দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

“ফিরতে পারব, বাড়িতে বাবা, মা, বৌ ছেলে মেয়েদের মুখ দেখতে পারব, ভাবিনি কোনদিন!”- প্রথম প্রতিক্রিয়া বাড়িতে ফিরেই আপেল বাগানের শ্রমিকদের! বীরভূমের মুরারই ২ নম্বর ব্লকের মিত্রপুর অঞ্চলের আট শ্রমিক  তাদের মধ্যে নয়াগ্রামের ৬, দাঁতুড়া ও ভাগাইল গ্রামের ২ জন।  আলাউদ্দিন সেখ, সামিরুল বাসার, আসগর আলি, আব্দুল খালেক, রফিকুল ওরফে ডাবলু ইসলাম, ইব্রাহিম সেখ, নাজিমুদ্দিন সেখ ও  নইমুদ্দিন সেখ।  ইব্রাহিম সেখ জানায়,  ওত রাতে পরিবারের সবাই জেগে ছিলেন। বাকি ছিল না পরিবারের ছোট সদস্যও। বাড়ি পৌঁছানোর পর শুরু হয়ে যায় কান্নার রোল! এখন শুধু একটাই চিন্তা খাব কি!

যদিও, পরিবারে সকলকে পেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেল মনে করছে শ্রমিকেরা। তবুও মনের পিছনে কোথাও যেন খচ খচ করে লাগছে! অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে পরিবারের মুখেচোখে।  আসগর আলির জানান, তাঁর বছর তিনেকের ছেলে রেজাউল সেখের ব্রেন টিউমার। কোলে ছেলেকে নিয়ে কান্না ভেজা গলায় জানালো, টাকা পয়সা নিয়ে ফিরতে পারলাম না! ছেলেকে বাঁচাবো কি করে! আসগর আলির বাবা, নূর হোসেন বলেন, আমরা বড় অসহায়! 

বর্ষাপুকুর পঞ্চায়েতের অধীন নয়াগ্রামের বদিপুকুর পাড়ায় বাড়ি আলাউদ্দিন সেখের। তিনি বলেন,  বড় ছেলে সোলেমান সেখ, ওসমান সেখ, ও মেয়ে রিজিয়া সুলতানা। নয়াগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতূর্থ শ্রেণীতে পড়ে সোলেমান। চার বছরের ওসমান প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়ে রাজিয়া দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। এরা সবাই আমার জন্য ওত রাতে জেগেছিল। তারপর তিনি জানান,  তিন বছর আগে এক দূর্ঘটনায় সোলেমানের বাম হাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয় যায়। হাতে রড লাগাতে হয়। ডাক্তার বলেছিলেন অপারেশন করে রড বের করতে হবে।  কিন্তু অর্থের অভাবে সেই রড আর বের করা সম্ভব হয় নি। ভেবেছিলাম, টাকা পয়সা নিয়ে রডটা বের করবো।

মঙ্গলবার রাত দুটোয় বাড়ি পৌঁছায় সবাই। বাড়ি ফিরে  এরা কেউ আর কাশ্মীরে যেতে চান না। গত রাতে তারা চিৎপুর স্টেশনে নামে। সেখান থেকে রাজ্যে সরকারের তত্ত্বাবধানে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়। সকলেই কাশ্মীরের বারমুল্লার কার্নিসপুরে কাজ করতে গিয়েছিল। আসগার আলি জানালেন ১০ বছর ধরে কাশ্মীরে কাজ করছি। এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো দেখেনি। রাতে ভালো করে ঘুম হত না।কাশ্মীরে লোকেরা বলত তোমারা এখান থেকে চলে যাও। যত তাড়াতাড়ি পার চলে যাও। সেই ভয়েই আমরা পালিয়ে এসেছি।আমরা রাজ্য সরকারে কাছে আবেদন করব। যে আমাদের কে যাতে আর কাশ্মীর কাজ করতে না যেতে হয়। এই রাজ্যে যেন আমরা কাজ করতে পারি। কাশ্মীর থেকে বাড়ি ফিরে সামাউল বাসার বলেন,অভাবী সংসার তার জন্য কাশ্মীরে যাই কাজের জন্য। কাশ্মীরে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই খারাপ।

চিৎপুরে ট্রেনে নামার পর বীরভূমের আটজনের জন্য একটি সরকারি বাস দেওয়া হয়। কোলকাতায় ট্রেন থেকে নামা মাত্র  সেখান থেকে সরাসরি সরকারি বাসে মুরারইয়ের ভাগাইলে পৌঁছায় শ্রমিকরা।  সেখান থেকে গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দেয় পুলিশ। আলাউদ্দিনরা জানায়, এক মাসে ৩০ হাজার টাকা ক্ষতি হল। সকাল সন্ধ্যায় ওভার টাইম করতাম।  সকাল ৯টায় কাজে যেতাম। কাজ করতাম ৫ টায়। মাঝে ১টায় খাবার খেতে আসতাম। মোটা চালের ধান হয়। এই কাজে সাড়ে ছশো টাকা দৈনিক মজুরি ছিল। আফশোষ দিদির সাথে দেখা হল না। দিদির সাথে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। দিদিকে অভাব অভিযোগের কথা সরাসরি জানালো হল না। আমরা কোন টাকা পয়সা নিয়ে ফিরতে পারি নি। পাঁচজন শ্রমিক মরে যাওয়ার আতঙ্কে আমরা বাড়ি ফিরেছি। যদি একটা কাজের ব্যবস্থা রাজ্যে হয়, আমরা বাইরে যাব না।  প্রায় দেড় মাস খাটলাম। রাজমিস্ত্রির কাজ, ধান কাটা, আপেল পাড়া এসবের কাজ করতে হত।  আমরা সব সময় আতংকিত ছিলাম। এর জন্য আমরা ওখানকার প্রশাসন কে জানিয়ে ছিলাম বাড়ি ফেরার জন্য। ওনারা আমাদের কে সাহায্য ও করেছে।  সাহায্য করেছে বাংলা সংস্কৃতিমঞ্চ।  বাড়ি ফিরেও এখনো মনের মধ্যে একটা ভয়, এখানে খাব কি?

এলাকার বিধায়ক আব্দুর রহমান বলেন, আমারা রাত্রি  ২টো সময় তাদের গ্রামে গিয়ে পোছে দিই।আমারা এই সব মানুষদের জন্য কোনো প্রকল্প করা যায় কিনা সেটা আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কাছে আবেদন করা হবে।মুখ্যনন্ত্রী নিশ্চয় ভাবছে। নিশ্চয় একটা মানবিক প্রকল্প এদের জন্য বের করবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours