হীরক মুখোপাধ্যায়, লেখক, হাওড়া:

হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের মাকড়দহ বহু পুরানো জনপদ। এখানে রয়েছে বহু প্রাচীন এবং বিখ্যাত মাকড় চন্ডী মন্দির। জমিদার রামকান্ত কুন্ডুচৌধুরী বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করান 1743 সালে। যদিও এর বহু আগে থেকেই এই মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। এই চন্ডী মন্দির সম্ভবত লোকায়ত দেবী ছিলেন। এই মন্দির এর ইতিহাসের সাথে চন্ডীমঙ্গলকাব্যের যোগ পাওয়া যায়। এক কালে এই অঞ্চল দিয়ে সরস্বতী নদী প্রবাহিত হত। এই অঞ্চলের কিছু কুকুর খাল এই মজে যাওয়া নদীর সাক্ষ্য বহন করে। লোক কথা অনুসারে এই নদী বেয়ে ধনপতি সওদাগরের পুত্র শ্রীমন্ত সওদাগর নৌকা নিয়ে বাণিজ্য কালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । মন্দিরে রাখা তিনটি পাথর আজও মন্দিরের প্রাচীন অস্তিত্বের চিহ্ন বহন করছে।

আর এই জনপদের প্রাচীন দুর্গাপূজার ইতিহাস ও খুব চমকপ্রদক। এই গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা বলে কথিত হয় চৌধুরীপাড়ার চৌধুরী বাড়ি দুর্গাপূজা তারপর ব্যানার্জি পাড়ার জগদীশ বাচস্পতি (বন্দ্যোপাধ্যায়)র বাড়ির অর্থাৎ বর্তমানে মাকড়দহ বড় বাড়ির পুজো।
চৌধুরী বাড়ির পুজো : - হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের মাকড়দহ গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপুজো হিসাবে পরিগণিত হয় মাকড়দহ চৌধুরী বাড়ির পুজো। আনুমানিক 489 বছর আগে জমিদার জনার্দন চৌধুরী এই পুজো আরম্ভ করেছিলেন। এখন তার বংশধররা এই পূজা টি পরিচালনা করে থাকেন। প্রত্যেক পরিবারের দুর্গাপুজোর কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য থাকে। চৌধুরী বাড়িতেও তা আছে। এখানে কালিকা পুরাণ মতে পুজো হয় । সেই নিয়ম মতে এখানে বলিদান করা হয় । মহালয়ার দিন থেকে এখানে চণ্ডীপাঠ দিয়ে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। চৌধুরীবাড়ী সদস্য তারক চৌধুরীর থেকে জানা যায় যে এখানে নবমী এবং একাদশীর দিন কয়েক হাজার লোক খাওয়ানো হয়। এই বাড়ির প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জন হয় মানুষের কাঁধে। মাকড়দহ মা চন্ডী মন্দির কমিটি এবং চৌধুরী পরিবার পক্ষ থেকে জানা যায় ,চৌধুরী বাড়ি প্রতিমা বিসর্জনের পরেই এলাকার অন্য প্রতিমা বিসর্জন হয়।
মাকড়দহ বাসীর কাছে এই চৌধুরী বাড়ির পুজো একটা অন্যরকম আবেগ আছে। প্রায় প্রত্যেকেই এই বাড়ির পুজোর সাথে একাত্ম থাকে।

ব্যানার্জি বাড়ির বা বড় বাড়ির পূজা :- ব্যানার্জি পাড়ায় বড় বাড়ির পুজোর ইতিহাস আরো চমকপ্রদ। তবে এই বাড়ির পুজো চৌধুরী বাড়ির পুজোর তুলনায় নবীন হলেও এই বাড়ির পুজো আনুমানিক আড়াইশো বছরেরও বেশি। এক্ষেত্রে আনুমানিক কথাটি ব্যবহার করা হল কারণ এই দুর্গাপূজার সঠিক প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই বাড়ির ইতিহাস জানতে হলে সময়ের চাকা কে ঘুরিয়ে 280 বছর আগে বাংলায় শুবে নবাবী শাসন কালে ফিরে যেতে হবে। বাংলার মসনদে তখন নবাব আলীবর্দী খান। 1747 সন নাগাদ উড়িষ্যার দখল নিয়ে তৎকালীন শাসক রুস্তম জঙ এর সাথে মনোমালিন্য শুরু হয় এবং রুস্তম আলীবর্দী খানের হাতে পরাজয় বরণ করেন। এই পরাজয়ের মধ্যে এক  সর্বনাশের বীজ বপন হয়। রুস্তম জং তখন মারাঠা শাসক রাঘবজী ভোঁসলের শরণাপন্ন হন তারপর মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত এর নেতৃত্বে বাংলায় 1741 সন থেকে পরবর্তী 10 বছর ভয়ঙ্কর বর্গী আক্রমন বাংলার বুকে সৃষ্টি করে অভূতপূর্ব ত্রাস। অবাধ লুণ্ঠন হত্যা ধর্ষণের তাণ্ডবে বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম ছারখার হয়ে গিয়েছিল। প্রায় চার লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। প্রাণ ভয়ে মানুষ দিকবিদিক হারিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় হুগলি জেলার শিয়াখালা র বাগান্ডা গ্রাম থেকে মাকড়দহের ব্যানার্জি পরিবারের আদিপুরুষ জগদীশ বাচস্পতির আগমন ঘটে। তিনি ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ। ইতিহাসের কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে আগত ব্রাহ্মণ বংশের উত্তরপুরুষ। 1744 সালে বা তারপর তিনি সপরিবারে বর্গী আক্রমণের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মাকড়দহ আশ্রয় গ্রহণ করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন ইষ্ট দেবতা মহা দুর্লভ  অনন্ত দেব শালগ্রাম শিলা । যেটা আজও বংশপরম্পরায় ব্যানার্জি পরিবারে পূজিত হয়ে আসছে। উপনয়নের পর এই অনন্ত দেব শালগ্রাম শিলা স্পর্শ করার অনুমতি পাওয়া যায়।  এছাড়া এই পরিবারের উত্তরপুরুষ জগদীশ বাচস্পতির  পুত্র রামকান্ত ব্যানার্জি বেনারস থেকে সরস্বতী নদী পথে মাকড়দহ নদীর ঘাটে নিয়ে আসেন একটি শিবলিঙ্গ এবং বড় বাড়ির সামনে মন্দির নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করেন এই শিবলিঙ্গের।

বর্তমানে ব্যানার্জি পরিবার 'বড় বাড়ি' ' মনসাতলা ' এবং 'নতুন বাড়ি 'এই তিনটি এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন । এবং তিনটি বাড়িতেই আলাদা করে দুর্গাপুজো হয়। যদিও এই তিনটি বাড়ির ভরকেন্দ্র জগদীশ বাচস্পতি র মূল বাড়ি,  যাকে বর্তমানে 'বড় বাড়ি' বলা হয়। আজও সেই সুপ্রাচীন প্রথা মেনে এবং প্রাচীন নিয়ম ও তালিকা মেনে পূজো করা হয়। যেমন সপ্তমীতে 17 টি নৈবেদ্য, মহাষ্টমীতে 22 টি নৈবেদ্য, এবং মহানবমীতে 20 টি নৈবেদ্য নিবেদন করা হয় । আগে ছাগ বলি প্রথা থাকলেও বর্তমান পরিবারের সদস্যরা সেই প্রথা নিষিদ্ধ করে চাল কুমড়ো আখ ইত্যাদি বলি দেন। নবমীতে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। এবং সেই ভোগ পারিবারিক সদস্য ছাড়াও গ্রামের রবাহুত এবং অনাহুত মানুষদেরও খাওয়ানো হয়। এদের প্রতিমা বিসর্জিত হয় জগদীশ বাচস্পতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সামনের পুকুরে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours