মুজতবা আল মামুন, সিনিয়র জার্নালিস্ট,  কলকাতা:

বিজয়ার অন্যতম অঙ্গ কোলাকুলি। সেই কোলাকুলি ঈদ উদযাপনেরও অঙ্গ। কী চমৎকার মিল ! ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও, প্রকরণ এক। এটা বাংলা, এটাই আমার দেশ। এই হৃদয়ে হৃদয় মেলানোর সুখময় সর্বজনীন ঐতিহ্য নষ্ট করে দিতে চাইছে এক অশুভ শক্তি, যা মেনে নেওয়া যায় না। 

আজ বিকেলের পর থেকে বিদায়ের সুর বিষন্ন করে তুলবে বাংলার আকাশ-বাতাসকে। চলবে দেবীবরণ। মহিলারা মাতবেন সিঁদুর খেলায়। সবার একটাই কামনা,  আসছে বছর আবার এসো। এই উৎসবের শেষপর্ব মহিমান্বিত হয়ে উঠবে কোলাকুলিতে। বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি। এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় একের সঙ্গে অন্যের মনের আদান-প্রদান। আত্মীয়তার পরম বিনিময়। ভালোবাসার,  ভালো থাকার অঙ্গিকারাবদ্ধ হওয়া। 

ঠিক একই ভাবে জামাতে ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পরই শুরু হয় পারস্পরিক কোলাকুলি। আরবিতে একে বলে 'মুআনাকা'। তবে এই বিদেশি শব্দ চাপা পড়ে গেছে ভালবাসার চার বাংলা অক্ষরের কোলাকুলিতে। শব্দটা উচ্চারণ করলে মনের বড় আরাম হয়। আত্মীয়তা গাঢ় হয়। এ এক আশ্চর্য মিলনবার্তা। ধর্ম আলাদা, কিন্তু এক জায়গায় এসে কেমন মিলে যায় ভিন্নতা। চারটে অক্ষরে। বেজে ওঠে মিলনের বার্তা। 

এটাই বাংলার কৃষ্টি। এটাই ভিন্নতাকে একাত্মতায় বাঁধে। এভাবেই মানুষ পরস্পরকে আন্তরিকতায় বেঁধেছে। সেখানে জাতি -গোত্র-বর্ণ কোনও বাধা হয় নি। কিন্তু আজ লক্ষ করা যাচ্ছে,  এক অশুভ শক্তি এই ভালবাসার নির্মাণকে তছনছ করে দিতে চাইছে।  আবহমানতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত। তা মেনে নেওয়া যায় না। বাঙালির এই চিরকালীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা জরুরী। শুধু মানবিকতার কারণে নয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের নবতর গবেষণা বলছে,  এতে শারীরিক অনেক সমস্যার নিরাময় হয়। 

আধুনিক গবেষণা বলছে,  কোলাকুলি করার সময় আমাদের মস্তিষ্কে অক্সিটসিন নামে এক হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনটির মাত্রা যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, তত আমাদের মন ভাল হতে শুরু করে। ফলে যার সঙ্গে কোলাকুলি করছেন, তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। সেই সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার একদল গবেষক দীর্ঘ পরীক্ষার পর লক্ষ করেছিলেন যারা নিয়মিত কোলাকুলি করেন, তাদের হার্ট রেট মিনিটে ৫-এর কম থাকে। যেখানে বাকিদের হার্ট রেট থাকে প্রায় ১০ এর কাছাকাছি। আর একথা তো সকলেরই জানা আছে যে, হার্ট রেট যত কম থাকবে, তত রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকবে। সেই সঙ্গে নানাবিধ হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পাবে। এবার বুঝতে পারছেন তো ঈদ এবং বিজয়া দশমী ছাড়াও কোলাকুলি করা কতটা জরুরি।

প্রায় ৪০০ জনের উপর করা এক গবষণার পর দেখা গেছে, যারা নিয়মিত কোলাকুলি করেন, তাদের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবানা সাধারণ মানুষদের তুলনায় অনেক কমে যায়। কেন এমনটা হয় ? কারণ,  কোলাকুলি করার সময় স্ট্রেস সেভেল কমতে শুরু করে। আর মানসিক চাপ যত কমে, তত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।

বিসর্জনের পর সকলের অন্তরে মা স্থান করে নেন এবং বিশ্ব চরাচর আসুরিক শক্তিমুক্ত হয় বলে, সবাই আনন্দে কোলাকুলি করে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরের এই কোলাকুলি এবং আনন্দ হচ্ছে বিজয়ার আনন্দ। যেমন এতেই ঈদের আনন্দ সর্বাঙ্গীন হয়ে ওঠে। তাই শারীরিক উপসর্গের আরামের দিকটামনে রেখেও,  মিলনের বার্তাকেই সামনে আনা দরকার। বাঙালি সংস্কৃতির এই দিককে বাঁচিয়ে রাখতে আসুন সবাই মিলে কোলাকুলির অন্তর্নিহিত বার্তাকে বুকে আঁকড়ে ধরি। শপথ নিই, ধর্মের নামে যাঁরা বিভাজন ঘটাতে চান,  তাঁদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করবই আমরা রাম ও রহিমরা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours