শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:
দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। কৈশেরে দক্ষিণাপথের পথে-ঘাটে এক মুঠো খাদ্যের জন্য এদিক সেদিক ঘুড়ে বেড়াতেন। হঠাৎ তার উপর দৃষ্টি পরে ইস্পাহানের সওদাগর সফী হাজির। সফি হাজি কিশোর ব্রাহ্মণ সন্তানের কথা ও বুদ্ধিমত্তায় আকৃষ্ট হন। তিনি তাকে নিজ দেশে নিয়ে গেলেন। লালন পালন করলেন নিজ সন্তানের মত। এক সময় ধর্মান্তরিত করে নাম রাখলেন মুহাম্মদ হাদী। ইস্পাহানের একটি ভালো মাদরাসায় তাকে পড়ালেখা শিখতে দিলেন। হাজী সাহেবের মৃত্যুর পর বুদ্ধিমান এই ব্রাহ্মণ সন্তান ফিরে এলেন দক্ষিণাপথে নিজের জন্মভূমিতে। বেরার রাজ্যের দেওয়ান হাজী আব্দুল খোরাসানী নিজের অধীনে এই বালকটিকে রাজস্ব বিভাগে একটি চাকুরী দিলেন। মুহাম্মদ হাদীর সুনাম সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে গেলো একসময়! এমন কি সম্রাট আওরঙ্গজেব "করতলব খাঁ" খেতাব এবং মসনবদারী দিয়ে দেওয়ান পদে নিযুক্ত করে বাংলাদেশে পাঠালেন। তখন রাজস্ব বিভাগ ছিলো ঢাকায়। মুহাম্মাদ হাদী ওরফে মুর্শিদ কুলি খাঁ ঢাকা পৌঁছেই তার বজরা নিয়ে ছুটেন বুড়িগঙ্গা নদীর স্রোতে। দেখতে থাকলেন, বাংলা, বাংলার মানুষ ও বাংলার গ্রামগঞ্জ। তিনি চারদিক তাকিয়ে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। বলে উঠলেন, "আল্লাহ দুনিয়ায় এত সুন্দর দেশ আছে!" এই সুজলা সুফলা উর্বর ভূমি দেখে তিনি অতিশয় মুগ্ধ হলেন। তিনি যেহেতু রাজস্ব বিভাগের মানুষ তাই তার ভাবনায় একটি বিষয়ই খেলে গেলো। কি করে এই উর্বর ভূমি নিয়ম নীতির মধ্যে এনে রাজস্ব বাড়ানো যায়।
কিন্তু শাহাজাদা আযিমুশসান তখন বাংলার গভর্নর। তিনি এই নতুন "দেওয়ানের" কাজে খুশি হতে পারছিলেন না। যদিও এই দেওয়ানের কর্মদক্ষতা ও রাজ্যের রাজস্ব বৃদ্ধিতে তার সবাহ ফুলে ফেঁপে উঠছিলো।
মুর্শিদকুলি খা, তার রাজস্ব মহাপরিকল্পনা সম্রাটের দরবারে উপস্থাপন করেন এবং চরম সফলতাও দেখান। এবং তার কর্মস্থল ঢাকা থেকে নিয়ে যান মকসুদাবাদে। মুকসুদাবাদ বাংলা বিহার উড়িষ্যার কেন্দ্র স্থল। এখানে তিনি প্রাসাদ "চেহল সুতন" নির্মান করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব তার প্রতি সতুষ্ট হয়ে তাকে আবার খেতাব দিলেন , " মুর্শিদকুলি খাঁ" । তখন থেকে এই ব্রাহ্মণ সন্তান, মুহাম্মদ হাদী থেকে, 'করতলব খাঁ', করতলব খাঁ থেকে মুর্শিদকুলি খাঁ হয়ে গেলেন। ইতিহাস তাকে মুর্শিদকুলি খাঁ হিসেবেই মনে রাখলো
। তিনি মকসুদাবাদ নাম পরিবর্তন করে এই শহর নিজ নামে রাখলেন "মুর্শিদাবাদ"। এবং এই মুরশিদাবাদেই, মুরশিদকুলি খাঁ প্রথম টাকশাল স্থাপন করলেন। মেদিনীপুর জেলাকে উড়িষ্যা প্রদেশ থেকে নিয়ে জুড়ে দেন বাংলাদেশের সঙ্গে। সম্রাটের নিকট থেকে সনদ এনে জামাতা সুজাউদ্দিনকে নায়েব দেওয়ান করে পাঠালেন উড়িষ্যায়।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার নাতীরা কলহে লিপ্ত হয়। সে সুযোগে বাংলার গভর্নর হয়ে যান মুর্শেদকুলি খাঁ। এমন কি ১৭১৯ সালে বিহারের গভর্নর পদটিও পেয়ে যান দক্ষ প্রসাশক ও বিচক্ষণ মুর্শিদকুলি খাঁ।
মুর্শিদকুলি খাঁ তার এক মাত্র পুত্রকে বিবাহিত নারীর সাথে পরকীয়া ( কারো মতে ধর্ষন) করার অপরাধে নিজে তার পুত্রকে বন্দী করে মৃত্যুদন্ড দেন! যা ভারতের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তার সময় টাকায় পাঁচ মন চাল পাওয়া যেতো। তিনি খাদ্য শস্য মজুদকারী ও কালোবাজরীদের কঠোর নজরদারীতে রাখতেন। ইউরোপীয় বণিকদের উপর ছিলো তার তীক্ষ দৃষ্টি। ভারতবর্ষের অন্যান্য শাসকের হেরেম দাসী থাকতো। তার দাসী ছিলোই না । একজন বেগম নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।
রঘুনন্দন নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মুর্শিদ কুলি খার দরবারে উকিল নিযুক্ত হয়ে ছিলেন। মুর্শিদ কুলি খাঁর বিশ্বস্ত কানুনগো দর্পনারায়ণের সুপারিশে। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বাংলাদেশে " হিন্দুরাজ্য" প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষণার জমিদার সীতারাম বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। তা কঠোরভাবে দমন করে মুর্শিদকুলি খাঁ।
মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজা উদ্দীন খাঁ নবাব হন। জামাতা সুজা উদ্দীন খা মদ্যপ ও নারী লোভী থাকার কারনে সন্তান ও স্ত্রীর সাথে যথেষ্ট মনোমালিন্য ছিলো। যার কারনে মুর্শীদ কুলি খার কন্যা জিন্নাতুন নেসা ও তার পুত্র সরফরাজ খাঁ কে নিয়ে বাবার প্রাসাদেই থাকেতেন। এমনকি মু্শিদকুলি খার মৃত্যুর পর পুত্রের সাথে নবাবী নিয়ে সজাউদ্দীন খাঁ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে গিয়ে ছিলেন নিজের পুত্র সরফরাজ খার সাথে। পুত্র সরফরাজ খাঁ ও পিতা সুজাউদ্দীনের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে মুর্শীদকুলি খার কন্যা জিন্নাতুননেসা পিতা পুত্রের মধ্যে মিমাংসা করে দেন। মাতৃভক্ত সরফরাজ খা মায়ের আদেশে পিতা সুজাউদ্দীনের সাথে মসনদ নিয়ে সংঘর্ষ থেকে সরে দাঁড়ায়।
সুজাউদ্দীন খাঁ মসনদে বসেই আলীবর্দী খাঁ কে মহলের ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ দেন। এই আলীবর্দি খাঁ নবাব সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর; তার পুত্র সরফরাজ খাঁ কে হত্যা করে মসনদ দখল করেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর নাতি সিরজউদ্দৌলা বাংলার নবাবীর মসনদে বসেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours