দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

প্রথমেই বলি, ভূত নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। খুব নিরীহ স্বভাবে ও আচরণে। প্রথমে এসব বললে, অবশ্য ভূতের গরিমা বা মাহাত্ম্য ম্লান হয়ে যায়। ভূত যে কত ভীতু তার একটা উদাহরণ দিই তারাপদ রায়ের কবিতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে---

ভূত ও মানুষ ( তারাপদ রায় )

জনৈক ভূত দ্বিতীয় ভূতকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘' আচ্ছা, তুমি মানুষ বিশ্বাস করো,
তুমি মানো যে মানুষ আছে? '
দ্বিতীয় ভূত একটু ভীরু প্রকৃতির,
প্রশ্নটা শোনামাত্র সে শিউরে উঠলো,
এদিক-ওদিক দেখে তারপর বললো,
'‘ এই ভর সন্ধ্যাবেলা এসব কী কথা !"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নাকি পরলোকে বিশ্বাস করতেন। পরলোকগতদের প্ল্যানচেটে ডেকে আনতেন।  মিডিয়াম হতেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা- ডাকনাম বুলা। আহ্বায়ক- রবীন্দ্রনাথ। প্ল্যানচেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, ছোট বউ মৃণালিনী, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা, অজিত চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায় এবং এছাড়াও আরো অনেকে। প্ল্যানচেটের সঙ্গী হতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, মীরা দেবী প্রমুখরা। তাই সাধু সাবধান, ভূত নিয়ে উল্টো পাল্টা বলবেন না! 

এবার আসি, ভূত চতুর্দশী প্রসঙ্গে। বাংলায় ভূতের প্রকার ভেদ আছে। ডাকিনী, পিশাচ, শাঁকচুন্নী প্রভৃতি। তবে ব্রম্ভদৈত্যি ফার্স্ট সিটিজেন অফ দ্যা ভূত ওয়ার্ল্ড। আমাদের এই ভূতের উৎসব ইংরেজদের হ্যালুইন উৎসবের মত কুমড়োর উপর চোখ মুখ এঁকে মোমবাতি প্রজ্বলনের উৎসব নয় মোটেই। এই উৎসবের পুরান মাহাত্ম্য আছে। এই ভূত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হরেক রকমের। দশ মহাবিদ্যা, গায়ত্রী, হরে কৃষ্ণ হরে রাম মন্ত্র জপ ইত্যাদি। তবে, মন্ত্রের সরলীকরণে ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি। রাম লক্ষ্মণ সঙ্গে আছে করবে আমার কী-- তেও চলবে! 

বেশ কিছু আচার পালন করার প্রথা রয়েছে হিন্দু মতে। তার মধ্যে অন্যতম হল ১৪ শাক খাওয়া।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে মৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। তাই আকাশ, মাটি, জল, হাওয়া, অগ্নি প্রকৃতির এই পাঁচ উপাদানের মধ্যেই মিশে থাকেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।
সেই পঞ্চায়েতের ভূতের এক ভূত ক্ষিতি। ( পঞ্চ ভূত- আকাশ, মাটি, জল, হাওয়া, অগ্নি ) তাই  প্রকৃতির কোল থেকে তুলে আনা ১৪ প্রকার শাক খেয়ে তাই তারা পরলোকগত ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে এই দিনটিকে। এই শাক মাটিতে হলেও, এর বৃদ্ধিতে বাকি ভূতও লাগে তা আপনারা বিজ্ঞানে পড়েছেন। এই শাক হল যথাক্রমে-- ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণী।১৪ শাক ধোয়ার জন্য যে জল ব্যবহার করা হয়, তা ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির অন্ধকার কোণগুলোতে। দুপুরে ১৪ শাক ভাজা খেয়ে, সন্ধ্যায় ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে, দরজায় ১৪ ফোঁটা দেওয়ার এই রেওয়াজ বহুদিনের।

দীপান্বিতা অমাবস্যার আগে চতুর্দশী তিথিতে হিন্দু মতে ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। হিন্দু মতে বিশ্বাস করা হয় যে এদিন মৃত পূর্ব পুরুষরা মর্ত্যে নেমে আসেন৷ তাঁদের খুশি করতে ও অতৃপ্ত আত্মাদের অভিশাপ থেকে বাঁচতে এদিন নানা আচার পালন করার প্রথা রয়েছে। 
 আমরা জানি, ভূত মানেই ভূতনাথ শিবের সঙ্গী। কিন্তু ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণে যে গল্প পাওয়া যায় তা জানলে এই ধারণা বদলাবে।  চানক্য শ্লোক--অতি দানে বলি বদ্ধ- শুনেছেন নিশ্চয়ই।  দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নিলেন তখন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল রাক্ষসরা। এই আক্রোশ থেকে পার পেলেন না দেবতারাও। বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে তখন নেমে এলেন শ্রীবিষ্ণু, তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চাইলেন রাজা বলির কাছে। দানবরাজ কিন্তু শুরুতেই বুঝেছিলেন যে এই বামন আর কেউ নন, স্বয়ং বিষ্ণু। কিন্তু এরপরও তিনি রাজি হলেন চুক্তিতে। দুই পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে ফেললেন বিষ্ণু। এরপর নাভি থেকে বের হয়ে এলো তাঁর তৃতীয় পা, যা রাখলেন বলি রাজার মাথার উপর। সঙ্গে সঙ্গেই পাতালে নেমে গেলেন দানবরাজ বলি। সেই থেকে পাতালই হলো তাঁর বসবাস। তবে ভগবানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় বলিকে বর দিলেন বিষ্ণু। প্রতি বছর পৃথিবীতে তাঁর পুজো হবে বলে আশীর্বাদ করলেন তিনি। সেই থেকে কালীপুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পুজো নিতে। সহচর হিসেবে থাকে শত সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা, অশরীরী প্রভু! দেবতা থাকলে, অপদেবতা তো থাকবেই! 
 
ভূত চতুর্দশী এতদিন বেঁচে বর্তে ছিল বাঙালির উৎসব হিসেবে। কারণ বাঙালি ছাড়া অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে ভূত চতুর্দশী পালন করার প্রচলন তেমন নেই। ১৪ শাক ভাজা আর ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর পেছনে কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। বলা হয়, হেমন্তের শুরুতে পোকার উপদ্রব দূর করতে বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়। আবার ঋতুর পরিবর্তনের কারণে এই সময়টা অসুখ বিসুখ হয় বেশি, তাই ১৪ রকমের শাক খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। সেই বিশেষ ১৪ রকমের শাক এখন আর পাওয়া যায় না বললেই চলে। তবু প্রচীন প্রথা ধরে রাখার চেষ্টা আজও রয়েছে অনেক ঘরেই।
 
কিন্তু ধনতেরাস একটু একটু করে গ্রাস  ফেলছে! তাই ভূতের দুঃখের অন্ত নেই। এব্যাপারে তেনারা একটা প্রেস মিট ডাকার অপেক্ষায়! 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়,  ‘মানুষ ভূতকে ভয় করে, ভূতও মানুষকে ভয় করে, মৃত্যুনদীর দুই পারে দুইজনের বাস’, আর এই দুইয়ের মাঝে কাদম্বিনীর অবস্থান। সুতরাং না পারছে সে নিজেকে প্রেতলোকে সমর্পণ করতে, না পারছে সমাজে নিজের জীবিত সত্তাকে প্রমাণ করতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কঙ্কাল" গল্পে কঙ্কাল খোঁজার কাহিনী হোক, আর "জীবিত ও মৃত" গল্পে  কাদম্বিনীর জীবন্মৃত অবস্থায় হোক, ভূত, ভূত  মরেই প্রমাণ করতে হবে, সে মরে নি। ভূত এমন জিনিষ। তাই যতদিন ভূত থাকবে, ততদিন ভূত চতুর্দশী বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের মধ্যে। এই দায় আমাদের!
আগে তো বাঙালি জানতোই না, ধনতেরাস খায়, না মাথায় দেয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours