বহু  আগে থেকেই এই অযোধ্যায় তৈরী হয়েছিল রামজন্মভূমির ওপর তৈরী হওয়া বাবরি মসজিদ নিয়ে  হিন্দুদের চরম অসন্তোষ। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে, 09 নভেম্বর শনিবার 2019 এ বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্ক মামলার আপাতত অবসান হলো বলেই আশা করা যাচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে ভারতবর্ষের রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণ করেছে প্রাচীনতম এই মামলা, কখনও কখনও উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, নানান ধরনের রাজনৈতিক অভিসন্ধি মুলক প্রচার চালানো হয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য। তাছাড়া সুইডো সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের ব্যাঙ্গবিদ্রুপ  তো লেগেই ছিলো অলঙ্কারের মতো এই বিতর্কের সঙ্গে সবসময়ই ! শুধু ভারতবর্ষে নয় পৃথিবীর ইতিহাসেও সম্ভবত এটাই সবথেকে জটিল এবং দীর্ঘকাল ধরে চলা একটি বিতর্ক, আর এই বিতর্ক ঘিরে ভারতবর্ষে ঘটে গেছে অনেক উত্থান-পতন, হিংসাত্মক ঘটনা, রক্তপাত, রাজনৈতিক তরজা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিভাজন। সেই সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ঐতিহাসিক রায় শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, অনেকের মনে করছেন এই কয়েক দশকে দেশের আইনও অনেক পরিণত হয়েছে, সেই কারণেই হয়তো সবদিক বজায় রেখে এই মামলায় রায় ঘোষণা করতে পেরেছে দেশের শীর্ষ আদালত, প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত যাইহোক ধরে নেওয়া যেতেই পারে এক দীর্ঘ বিতর্কের পরিণতি বা অবসান হলো শেষপর্যন্ত।  এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক বাবরি মসজিদের প্রায় পাঁচশ বছরের ধুসর ইতিহাসে:- আনুমানিক 1528 এ মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করেন বলেই তথ্য উঠে এসেছে। তারপর রামজন্মভূমি বা বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত হয় 1857 সালে, এই বছরেই আবার শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ রাজের  হাত থেকে ভারতমাতাকে স্বাধীন করার প্রথম ঐতিহাসিক সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই, আর এই লড়াইয়ের পাশাপাশিই নিঃশব্দে আগুনের ফুলকির মত নতুন এক বিতর্ক দানা বাঁধছিল লখনউ থেকে একশো তিরিশ কিমি দূরে ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায়, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দাবি তোলে অযোধ্যার ওই বিশেষ বা বিতর্কিত জমিতেই বাবরের সেনাপতি মীর বাকি 1528 এ মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তৎকালীন বাবরি মসজিদের দায়িত্বে থাকা মৌলবী মুহাম্মদ আসগর ফৈজাবাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক আবেদনে জানান যে মসজিদ প্রাঙ্গনের পশ্চিম দিকটি হনুমান গরহি জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছে, এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,  বৈষ্ণব বৈরাগী বলে পরিচিত হনুমান গরহি তাঁর গোটা ধর্মীয় জীবন এই অযোধ্যাতেই কাটিয়েছেন। মৌলবীর এই অভিযোগের পর ই ওই জায়গা নিয়ে আইনি বিতর্ক শুরু হয়, যদিও যে জমিতে বাবরি মসজিদ ছিল সেই জমি নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আদালতে যাওয়ার বহু বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, এরপর উত্তেজনা প্রশমিত করতে  সরকারিভাবে ওই জমিটিকে '‌বিতর্কিত জমি’‌ বলে চিহ্নিত করে তৎকালিন ইংরেজ সরকার। মৌলবী মুহাম্মদ আসগরের 1857 এর সেই আবেদনের পর ব্রিটিশ সরকার প্রায় দুবছর পর 1859 এ প্রথম এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, ইংরেজদের মাথাতেও জটিল ধর্মীয় সংকটের কথা এসেছিল, তৎকালিন প্রশাসন একটি সহজ সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করে, মন্দির ও মসজিদের মাঝে একটি দেওয়াল তুলে দেয়, যাতে উভয় ধর্মই বিচ্ছিন্ন ভাবে নিজ-নিজ ধর্মাচার সুষ্ঠু ভাবে করতে পারে। হিন্দুদের জন্য প্রবেশের পথ করা হয়েছিল পশ্চিম দিকে এবং মুসলিমদের জন্য উত্তর দিকে, কিন্তু  1860 থেকে 1884 এর মধ্যে মুসলিমরা এ বিষয়ে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করে বারবার আবেদন জানায় যে কিছু স্থানীয় সাধু-সন্ন্যাসী হিন্দু পূজারী জোর করে মসজিদে ঢুকে পড়ে অবৈধ ভাবে জমি দখল করে নিয়েছে। 1860 তে প্রথম এ বিষয়ে করা আবেদনের পর ক্রমান্বয়ে 1877, 1883 এবং 1884 তে তারা পরপর আবেদন একই  করতে থাকে, একই বিষয়ে। যদিও এই সব আবেদনই খারিজ হয়ে যায় তৎকালিন আদালতে। এবার 1885 এ হিন্দুদের পক্ষ থেকে প্রথম আইনতভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন মহন্ত রঘুবর দাস, তিনি ওই বিতর্কিত জমিটিকে আইনি উপাধি দেওয়ার জন্য এবং পশ্চিম দিকের প্রাঙ্গন বা '‌চবুত্র’‌তে মন্দির নির্মাণ করার জন্য আদালতে আবেদন করেন, তিনি তাঁর আবেদনে আরও দাবি করেন যে তিনি হলেন ভগবান রামের জন্মস্থানের মহন্ত এবং এই '‌চবুত্র’‌তেই রাম জন্মেছিলেন, অর্থাৎ প্রায় একশো তেত্রিশ বছর আগে থেকেই দেখা যাচ্ছে, অন্তত এই আবেদনকারীর আবেদন অনুযায়ী '‌চবুত্র’‌কেই রামজন্নমভূমি হিসাবে দাবি করে আসছে হিন্দুরা, তাই এই বিতর্ককে যারা হঠাৎ তৈরী হওয়া বিজেপির চক্রান্ত বলছে তারা সত্যের অপলাপ করছেন মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন ! যাইহোক ইংরেজ আমলের আদালতে সেই আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। এইভাবেই চলতে থাকে দাবি পালটা দাবি, সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্ব। এরপর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়, আর এই স্বাধীনতা পাওয়ার দু বছরের মধ্যে 1949 এ বিতর্কিত ধাঁচার মূল গম্বুজের মধ্যে নিয়ে আসা হল রাম লালার মূর্তি। তারপর 1950 এ রামলালার মূর্তিগুলোর পুজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করলেন গোপাল শিমলা বিশারদ। 1950 তেই আবার সেই মূর্তি রেখে দেওয়া এবং পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একটি মামলা করলেন পরমহংস রামচন্দ্র দাস। এরপরই শুরু হয়ে যায় যুগান্তকারী দীর্ঘ একের পর এক মামলার,  1959 এ ওই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করল নির্মোহী আখড়া। 1961 এ ওই একই দাবি জানিয়ে মামলা করল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড, এই পর্যন্ত মোটামুটি মামলা মকদ্দমার মধ্যে দিয়েই চলছিল, কিন্তু 1986 এ রাজীব গান্ধী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেই সময় ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দেবকী নন্দন আগরওয়ালের মাধ্যমে আবার একটি মামলা দায়ের করা হয়,1989 এর 14 আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্ট আবার নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে, তারপর 1990 তে ডিসেম্বরের 25 তারিখে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন এবং 1992 এর 06 ডিসেম্বর করসেবকরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়, ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে ওঠে, সরাসরি বিভাজন শৃষ্টি হয় হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে।  এরপর 03 এপ্রিল, 1993 তে অযোধ্যার জমি অধিগ্রহণ করার জন্য বিতর্কিত এলাকার অধিগ্রহণ আইন পাস করা হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই আইনের বিভিন্ন বিষয়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রিট পিটিশনও জমা পড়ে। সংবিধানের 139 A অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ওই রিট পিটিশন বদলি করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট, 1994 এর 24 এপ্রিল, সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক ইসমাইল ফারুকি মামলায় রায়ে জানায়, মসজিদ ইসলামের অন্তর্গত ছিল না।  1994 এর 7 আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা আবেদনের শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট তিন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করে। 2002 এ এপ্রিল মাসে বিতর্কিত স্থলের মালিকানা নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। 2003 এর 13 মার্চ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, অধিগৃহীত জমিতে কোনও রকমের ধর্মীয় কার্যকলাপ চলবে না।  14 মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আরও জানায়, এলাহাবাদ হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ কার্যকর থাকবে। 2010 এর 30 সেপ্টেম্বর, এলাহাবাদ  হাইকোর্ট রায় দেয়, বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেয়া হোক, যদিও এই রায়ে তিন বিচারপতি অবশ্য সহমত পোষণ করেননি, এই রায়ের পক্ষে 2-1 এর ভিত্তিতে রায়দান হয়েছিল।  2011 এর 9 মে অযোধ্যা জমি বিতর্কে হাইকোর্টের রায়ে আবার স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। 2016 এর 26 ফেব্রুয়ারি আবার ওই বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির তৈরির অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। 2017 এর 21 মার্চ প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর দুই পক্ষকে আদালতের বাইরে সমঝোতার এক প্রস্তাব দেন অনন্ত কাল ধরে চলা এই বিতর্কের নিষ্পত্তি ঘটাতে, একইসঙ্গে আবার 2018 এর 08 ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ের সমস্ত দেওয়ানি মামলার আবেদনের শুনানি শুরু হয়। 14 মার্চ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সহ সকল অন্তর্বর্তী আবেদন (যারা এই মামলার পক্ষ হতে চেয়েছিল) নাকচ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।   06 এপ্রিল, বৃহত্তর বেঞ্চে 1998 সালের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ ছিল তা  পুনর্বিবেচনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালেন রাজীব ধাওয়ান, 20 জুলাই সুপ্রিম কোর্ট রায়দান স্থগিত রাখে।

27 সেপ্টেম্বর পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা নিয়ে যেতে অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট এবং জানানো হয়, 29 অক্টোবর থেকে মামলার শুনানি হবে নবগঠিত তিন বিচারপতির বেঞ্চে। 29 অক্টোবর 2018 এ সুপ্রিম কোর্ট যথাযথ বেঞ্চে মামলার শুনানি স্থির করে, এবং জানায় ওই বেঞ্চই শুনানির দিন ধার্য করবে। সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিল, এ সম্পর্কিত সমস্ত আবেদনের শুনানি হবে  04 জানুয়ারি থেকে, 2019 এর 04 জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আবার জানায়, তাদের তৈরি করা যথোপযুক্ত বেঞ্চ মামলার শুনানির তারিখ 10 জানুয়ারি স্থির করবে। 2019 এর 08 জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করে, শীর্ষে রাখা হয় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে। এ ছাড়া বেঞ্চের অন্যান্য বিচারপতিরা হলেন এস এ বোবদে, এনভি রামানা, ইউইউ ললিত এবং ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। কিন্তু 10 জানুয়ারি অদ্ভূত ভাবে মামলার শুরুতেই  বিচারপতি ইউ ইউ ললিত নিজেকে মামলা থেকে সরিয়ে নেন! সুপ্রিম কোর্ট বলেন 29 জানুয়ারি নতুন বেঞ্চের সামনে মামলার শুনানি শুরু করতে হবে, দীর্ঘসূত্রিতা চলতেই থাকে, 25 জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আবার নতুন করে পাঁচ সদস্যের নতুন সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে, নতুন বেঞ্চের শীর্ষে রাখা হয় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে আর বাকি সদস্যরা হলেন যথাক্রমে, বিচারপতি এসএ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস এ নাজির।29 জানুয়ারি কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বিতর্কিত অংশ বাদ দিয়ে বাকি 67 একর জমি তাদের আদত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবার আবেদন জানায়। 20 ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ওই মামলার শুনানি শুরু হবে 26 জানুয়ারি থেকে।  সুপ্রিম কোর্ট আবার ঘুরেফিরে 26 ফেব্রুয়ারি সেই মধ্যস্থতার কথাই আবার বলে, এক বিচিত্র অবস্থা তৈরী হয়, এই তিব্র ধর্মীয় বিতর্ক নতুন মোড় নেয়। 
আদালত নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারীদের কাজে লাগানো হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আবার একটি শুনানির দিন স্থির হয় তারপর 5 মার্চ, এরপর সাপলুডো খেলা চলতে চলতেই, সুপ্রিম কোর্ট 6 মার্চ এ জমি বিতর্ক মধ্যস্থতার মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে কিনা সে সম্পর্কিত রায় দান মুলতুবি রাখে।  09 এপ্রিল কোর্টে নির্মোহী আখড়া কেন্দ্রের করা জমি ফেরানোর আবেদনের বিরোধিতা করে। এর মধ্যে 09 মে তিন সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি সুপ্রিম কোর্টে  তাদের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেয়। 18 জুলাই আবারও সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতা চালিয়ে যেতে বলে এবং মধ্যস্থতাকারীদের 01 অগাস্ট রিপোর্ট জমা দেওয়ার দিন ধার্য করে। চুড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে 01 আগস্ট মধ্যস্থতা সংক্রান্ত রিপোর্ট বন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে জমাও পড়ে।প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয়, কি আছে ওই রিপোর্টে! শেষপর্যন্ত যদিও কোনো সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসেনি ওই রিপোর্ট থেকে ! সুপ্রিম কোর্ট 06  আগস্ট দীর্ঘসূত্রিতার অবসান ঘটাতে জমি মামলায় দৈনিক ভিত্তিতে শুনানির কথা ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে 16 অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে সব শুনানি শেষ হয়, রায়দান যদিও মুলতুবি রাখা হয়েছিল।                                              বিতর্কিত অযোধ্যা মামলায় অবশেষে ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এর নেতৃত্বে শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় (09/11/ 2019)। অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করলেন, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির হবে। বিকল্প পাঁচ একর জমি পাবে মুসলিমদের পক্ষের ‘সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড’। আদালত সূত্রে খবর, সর্বসম্মতিক্রমেই এই রায় ঘোষণা হয়েছে।

সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের  আইনজীবী জাফরাইব জিলানি বলেছেন, ‘‘আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্মান জানাই। তবে এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করব।’’  কাউকে কোনও রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রাস্তায় না যাওয়ারও আর্জি জানিয়েছেন জাফরাইব, অন্য দিকে হিন্দু মহাসভার আইনজীবী বরুণ কুমার সিংহ বলেছেন, ‘‘এটা ঐতিহাসিক রায়, এই রায়ের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দিয়েছে।’’

প্রধান বিচারপতি ছাড়াও  বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এসএ বোবদে, ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস আব্দুল নাজির। এই রায় পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি ইতিহাসের স্নাতক রঞ্জন গগৈ, রায়ে শীর্ষ আদালত আরও জানিয়েছে, মূল বিতর্কিত জমি পাবে ‘রাম জন্মভূমি ন্যাস’, এই জমিতে মন্দির তৈরিতে কোনও বাধা নেই। তবে কেন্দ্রকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করতে হবে, ওই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই থাকবে বিতর্কিত মূল জমি, কী ভাবে, কোন পদ্ধতিতে মন্দির তৈরি হবে, তারও পরিকল্পনা করবে এই ট্রাস্ট। অন্য দিকে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে যে বিকল্প পাঁচ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ, সেই নির্দেশে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনও জায়গায় ওই জমির বন্দোবস্ত করতে হবে সরকারকে।                   

অযোধ্যা রায়কে অবশ্যই স্বাগত জানিয়েছেন কিছু কিছু মুসলিম ধর্মীয় নেতারা, তাঁরা জানিয়েছেন, দেশের দীর্ঘদিনের একটি বিতর্কের অবসান হল, এই রায়কে তাঁরা সম্মান করেন। এখন দেখার যে মসজিদ তৈরির জন্য তাঁদের কোথায় জমি দেওয়া হয়। রায়কে স্বাগত জানিয়েছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ড। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডের তরফে জানানো হয়েছে তারা সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম মানতে বাধ্য। তারা এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে। দেশ জুড়ে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা। এআইএমপিএলবি-এর চূড়ান্ত বিবৃতি তারা তাদের আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে স্থির করবে ও জানাবে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ, তার আগে তাদের ল বোর্ড পুরো রায় পড়ে দেখবে বলেও জানানো হয়েছে।                                                এবার আদালত থেকে বেরিয়ে একটু মাটির নিচে প্রবেশ করতে হবে, দেখে নেওয়া যাক ভূতাত্ত্বিকরা  কি কি প্রমান খুঁজে পেয়েছেন যার ভিত্তিতে বলা যায় যে মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ কোনো এক প্রচীন মন্দির বা অমুসলিম সৌধের ওপর তৈরী করেছিলেন আনুমানিক 1528 সালে।

এএসআই এর প্রাক্তন অধিকর্তা কেকে মহম্মদ জানিয়েছেন, যখন তারা ভিতরে গিয়েছিলেন, তারা মসজিদের বারোটি পিলার দেখেছিলেন যা মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ওপর থেকেই তোলা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন এবং বারো-তেরো শতকের মন্দিরের মতো পূর্ণ কলসেরও হদিশ তারা সেখানে পেয়েছিলেন। খনন কার্য চালানোর সময় প্রচুর পোড়ামাটির ভাস্কর্যের হদিশ তারা পেয়েছিলেন। এটা যদি আদি-অকৃত্রিম এবং শুরু থেকেই মসজিদ হত, তাহলে মসজিদের নীচে পোড়ামাটির ভাস্কর্য কখনও পাওয়া যেত না, এর অর্থ, প্রাচীন কালের মন্দির বা অমুসলিম সৌধের ওপর ই বাবরি মসজিদের নির্মাণ হয়েছিল।

এরপর আবার আরও তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বার খননকার্য  চালানো হয়, দ্বিতীয় খনন কার্যে আবার পঞ্চাশটির বেশি পিলারের বেস পাওয়া গিয়েছিল, যা ছিল সতেরো টি সারিতে। যার থেকে বলা যায়, প্রাচীন কাঠামোটি বেশ বড় ছিল। এইসব পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে বলা যায় বাবরি মসজিদের তলার কাঠামোটি আনুমানিক বারো শতকের, মোগলদের ভারতবর্ষে আসার অনেক আগের। এছাড়া মন্দিরের ওপরে কলসের নিচে নতুন ধরনের কাঠামো পাওয়া গিয়েছে, যা অমলকা নামেই পরিচিত, অমলকার নিচে রয়েছে গ্রিবা এবং শিকারা, যা উত্তর ভারতের মন্দিরেই দেখতে পাওয়া যায়। খনন কার্য চালিয়ে সেখান থেকে 263 টি পোড়ামাটির জিনিস পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব দেবী, মানুষের এবং মহিলার শরীরের মতো জিনিস, যদি এই সৌধ শুধু মসজিদই হত, তাহলে পোড়ামাটির জিনিস কিংবা মানবাকৃতির জিনিস পাওয়া যেত না, কারণ ইসলামে এইসব জিনিস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তাই বাবরি মসজিদের নীচে যে কোনো প্রচীন মন্দির ছিলই সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়াও  সেখান থেকে বিষ্ণু হরি শিলা ফলকের শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছে দুটি ভাগে, সেটি খনন কার্যস্থলে পাওয়া না গেলেও, যেখানে বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, সেখানেই পাওয়া গিয়েছে এগুলি।

এবার অবশ্যই হিন্দু ধর্মীয় আবেগের কথা আলোচনা করতে হবে, কারণ খুব স্পষ্ট, ধর্ম মানেই মানুষের বিশ্বাস আর আবেগ। হিন্দু শাস্ত্র মতে রাম হলেন হিন্দু  দেবতা, বিষ্ণুর সপ্তম-অবতার, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে তাকে  অযোধ্যার রাজাও বলা হয়েছে। সপ্তম অবতার রাম ও অষ্টম অবতার কৃষ্ণ  হলেন বিষ্ণুর অবতারদের  মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুধর্মে শ্রীরাম বহু যুগ ধরে অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। ভারতবর্ষ ছাড়া নেপাল এমনকি থাইল্যান্ডেও তার পূজার বহুল প্রচলন দেখা যায়। হিন্দুধর্মে রাম-উপাসনা কেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে রামকে বিষ্ণুর অবতার না বলে সর্বোচ্চ ঈশ্বর হিসেবে মান্য করারও প্রবণতা দেখা যায়। রাম সূর্যবংশে (ইক্ষ্বাকু বংশ বা পরবর্তীকালে ওই বংশের রাজা রঘুর নামানুসারে রঘুবংশ নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রামের একটি বিশেষ মূর্তিতে তার পাশে তার ভাই লক্ষ্মণ, স্ত্রী সীতা-দেবী  ও ভক্ত হনুমানকে দেখা যায়। এই মূর্তিকে বলা হয় "রাম পরিবার"। অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরে এই "রাম পরিবার" মূর্তির পূজাই বেশি হতে দেখা যায়। ধর্মীয় অনুভূতিকে গুরুত্ব দিলে অবশ্যই হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা শ্রীরামের জন্মভূমি অযোধ্যার গুরুত্ব অপরিসীম অন্তত হিন্দুদের কাছে, যেরকম মক্কা মুসলিমদের কাছে। তাই আশা করা যায়  ঐতিহাসিক ভাবে বা ধর্মীয় আবেগের বিচারে বাবরি মসজিদের গুরুত্ব মুসলিমদের কাছে যতটা তার থেকে রাম মন্দিরের গুরুত্ব হিন্দুদের কাছে সহস্র গুণে বেশি। ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ যেখানে সংবিধানে সংখ্যালঘুদের ধর্ম রক্ষার অধিকারের ব্যাপারে বলা আছে, বহু যুগ ধরে ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের একসাথে বসবাস, এই ধর্ম নিরপক্ষেতার ইতিহাস ভারতবর্ষের গৌরবের  ইতিহাস, তাই মসজিদ, মন্দির বা গির্জার পাশাপাশি আমদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যও মহান।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours