গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:
                                     কপালকুণ্ডলা মন্দিরের কথা মনে আছে, এখনো কপালকুন্ডলার সাথে নবকুমারের নামটা একসাথে উচ্চারণ হলে কিন্তু গা ছমছম করে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য, খড়্গ হাতে এক কাপালিক আর সমুদ্রের তীরে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা এক মন্দিরের নরবলির ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত কপলাকুণ্ডলা মন্দিরটি আছে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের দরিয়াপুরে, যা আজ ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে অবহেলায় পড়ে আছে, এমনকি দীপাবলির রাতেও এখানে আজ আর প্রদীপ জ্বলে না! রসুলপুর নদীর মোহনায় দরিয়াপুরের এই কপালকুণ্ডলা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে। এখানেই নাকি কাপালিকরা তন্ত্রসাধনার জন্য নরবলি দিতেন একসময়, মন্দিরে 'নরবলি' দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে আসা নবকুমারের সঙ্গে কপালকুণ্ডলার এক অসাধারণ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এখানেই , এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের জন্য আজ সত্যি নরবলির কিছু গল্প বলি :-                দেবস্থানে নরবলির প্রথা এই ভারতে বেশ ভাল মাত্রাতেই প্রচলিত ছিল একসময়, তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য আর কিংবদন্তি গল্পে। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের ‘কপালকুণ্ডলা’-তে পর্যন্ত নরবলি দিয়ে আরাধ্য দেবীর পুজোর উল্লেখ রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সেই সব শিউরে ওঠা ঘটনা বন্ধ হলেও আজও কিন্তু নরবলির ঘটনা কালেভদ্রে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে। নরবলি বন্ধ হলেও এখনও এদেশের বিভিন্ন দেবস্থানে পশুবলির বিষয়টি চলে আসছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু এমন মন্দির আছে এই পশ্চিমবঙ্গেই, যেখানে বছরের একটি বিশেষ দিনে আজও নররক্ত দিতেই হয় দেবীকে পুজোর উপাচার হিসেবে। ইতিহাস বা স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, কোচবিহারের বড়দেবীর মন্দিরে বিশু আর শিশু নামে দুই ভাই বড়দেবীর উপাসনা শুরু করেন। বিশু অর্থাৎ কোচবিহারের তৎকালীন রাজা বিশ্ব সিংহ  স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এইভাবে দেবী উপাসনা করার ব্যাপারে, জানা যায় 1600 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই পুজোর সূচনা হয়। এই দেবী আসলে দেবী দুর্গা হলেও এর চেহারা বেশ ভয়ংকর, গায়ের রং টকটকে লাল আর তিনি যে অসুরকে নিধন করছেন তার গায়ের রং সবুজ। দেবীর এখানে দুটি বাহন, একটি হলো সিংহ যে অসুরের পায়ে কামড়ে ধরে রয়েছে আর একটি হলো বাঘ যে অসুরের হাতে কামড় বসিয়েছে, আর দেবীর দুপাশে অবস্থান করছেন, দেবীর দুই সখি জয়া আর বিজয়া। এই পুজো আজও কোচবিহারে রাজপরিবারের নিজস্ব পুজো হিসেবে চলে আসছে, কথিত রয়েছে, এক সময় এই মন্দিরেই নিয়মিত নরবলি হত। আজ থেকে প্রায় 250 বছর আগে মহারাজ নরনারায়ণের আমলে এই নরবলি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু লোকাচার, সংস্কার বা রীতি যাইহোক না কেনো "দেবী নাকি নররক্ত না পেলে কুপিত হন" তাই এখনও প্রতি বছর মহানবমীর দিন এখানে এক বিশেষ ধরনের বলির ব্যবস্থা করা হয়।
মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিলগ্নে অর্থাৎ সন্ধিপুজোয় বড়দেবীর মন্দিরে এক ‘গুপ্তপূজা’ হয়, তখন বাইরের লোকেদের গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ, পুরেহিত এবং রাজবংশের প্রতিনিধিই শুধুমাত্র থাকতে পারেন এই উপচারের সময়ে, নর রক্ত হিসেবে রাজপরিবারের কোনো এক প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর পদতলে আর বলি দেওয়া হয় মানুষের প্রতীক একটি পুতুলকে।                        ঐতিহাসিক ভাবে নরবলি ডাকাতি আর মা কালির আরাধনা একে ওপরের সাথে গভীর ভাবে মিলেমিশে আছে, এরকমই কিছু গল্প, "বলিপ্রিয়া ডাকাত কালীর গল্প" আজকের দক্ষিণ কলকাতার গরিয়াহাটেই একসময় ডাকাত কালীপূজায় নরবলি ই ছিল রীতি বা উপাচার, মনোহর বলে এক পরাক্রমশালী ডাকাত জীবনে সাফল্যের জন্য অর্থাৎ ডাকাতিতে সফল হবার উদ্দেশ্যে বলিপ্রিয়া মাকে নরমুণ্ড  উৎসর্গ করতেন আর তাতেই নাকি তৃপ্ত হতেন মা-কালী!!! প্রায় একশো  বছরেরও বেশী চলেছিল এই পৈশাচিক রীতি।
 আজ থেকে আড়াইশ বছর আগের দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চল জুড়ে ছিল শুধুই হোগলা-বনের জঙ্গল, সভ্য-মানুষের বসবাসের অযোগ্য, ঝকঝকে গড়িয়াহাট এলাকা ছিল শুধু ডাকাত, ঠ্যাঁঙারে আর বন্য জন্তু জানোয়ারের অবাধ বিচরনভূমি। 
আজকের আধুনিক পূর্ণদাস রোড দেখে হয়তো কেউ বিশ্বাস ই করতে পারবে না যে একসময় এখানেই নরবলির মতো ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস ঘটনা আকছার ঘটত। মনোহর বাগদি নামের এক ডাকাতের নামেই কিন্তু  হয়েছে মনোহরপুকুর রোড। এই বিখ্যাত বা কুখ্যাত মনোহর ডাকাত তার দলবল নিয়ে ডাকাতির আগে মা কালীর কাছে মানদ করে ডাকাতি করতে যেতো, আর সফল হলে, ফিরে এসে মায়ের কাছে উৎসর্গ করত জলজ্যান্ত মানুষ। 1298 বঙ্গাব্দে এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মনোহর ডাকাতের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্তমান হুগলি জেলার ত্রিবেণীর বাসুদেবপুর গ্রাম ছিল জল-জঙ্গলাকীর্ণ এক অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল এবং  জলদস্যুদের প্রিয় আস্তানা। এই জঙ্গলেই ছিল বিখ্যাত রঘু ডাকাতের ভাই জলদস্যু বুধো ডাকাতের রাজ্যপাট, সেখানেই ছিল এক কালীমায়ের মূর্তি যা রঘু ডাকাতের কালী নামেই প্রসিদ্ধ ছিল।
এই মা-কালীর আশীর্বাদ নিয়েই বুধো ডাকাতের দল বের হতো ডাকাতি করতে। প্রায় সব ডাকাতিতেই  বুধোর দল সাফল্য পেত, কিন্তু একবার ডাকাতি করতে গিয়ে বুধোর দলের কয়েকজন ধরা পড়ে যায়, যদিও সে যাত্রায় বুধো নিজে পালাতে সক্ষম হয়, এই ঘটনায় বুধো নাকি ভয়ংকর ক্ষিপ্ত হয়ে তার খাঁড়া দিয়ে দেবীর অঙ্গে আঘাত করে বসে এবং পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুধো ডাকাত আবার দেবীমূর্তির ক্ষত সারিয়েও দেয়।
লোকশ্রুতি আছে এই বুধো ডাকাত এক বিশাল উঁচু মা-কালীর ভয়াল মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং ধূমধাম করে তার আরাধ্য দেবীকে সিদ্ধেশ্বরী রূপে পুজো করতে শুরু করে। তারপর সেই দেবীমাকে তুষ্ট করতে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে নরবলির প্রচলন করে। পরবর্তীকালে এই বুধোর ডাকাতি জীবনে আসে এক বিরাট পরিবর্তন, সে ডাকাতির লুঠ করা প্রায় অধিকাংশ সম্পদই গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকে, এই মাটির মূর্তিটি পরে অবশ্য ধ্বংস হয়ে যায়।                            
প্রায় চার শতক আগে  গঙ্গা নদীর দুইকুল ছিল ভীষণ শ্বাপদসঙ্কুল বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ, আজকের উত্তর কলকাতার কাশীপুর আর চিৎপুরে তখন ছিল গভীর অরণ্য, কথিত আছে এখানেই চিতু ডাকাত বলে আর এক ডাকাত নরবলি দিয়া দশভুজা দুর্গাদেবীর পূজা করতো, সেই দেবী আজও বিদ্যমান। 1758 এ ইংরেজদের রাজত্বকালে চিৎপুরের জঙ্গল আর নরবলির বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সমসাময়িক লেখায় উল্লিখ আছে। রেভারেন্ড লঙ সাহেবের লেখা পড়লে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হতে পারে, এছাড়া হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকেও জানা যায়   চিৎপুর রোডের কথা, যা কিনা মোগল বাদশাদের  আমলে তৈরী, তখন এর দুপাশে ঘন দুর্গম জঙ্গল  ছিল আর এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই পুণ্যার্থী, কাপালিক, সাধু-সন্ন্যাসীরা সে সময় চিত্রেশ্বরী ঠাকুর দর্শন করে, জঙ্গলের মধ্য দিয়েই আবার কালীঘাটের কালি দর্শন করতে চলে যেতো। এই চিত্রেশ্বরীর নাম থেকেই 'চিৎপুর' নামটি এসেছে।                 
অবিভক্ত বাংলাদেশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই পুণ্যার্থী মানুষ পুণ্যলাভের আশায় আর পরাক্রমশালী জমিদার বা ডাকাতেরা অন্যায় ভাবে অর্থ লাভের জন্য দিনের পর দিন মা-কালীর কাছে নরবলি দিতেন। বিশেষত ডাকাতদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল দেবী প্রসন্ন হলে তারা ডাকাতি করে অনেক ধনরত্ন পাবে!!!! বাংলাদেশের সর্ব্বত্র "ডাকাতে কালী" দেখতে পাওয়া গেলেও কিন্তু "ডাকাতে দুর্গা" একমাত্র এই কাশীপুর-চিৎপুর ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আর্মি লেফটেন্যান্ট হিক্স এই নরবলির প্রথা বন্ধ  করিতে সচেষ্ট হয়েও বিশেষ সফল হতে পারেন নি, শেষপর্যন্ত ছয় বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ক্যাপ্টেন ক্যাম্বেল ও মেজর ম্যাকফারসন দেবীপূজায় নরবলি দেওয়ার প্রথা 1829 এ এদেশে বন্ধ করেন। 
 শক্তির উপাসনা করলে মনস্কামনা পুর্ন হয়,   ডাকাতেরা তাই সেকালে ডাকাতি করে বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের আশায় খুব ভক্তিভরে কালীপুজা করতো। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে  এই চিতু ডাকাত  কালীপূজা না করে দুর্গাপূজা করতো, এটিই ছিল তার বিশেষত্ব।                       
চিতু ডাকাতের সম্পূর্ণ নাম ছিল চিত্তেশ্বর রায়। সেকালে তার নাম শুনিলে বাংলার মানুষ জন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত, আগে চিঠি পাঠিয়ে তারপর  ডাকাতি করতে যেতো এই চিতু ডাকাত, আর যাওয়ার  আগে দেবী দুর্গার কাছে  ভক্তিভরে নরবলি দিয়ে পুজো করে তবেই ডাকাতি করতে যেতো। এই চিতু ডাকাতের বংশেই পরবর্তী কালে রঘু ডাকাতের জন্ম হয়েছিলি, ডাকাতির জন্য রঘু ডাকাতের নামও বাংলাদেশ অত্যন্ত খ্যাতিলাভ (কুখ্যাতি লাভ) করে, এই রঘু ডাকাত  সম্বন্ধেও অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রাচীন বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে এই "চিতুর দুর্গা, চিতুর দেবী বা চিত্তেশ্বরী" নামে দেবী দুর্গার। এই চিতু ডাকাতের দুর্গা মূর্ত্তির কিছু উল্খেযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, এই দেবী দুর্গা অসুরদলনী হলেও, তাঁহার দুপাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী বা কার্ত্তিক-গণেশ নেই, আর এখনকার প্রচলিতি দুর্গা মূর্ত্তির বাহন সিংহের বদলে একটি বাঘকে দেখা যায়। প্রাচীনকালের কাশীপুর থেকে কলিকাতা পর্যন্ত এক বিশাল জঙ্গল ছিল, যা অধুনা সুন্দরবনেরই বিলুপ্ত হওয়া অংশ, তাই মনে করা হয় তখনকার চিতু ডাকাত দেবীর সাথে সাথে বন জঙ্গল আর বাঘকে সন্তুষ্ট করবার জন্যেও এই পূজো করত, আর তাই দেবীর বাহন হিসেবে সুন্দরবনের বাঘের উপস্থিতি। চিতু ডাকাতের দেবী দুর্গার নাম ছিল চিত্তেশ্বরী আর যেহেতু কাশীপুরের অরণ্য ছিল চিতু ডাকাতের বাসভূমি তাই মনে করা হয় চিতু ডাকাতের নাম থেকেই ওই জায়গার নাম হয় চিত্রপুর, কালক্রমে চিত্রপুর হয়ে ওঠে চিৎপুর। 1846 এ রেভারেন্ড লঙ সাহেব তার লেখায় উল্লেখ করেছেন  এই চিতু ডাকাতের দেবী চিত্তেশ্বরীর নিকট ই সবথেকে বেশি সংখ্যক নরবলি দেওয়া হত, তাঁর বর্ণনার অংশবিশেষ অনুবাদ না করেই তুলে দেওয়া হলো:-  "It was old then written Chittrapur and was noted for the temple of Chottreswari Devi, or the Godess of Chittru, known among Europeans as the temple of Kali at Chitpore. According to popular and uncontradicted tradition, it was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to Godess in Bengal, before the establishment of British Government"
চিতু ডাকাতের দুর্গা 'চিত্তেশ্বরী' খুবই জাগ্রত বলে খ্যাতি ছিল, তাই বহু ধনী জমিদারও সদলবলে  মনস্কামনা পুরোনের জন্য সেই বিপদশঙ্কুল জঙ্গলে চিত্তেশ্বরী দেবীর পূজা দিতে আসতেন। একবার তৎকালিন নবাবের সেনাপতি চক্রপাণি দত্ত বহু পারিষদ আর সৈন্যসামন্ত নিয়ে দেবীর পূজা দেবার জন্যে সেখানে পৌছোয়, চিতু ডাকাত এত সৈন্যসামন্ত দেখে তাদের পুজা দিতে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক বিরাট সংঘর্ষ হয়, তাতে প্রচুর হতাহত হয় এবং শেষপর্যন্ত নবাবের সৈন্যরা চিতুকে বন্দি করে ফেলে ও তারপর চিতু ডাকাতের প্রাণদন্ড হয়। শ্রীরামপুরের রেভারেন্ড ওয়ার্ড সাহেবও তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থেও চিৎপুরের নরবলির কথা উল্লেখ করেছেন :- "At Chit-poore near Calcutta, it is said that human sacrifices have been occasionally offered" , চিতু ডাকাতের মৃত্যুর পর দেবী চিত্তেশ্বরীর সেই দারু-বিগ্রহ জঙ্গলেই পড়ে থাকে, পূজা-পাঠও বন্ধ হয়ে যায়, এর বহু বছর পর 1546 এ নৃসিংহ ব্রহ্মচারী নামে এক তান্ত্রিক ভাগীরথী তীরে এই চিৎপুরের জঙ্গলে সাধনা করতে আসেন, স্থানীয় মৎসজীবি যারা তখন গঙ্গায় মাছ ধরতেন, তাঁরা ওই সাধুর খুব অনুগত ভক্ত ছিলেন। কথিত আছে এই নৃসিংহ ব্রহ্মচারীই স্বপ্নাদেশ পেয়ে পরে দেবী চিত্তেশ্বরীকে জঙ্গল থেকে বের করে তাঁর দারুমূর্ত্তিতে পুনরায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। ভাগীরথী তীরবর্তী কাশীপুরের ওই জঙ্গলাকীর্ণ স্থান ছিল সে সময় মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম জমিদার মনোহর ঘোষের জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত। জমিদারদের নির্দেশে বসতি স্থাপনের জন্য যখন ওই জঙ্গল পরিস্কার করা চলছিলো, তখন এক সাধুকে দুর্গাপূজা করতে দেখতে পায় কর্মচারীরা, তারপর সাধুর অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে জমিদারকে অবগত করিলে, মনোহর ঘোষ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছত্রিশ বিঘা জমি দান করেন এবং  দেবী চিত্ত্বেশ্বরীর একটি মন্দির স্থাপন করেন।
সে কালের নবদ্বীপেও নামকরা সব ডাকাতদের যথেষ্ট রমরমা ছিল, নবদ্বীপ শহর থেকে একটু দূরে পশ্চিমে খুবই কম জনবসতি সম্পন্ন এক গ্রাম ছিল ব্রহ্মাণীতলা, সেখানে ছিল করালবদনা সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির,তবে কে বা কারা, কবে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, জানা যায় না কিন্তু তা ক্রমে হয়ে ওঠে ডাকাতদের আরাধ্য। শোনা যায় এক সকালে মন্দিরে নিত্যপূজা করতে গিয়ে এক পুরোহিত দেখেন, চাতালে থরে-থরে সাজানো ষোড়শোপচার, সেই সঙ্গে চারখানা পট্টবস্ত্র-উত্তরীয়, ঘট সমেত তৈজসপত্র আর তার সঙ্গে আটটি পিতলের বাটিতে টাটকা রক্ত অথচ আশপাশে কোনও ছাগল  বা মহিষের মুণ্ডু পড়ে নেই! অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণের বুঝতে আর বাকি থাকে না যে সেই রক্ত আসলে "নররক্ত", এবং অনুমান করতে পারেন আগের অমাবস্যার রাতেই মা কালীর কাছে নরবলি দিয়েছে নিশ্চয়ই কোনো ডাকাতেরা, আরও আশ্চর্য হলেন, নৈবেদ্যের থালার পাশে পাঁচটি টাকা দক্ষিণা আর একটি চিরকুটে  ব্রাহ্মণকে যথাবিহিত ভাবে পুজো করার অনুরোধ জানানো আছে তাতে। 1819 এ সমাচার দর্পণ পত্রিকার সাতাশে নভেম্বর সংখ্যায় সংবাদটি প্রকাশিতও হয়েছিল ‘গুপ্তপূজা’ শিরোনামে।
নদিয়ায় ডাকাতে কালীর গল্প অবশ্য শুধু এই একটিই নয়, এই জেলাতে একাধিক ডাকাতে কালীর উপস্থিতি ও তাদের নানান প্রচলিত গল্প আছে, বিশেষ করে অদ্বৈতাচার্যের শ্রীপাঠ শান্তিপুরেও কালীপুজোর ইতিহাস কয়েক শতাব্দীর। 
ছেচল্লিশের দাঙ্গার আগুনে যখন গোটা বাংলা জ্বলছে তারসঙ্গে জ্বলছিল শান্তিপুরও, সেই সময়ে সেখানে কালী মুখার্জির মাঠে, শুরু হয়েছিল ‘বোম্বেটে কালী’ নামে একটি কালিপুজো, পরে এটি ‘বামাকালী’ নামে পরিচিত হয়, এই কালী পুজোরও অনেক পুরনো ইতিহাস আছে, ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকজন বা বলা যায় ডাকাতরাই  তখন ওই পুজো করতেন। শোনা যায় যে সেই ডাকাতরা নাকি অত্যাচারী ধনী জমিদারের বাড়িতে ডাকাতি করে সেই টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতো, জানা যায় 1946 এ ব্রিটিশ সরকার এই দাপুটে  ডাকতদের ধরে জেলে পোরে আর জেলে থাকাকালীন এঁদের অনেকে‌ই দেশাত্মবোধে দীক্ষিত হন।
 ডাকাতে কালী এই জেলায় আরও অনেক আছে, প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ভবানী পাঠক, রঘু ডাকাত বা বিশে ডাকাতদের ভাবমূর্তি ছিল অত্যন্ত ভাল, গরিব দরদী একটা ভাবমূর্তি ছিল এদের, বলা ভালো ডাকাতির পাশাপাশি জমিদারদের হাতে  অত্যাচারিত গরিব প্রজাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এইসব ডাকাতরা, এছাড়া এদের অনেকেই আবার ইংরেজ বিদ্বেষী ছিল, এইসব মাহাত্ম্যের কারণেই ডাকাতদের পুজো করা  ‘ডাকাতে কালী’ গুলো বেশ বিখ্যাত ও হয়ে ওঠে সে সময়। যেমন কাশ্যপপাড়া, কাঁসারিপাড়া, বুড়ো শিবতলা বা চর জিজিরার ডাকাতে কালী। স্থানীয় ইতিহাসের গবেষকরা মনে করেন, এগুলির প্রতিটিই কোনো না কোনো ডাকাত দলের প্রতিষ্ঠা করা। ডাকতদের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই সেই সময় নিয়মিত কালীর উপাসনা করতেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য। 
আজকের এই দীপাবলির আলোর উৎসব বা কালিপুজো প্রাচীনকালে কিন্তু তা অন্ধকার, অস্ত্র আর রক্তে কোথাও যেন এক ভয়ংকর শক্তির আরাধনা হয়ে ডাকাতদের হাতেই শুধু বন্দী হয়ে ছিল।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours