শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:

শব্দটি 'ডুয়ার্স' কেন? অনেকেই জানি 'দুয়ার' শব্দটি ইংরেজদের মুখে 'ডুয়ার্স' হয়ে গিয়েছিল। তাহলেও প্রশ্ন থাকছে 'দুয়ার' কেন? 
আসলে সমভূমি থেকে উত্তরে পাহাড়পথে ভূটানে যাবার জন্য ছিল আঠারোটি পথ বা দুয়ার। বহুবচনে দুয়ারগুচ্ছ। ইংরেজরা DOOARS বা ডুয়ার্স বেছে নেয়। (তথ্যসূত্র: সার্জন রেনি- BHOTAN AND THE STORY OF DOOAR WAR)। হিন্দুস্থানী 'দ্বার' বা ইংরেজি DOOR থেকেই 'দুয়ার' শব্দটির উদ্ভব। 
একটু দেখে নিই এই আঠারোটি 'দুয়ার' কি কি-
ডালিমকোট (বর্তমান দার্জ্জিলিং জেলায়), ময়নাগুড়ি বা জুমের কোর্ট , চামুর্চি বা সামচি, লক্ষ্মী বা লাককি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), বকসা বা পাশাখা, ভলকা বা ভুলকা (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলায়), বরা, গুমর, রিপো ( বর্তমানে আসামের কোকড়াঝাড় জেলায়), চেরাঙ বা ছেরাঙ (আসামের গোয়ালপাড়া জেলায়), বাগ বা ছোটা বিজনি (আসামের বর্তমান বিজনি), বুড়িগুমা, কালিং ( বর্তমানে আসামের দরং জেলায়), শুরকোল্লা, বংসকা, চাপাঘোরি বা চাপাগুড়ি, চাপাঘামা, বিজনি (বর্তমানে আসামের কামরূপ জেলায়)।

প্রথম এগারোটি জায়গা পূর্বে বেঙ্গল ডুয়ার্স (তিস্তা থেকে মানস পর্যন্ত) ও বাকি সাতটিকে (মানস থেকে ধানসিরি নদী পর্যন্ত) বলা হত আসাম ডুয়ার্স। এখন অবশ্য ডুয়ার্স বলতে তিস্তা থেকে সংকোশ নদী পর্যন্ত এলাকাকেই বোঝায়। ১৮৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারিতে জলপাইগুড়ি জেলা গঠিত হবার পর ডুয়ার্সের বেশীর ভাগ অংশই ছিল জলপাইগুড়ি জেলায়। পঁচিশে জুন, ২০১৪ জলপাইগুড়ি জেলা বিভক্ত হয়ে আলিপুরদুয়ার জেলা গঠিত হলে বর্তমানে আলিপুরদুয়ার জেলাতেও ডুয়ার্সের অনেক অঞ্চল সেই জেলার অন্তর্ভূক্ত। 

অন্যদিকে চা-বাগা হল ডুয়ার্সের প্রাণ। দিগন্তবিস্তৃত তরঙ্গায়িত চা-বাগান, চা-বাগানের মাঝে থাকা শেড ট্রি, চা-বাগান শ্রমিকদের চা পাতা ছেঁড়া...পিকচার পোস্ট কার্ড সব যেন!
কিন্তু এই জল-জংলার দেশে চা বাগান এলো কোথা থেকে? এখানে তো শুধু জঙ্গল আর হিংস্র প্রাণী ছিল। সেখানে এত সুন্দর চা-বাগান যার থেকে দৃষ্ট ফেরানো যায় না!
উত্তরটা লুকিয়ে ইতিহাসের পাতায়। 
আসলে চিনের চা মন কেড়েছিল ইউরোপবাসীর, বিশেষ করে ইংরেজদের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে নি। চিনের সাথে একচেটিয়া ব্যবসায় মুনাফা লুটছিল তারা। কিন্তু অবস্থা পালটাল ক্রমে। অন্য কোম্পানীরাও চিনের সাথে নেমে পড়ল ব্যবসায়। অগত্যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যেনতেনপ্রকারেণ চাইছিল চা চাষের ব্যবস্থা করতে। ভাগ্যও ছিল সুপ্রসন্ন। ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস আসামের জঙ্গলে আবিষ্কার করলেন চা গাছ। ব্যস বানিয়া ইংরেজ আর দেরী করে নি আসামকে কব্জা করতে। ১৮২৫ সালে আসাম চলে এলো কোম্পানীর অধীনে আর ১৮৩৮ সালে আসামের চা উঠল লন্ডনের আন্তর্জাতিক বাজারে। স্বাদে গন্ধে সেই চা অতুলনীয় হওয়ায় আসাম বা ভারতের চায়ের কদর বাড়তেই লাগল। ইংরেজরাও বুঝে গেল এই চা দিয়েই তাদের ভাগ্য গড়ে উঠতে পারে। অতএব চল ভারত চা বাগান তৈরী করতে।
১৮৪১ সালে ডঃ ক্যাম্বেল দার্জিলিঙে নিজের বাড়িতে চা গাছ পুঁতে সফল হলে দার্জিলিং পাহাড় চা-বাগানে ছেয়ে যেতে সময় নেয় নি বেশীদিন। এক্ষেত্রে মেজর গ্রামলিনের ভূমিকাও বিরাট। কিন্তু ডুয়ার্সও যে চা-বাগানের জন্য উপযুক্ত সেটা বুঝতে সময় লেগেছিল। তাই ডুয়ার্সে চা-বাগান প্রথম তৈরী হয় ১৮৭৪ সালে। অল্পদিনেই ডুয়ার্সও ছেয়ে গেল চা বাগানে আর চা বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে লাগল আজকের ডুয়ার্সে ছড়িয়ে থাকা নানা শহর......

(নিজের পড়া ও ঘাঁটাঘাটির সুবাদে এই তথ্যপ্রাপ্তি। ভুল থাকতেই পারে। অনুগ্রহ করে এই ব্যাপারে আরও কিছু জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।)

ছবি: লেখক


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours