নাজমীন মুর্তজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

হায় আবরার! হায় আবরার!
হাহাকার করি শুধু...
বিদেশের পথে পথে আমি কাঁদি অসহায় 
বাবার মুখ দেখে...মায়ের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে 
আমি থমকে থাকি ,দৃষ্টি ঝাপসা হয় আবরারের শরীরের কালসিটে দাগে...! 

সারাটা দিন ঘুরে ফিরে বুয়েটের  সিসি টিভির ফুটেজ গুলো দেখছিলাম , দেখছিলাম আবরারের জায়নামাজ , টুপি , পটেটো চিপসের প্যাকেট , অগোছালো বিছানা । প্রথম চিত্রে যা দেখলাম তা হলো- একজন যুবককে  পিটিয়ে মারার পরিকল্পনায় এক হচ্ছে , আবরারকে পাঁচ ঘন্টা ধরে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে , মদ্যপ অনিক  , সকাল , সহ বাকী পাণ্ডারা পেটাতে পেটাতে উলঙ্গ করে হাত-পা  অচল করে দিয়েছে । একটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে শক্ত ধাতব দিয়ে পিটিয়ে অকথ্য ভাষায়  সুঁচালো  জিভের অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করছে। চারদিকে দাঁড়িয়ে অসভ্য ছাত্ররা তামাসা দেখছে ও কেউ কেউ তাকে  লাথি মেরে শিয়াল, কুকুরের মতো হত্যা করছে। 

এই দৃশ্য কি করে নেবে মানুষ ? খোলা রাস্তায় যখন অসহায় নির্দোষ বিশ্বজিৎ কে কুপিয়ে মেরেছে , তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা বিশ্ব এই নির্যাতনের চিত্র দেখতে পেয়েছে তার পরেও পিশাচ খুনিদের দাপট কমেনি ।
এই সব রাজনৈতিক মদদ দাতারা অনেকে মনে করেন পদ হারানোর ভয়ে তারা ক্ষেত্র বিশেষে রঙ পাল্টে ফেলেন। সঠিক বিচার হলে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রনে আসতে বাধ্য। গলদ তো আমাদের মধ্যেই।
তাই বিচার অনিশ্চিত হয়ে পরে । 
মানুষ বিবেক জ্ঞান সম্পন্ন প্রাণী । মানবিক বোধ থাকলে এমন জঘন্য কাজ করতে পারেনা। মানুষকে হত্যা করতে গেলে বুক কেঁপে উঠতো। দরদী হাত হত্যা থেকে বিরত থাকতো। দলাদলির গোলক ধাঁধায় পড়ে মানুষ আজ বিবেক বর্জিত হয়ে পড়েছে। রক্তারক্তিতেও মানব অনুভূতিতে সামান্যতম রেখাপাত করে না। অথচ পৃথিবীর সব মানুষের কান্নার শব্দ এক। স্বজন হারানোর বেদনা সকলের এক। জাতি, ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে সকলের রক্তের রঙও এক। তাহলে মানুষে মানুষে কেন এ হানাহানি?

“জীবে দয়া করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।”এ রকম সুন্দর সুন্দর কথা, বিজ্ঞজনদের কথা ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। সব জীবের প্রতি আমাদের কম বেশি দয়াও আছে। আবার অপরদিকে আল্লাহর এ বিধানও আছে অহেতুক কষ্ট দিয়ে জীবহত্যা মহাপাপ 
তারপরেও মানুষ খুন করে ! কেন করে ? 

মানুষ মানুষকে খুন করার বেশ কিছু কারন আছে। এর মধ্যে একটি বড় কারন হচ্ছে আদর্শগত দন্দ্ব। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু আদর্শ আছে। আদর্শের চুন থেকে পান খসলেই যত মুশকিল ।
মানুষের বোধ-চেতনা ও উপলব্ধি শক্তি সবচেয়ে বেশি। 
মঙ্গল-অমঙ্গল, ভালো-মন্দ,আলো - আঁধার সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও আসল-মেকির মধ্যে পরখ করতে পারে। এ কারণেই মানবজাতি জীবনে উন্নতি লাভের এমন সুযোগ পেয়েছে, যা অন্য কেউ পায়নি। 

কিন্তু সে মানুষ যদি তার বোধ-উপলব্ধি ও ভালো-মন্দ পার্থক্যের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তখন সে মানবিকবোধ হারিয়ে পাশবিকতা বরং আরো নিম্নস্তরে পৌঁছে যেতে পারে। 'মানুষ' হিসেবে তখন তার দেহ-
অবয়ব, সুরত-আকৃতি ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। 
আমরা কারনে অকারণে স্কুল কলেজ গুলোর দোষ দেই , মানুষ কে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য অধ্যাবসায় অবসম্ভাবী ।  
বিদ্যাপিঠ মানুষকে ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, কল্যাণকামিতা ও পরোপকার শিখায়। পরিবেশ নষ্টকারী কারা অসৎ মানুষ , যাদের কোন বিদ্যাপিঠ নেই।

এখন দেশে কে কাকে ধরছে মারছে ,সন্দেহভাজন বলে পিটিয়ে লাশ বানাচ্ছে মহাউল্লাসে । হাতে পায়ে, মাথায় গুলি করছে, মেরে ফেলছে, গুলি করে চলন্ত গাড়ির নিচে ফেলে দিচ্ছে, পঙ্গু করে দিচ্ছে, অনেক সম্ভাবনাময় যুবকদেরকে, পিটিয়ে হত্যা করছে । অসংখ্য মায়ের বুক খালি করে দিচ্ছে, তাদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। 
পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রতিবাদ উঠছে। এ প্রতিকারবিহীন জুলুম চলছেই। আবার যারা প্রতিবাদ করছে তাদের বলার অধিকার হরণ করা হচ্ছে , বিচার বাঞ্চাল করছে, যেখানেই যুদ্ধ হোক না কেন যুদ্ধের সময় সীমা সংখ্যাহীন মানুষ মারা যায়। সেটারও একটা পরিসংখ্যান আছে, থাকা উচিত, সব হত্যার সঠিক বিচার হওয়া উচিত। 

একটা লোককে নিজ ঘর থেকে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গায়েব করে দিচ্ছে এটা কি অপরাধ নয়?
কয়টা ঘটনা বলা যায় দেশকে যেন জোর করে মৃত্যু উপত্যকা বানানো হচ্ছে । এই মৃত্যু উপত্যকা আমার না এটা আমি বলবো না , বরং বলবো,  হ্যাঁ এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ , এই আমাদের কঠিন বাস্তবতা , এখানে অপরাধের বিচার নামমাত্রে হয় , এখানে ধর্ষণ করে মানুষ আমোদ করে , এখানে ছেলে ধরা সন্দেহে নিস্পাপ নারীকে পিটিয়ে মারা হয় , এখানে নারীর দেহে জীবন্ত আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় । এখানে আবরার কে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় ।  বিশ্বজিৎ কে দিনের আলোয় কোপাতে কোপাতে নিস্তেজ করা হয় ।তো ! এতো শত ঘটনার জ্বলন্ত বাতি নিয়ে আমি আমরা শোক করি , মাতম জারী গাই । এ মৃত্যু উপত্যকা আমার ... সমস্ত পচা গলা নোংরা মানুষ তো আমাদের চারপাশে ...  আমরা তো ওদের নিয়েই চলছি। 
আজ যারা খুন করলো আবরার কে , তারা কারা ? কারো ভাই কারো সন্তান , অবশ্যই ছোটবেলায় মানবিকতার বুলি বাবা - মা শিখিয়ে ছিল ... নামতা ঘরের মতো । তারপরেও তারা খুন করতে পারে , ঠাণ্ডা মাথায় । পরিকল্পিত ছক এঁকে। 
মৃত্যু , কোপানো, গুম, আমাদের দেশে অহরহ হচ্ছে, যা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।  
কত কত মৃত্যুর বিচার আদালতের দেয়ালে মাথা কুটে মরছে । কতগুলো বলা যায় , নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ,নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে খুন হলো, এখনো কোন কুলকিনারা হলো না।
ধর্ষণ তো লাইসেন্স পেয়ে গেছে , শুধু সুযোগ পোহায় মানুষ বাসে , ট্রেনে , রাস্তায় , কোথায় নিরাপদ নারী ? এ সবতো একেবারে তাজা ঘটনা অথচ বিচারের বাণী নীরবে কেঁদেই চলছে। ব্লগার রাজীবকে একেবারে পুলিশের সামনেই হত্যা করা হলো, আসামী পাওয়া যাচ্ছে না। ব্লগার দিপন হত্যায় তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম অনেক কষ্ট নিজ বুকে চেপে বলল এ বিচারহীন অবিচারের ডামাঢোলে তিনি তার প্রাণপ্রিয় পুত্র হত্যার বিচার চান না।
জাতির বিবেকবান লোকের মনে এ প্রশ্ন জাগলেও উপায় নাই গোলাম হোসেন , দেশের মানুষ বেকায়দায় আছে , এটা বুঝতে আর বাকী নাই । 
বর্তমান দলীয় লুটেরা, সন্ত্রাসী খুনিদের মদদ দাতাদের রাজনৈতিক গুন্ডাদের বিচার কেন হচ্ছে না। 
দেখা গেছে সব  অপঘটনার পেছনে একটা করে লম্বা জিনের  হাত আছে ... সব দলের জিন , যত দল আছে দেশের মধ্যে । যেহেতু হত্যাকারীরা শক্তিধর  যে কোন দলের বড় জ্বিন বড় শক্তিধর, ক্ষমতাধর বাদশা, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান- নেতা , স্থানীয় মাস্তান , পাতি মাস্তান , দলের পোষ্য কুকুর , এদের দ্বারা কিছু হলে আমরা স্থবির।  
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তে এখন আক্রোশ, জ্ঞানের গর্ব, ক্ষমতার দাপট সব একদিকে  রেখে সতর্ক হওয়া উচিত , সচেতন হওয়া উচিত। 
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে , পালাবার পথ নাই , সুবল , এখনি ঘুরে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময় । 
আসলে মানুষ কেন করে , কেন এতোটা অমানবিক হয় , এই প্রশ্নগুলো আমার ভেতরে কিলবিল করে , তখন নানান বই পড়ি , মানুষের মনস্তাত্বিক ব্যপার গুলো বুঝতে চাই । 
মানুষ খুন করা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখা পড়েছিলাম লেখাটা ছিল এমন -

“মানুষ কেন অন্য মানুষকে মারে, খুন করে? অনেকদিন ধরেই এই প্রশ্নটা খচখচ করে আমার মনে। আদিমকালে মানুষ যখন বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিল, তখন থেকেই হিংসা ও হানাহানির শুরু, আজও সেই একই রকম কাণ্ড-কারখানা চলছে। ইংরিজিতে রেস মেমরি বলে একটা কথা আছে, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে, বংশ পরম্পরায় মানুষ দু’একটি স্মৃতি বহন করে, যা সে নিজেও জানে না। আদিমকালথেকে সেই হিংসার স্মৃতিতে মানুষ যখন তখন খুনি হয়ে ওঠে। 

বাঘ কখনও অন্য বাঘকে মারে না, রাস্তার কুকুর যখন সীমান্তরক্ষার তাগিদে অন্য একটা কুকুরের সঙ্গে মারামারি করে, কী হিংস্র তাদের গর্জন, সাঙ্ঘাতিক হুটোপাটি, কিন্তু কোনও কুকুরই মরেনা, কিছুক্ষণ পরে ওদের একজন হার স্বীকার করে, ল্যাজ গুটিয়ে পালায়, পিঁপড়েরা অন্য পিঁপড়েদের খুন করে না। একই প্রজাতির মধ্যে খুনোখুনির কলঙ্ক একমাত্র মানুষেরই। বাইবেলেও আছে, ভ্রাতৃহত্যা দিয়েই মানুষের ধারার শুরু।
ক’দিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, আসলে কোনও মানুষই অন্য মানুষকে হত্যা করে না। অত্যন্ত রাগ আর রিরংসায় কিংবা নারীর ওপর অধিকার বা অর্থ লালসায় কোনও কোনও মানুষ হঠাৎ অমানুষ হয়ে যায়, তখন অন্যের প্রাণ হরণে তার হাত কাঁপে না। 
সে তখন আর মানুষ থাকে না, অ-মানুষ নামে অন্য এক প্রজাতি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে নিহত হয়, সে-ও আর মানুষ নয়। এইসব অমানুষদের অবয়ব দেখে কিছুই বোঝা যায় না।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে অ-মানুষদের সংখ্যা? মানুষের সঙ্গে অমানুষদের একটা গোপন যুদ্ধ চলছে তো চলছেই।

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি।”

কে জাগাবে ডুবন্ত মানবতা,ঘুমন্ত বিবেক, অসহায় মানুষকে । এখন যেন চারদিকে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ডামাডোল বেজে চলেছে। পৃথিবীতে মানবাধিকার সংগঠনের অভাব নেই। কিন্তু তারা কোন মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে, তা বোধগম্য হচ্ছে না আমার , কিন্তু মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারে না।
সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ শব্দগুলো সহজে যুক্ত করেছি আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত করে নিয়েছি ।একে ওকে দোষ দিয়ে এই সব শব্দে অভিযুক্ত করতে । কিন্তু একটা ব্যপার দেখা যায় , কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মের লোকেরা হাজার অপরাধ করলেও তাদের ক্ষেত্রে কখনো সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ শব্দগুলো যুক্ত হয় না। অপরাধের ক্ষেত্রে সকল ধর্মের ও সম্প্রদায়ের লোকেরা সমান অপরাধী বিবেচিত হওয়া উচিত, একটি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ঠুনকো অজুহাতেই চলা অভিযানের নামে হামলা হয়ে যায়;। নির্মম ভাবে খুন করা হয় । কেউ টু শব্দটুকু করে না বরং মদদ যুগিয়ে যায় , কাকের মতো দল ভারী হয় । 
বিবেক যেন অন্ধ হয়ে যায় ।
দেশটা ভাগারে পরিনত হয়েছে এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মাঝে বসবাস করা আমাদের সাধারণ মানুষের বড় অপরাধ বটে । তাই তো যখন যেখানে যারা পারছে তারা কচু গাছের মতো তাদের ইচ্ছে মতো নিরিহ মানুষ কতল করছে।
পৃথিবীতে যত ধর্মের-ই আবির্ভাব হয়েছে, তার মধ্যে কোনো ধর্মই মানুষ হত্যাকে স্বীকৃতি দেয়নি। প্রত্যেক ধর্ম-ই মানুষ ও মানবতার জয়গান গেয়েছে; অনেকে মানব সেবার মাঝেই ঈশ্বরের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে। তবে সত্যিকারের মানবতা কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার এখনকার দিনে ।
কিছু খবর শুনে দেখে শুধু এটুকুই মনে হয় নিপীড়িতদের কান্নার শব্দ মৃত্যুও শুনে না-তাই তারা বিভিন্ন কৌশলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। 
“রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাস বান্ধব তখন নাগরিকের সামনে দুটো পথই খোলা থাকে- তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পরা নয় তো খুন হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা। “


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours