গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

শুরু হয়ে গিয়েছে কামডাউন। আর মাত্র কয়েকটা প্রহর। এরপর শহর থেকে গ্রাম সেজে উঠবে আলোর মালায়, সামনেই কালিপুজো আর দেওয়ালি, দেওয়ালি বা দীপাবলি যে নামেই ডাকা হোক না কেন আসলে তো আলোর উৎসব, অশুভ শক্তির অন্ধকার কে দুরে সরিয়ে আলোর শুভ শক্তির আরাধনা ই হলো দীপাবলি। একটা সময় ছিল যখন এই দেওয়ালি বলতেই চোখের সামনে যে মনোরম ছবিটা ভেসে আসতো, দেওয়ালির দিনে সব বাড়িগুলি সেজে উঠত মাটির নানান প্রদীপে, আর সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে গৃহবধূরা বাড়ির সদস্যদের মঙ্গল কামনা করত। আজ আমরা আধুনিক যুগে সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরম্পরাও বদলে ফেলেছি একেবারে। নতুন জেনারেশনের কাছে মাটির প্রদীপের চাহিদা বা আকর্ষণ এখন কমে গেছে বা নেই বলাই যেতে পারে, বাজার ছেয়ে গেছে রকমারি চিনা আলোর সম্ভারে, সস্তা অথচ চটকদার টুনি বাল্বের চেন, তাদের আলোর ছটা অনেক উজ্জ্বল অনেক রকমারি, আর তাতেই মজেছে সমাজের অধিকাংশ মানুষ। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি দেশাত্মবোধক বক্তৃতা দেওয়া আম-আদমির পছন্দ এখন এই চোখধাঁধানো চিনা আলো, বাড়ী সাজানোর অশুভ প্রতিযোগিতায় অন্ধ হয়ে দেশীয় প্রদীপের শুভ আলো হারাতে বসেছে জ্ঞানপাপি মানুষের দল! 
তবে চাহিদা কমলেও একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়নি এখনো এই মাটির প্রদীপ৷ এখনও গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত মেঠো পথে পৌছে গেলে চোখে পড়ে সেই পুরনো ছবি, এই চেনা ছবির দেখা অবশ্যই এই শহরের বুকেও মেলে, এখনো অনেক বাড়ীতেই এই ভূত চতুর্দশীর দিনে অনেকেই পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে মাটির প্রদীপ জ্বালায়৷ তবে তা সংখ্যায়  এতোই সামান্য যে ব্যবসার অংকে একে বারেই তা নগণ্য, ফলে প্রাচীন গ্রাম-বাংলার কুমোর শিল্পীরা আজ গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে , কাজের অভাবে পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছে অনেকেই, পূর্বপুরুষদের বংশপরম্পরায় শৃষ্টি হস্তশিল্পিকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, জীবন সংগ্রামে মহা বিপদের সামনে আজ এই কুমোররা।
এক একটি কুমোর পরিবারে দেখা যায় শুধু প্রদীপ নয়, সারা বছর মাটির নানা ধরনের জিনিস তৈরি করেন তারা, আর সেসব বিক্রি করেই সংসার চলে ওই পরিবারগুলির। তবে এই দীপাবলির সময় তাঁদের ব্যস্ততা বেড়ে যেত একসময়, বিশেষত লক্ষ্মীপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকতো না এদের, নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন হরেক রকম প্রদীপ তৈরী করতে ব্যস্ত থাকতো, তাছাড়া মাটির তৈরি সরা, ঘট ইত্যাদির চাহিদাও চুড়ান্ত বাড়তো এই সময়টায়।
আর এই সময়ের রোজগারেই গোটা বছরের সংসার খরচা তুলে নেওয়ার সুযোগ ছিল। এমন একটা সময় ছিল, যখন সারা বছরই কুমোরদের বসে থাকার সুযোগ ছিল না, গরমের সময় কলসি, কুঁজো থেকে শুরু করে পৌষ-পার্বণের পিঠে বানানোর মাটির সরা তৈরি, কাজের অভাব ছিল না, তবে এখন অবশ্য সেই দিন আর নেই, চিনা জিনিসের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ মাটির জিনিসই কার্যত হারিয়ে গেছে, মাটির ভাঁড়ের চা এর স্বাদ নিতে হচ্ছে কাগজ বা প্লাসটিকের  কাপে। তবুও কিছুদিন আগেও কালীপুজোর সময় প্রবল চাহিদা বৃদ্ধি পেতো এই মাটির প্রদীপের, বাংলার রীতি পরম্পরা মেনে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে মাটির প্রদীপ জ্বালানোর ই রেওয়াজ ছিল। চিনা বাল্বের আলো হয়তো অনেক উজ্জ্বল প্রদীপের শিখার থেকে, তবে যতই চিনা আলোয় দীপাবলির রাত ঝকমক করুক না কেন এখনও কিন্তু মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ  আলো দীপাবলিকে অনেক   মনোরম করে তোলে।                                                      তবে আশার কথা এই যে, গত কয়েক বছরে আগের তুলনায় প্রদীপের বিক্রি সামান্য হলেও বেড়েছে, বাজারে এসেছে রকমারি নানান ধরনের নতুন রঙিন প্রদীপ, অসাধারণ সুন্দর চেহারায় আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রদীপ, মানুষ আবার সামান্য হলেও ঝুঁকেছে প্রদীপের দিকে, নতুন করে আবার আগ্রহ তৈরি হয়েছে মাটির প্রদীপ নিয়ে।কিন্তু একটা গভীর সমস্যাও তৈরি হচ্ছে কুমোরদের, প্রতিযোগীতার বাজারে তাদের লাভের পরিমাণ কমে গেছে এক ধাক্কায় অনেক, যে হারে মাটি কিংবা জ্বালানির দাম বেড়েছে, সেভাবে বাড়েনি মাটির সরা, প্রদীপ বা ঘটের দাম, ফলে ব্যবসা সামান্য বাড়লেও তাঁদের আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং লড়াই করতে করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। প্রতিযোগিতার বাজারে শক্তিশালী চীনকে হারিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের এই কুটির শিল্পকে গতি দিতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। সরকার যদি সঠিক ভাবে তাদের গঠনমূলক কোনো সাহায্য করে বা এই মৃৎশিল্পের প্রতি একটু নজর দেয় তাহলে হয়তো এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে, নাহলে আস্তে আস্তে একদিন নিভে যাবে প্রদীপের এই স্নিগ্ধ শিখা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours