জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

১৩ অক্টোবর (১৯১১) ভগিনী নিবেদিতার তিরোধান দিবস উপলক্ষে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত দুটি ভবন ঘুরে দেখা!

বাগবাজারে ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি...

সরকারি উদ্যোগে বাগবাজারে ভগিনী নিবেদিতার নবরূপসজ্জিত বাসগৃহটি সমগ্র ভারতবাসীর নিকটেই এক গর্বিত ইতিহাসের বহুমূল্য অধ্যায়।

কী অপূর্ব মুন্সিয়ানায়, কারিগরী নৈপুণ্যে ও আন্তরিক পারিপাট্যে সাজিয়ে তোলা ছোট্ট একটি স্বর্গীয় বাসভূমি।

তাঁর পড়ার ঘর, উঠোন, দোতলায় ওঠার সিড়ি ... নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও অনুভূতির আঁকর।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি গ্রন্থ বিপণনের ব্যবস্থা।

সেবিকাগণের সযত্ন পরিচর্যায় ও অভিভাবকত্বে পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা মধুর হ'য়ে ওঠে।

দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম ও স্থির- অস্থির চিত্রের বুননে মহীয়সী নিবেদিতার জীবন পরিক্রমার প্রয়াসটি চমৎকার ।

উঠোনটি ক্ষুদ্রায়তন।

এই উঠোনেই পায়চারি করতে করতে একদিন স্বামীজি মা কালীকে নিয়ে তাঁর অনুভূতি নিবেদিতার সঙ্গে ভাগ ক'রে নিয়েছিলেন। স্বামীজির কঠিন নির্দেশ ছিল যে সেই কথা যেন কখনোই প্রকাশ না পায়।

শিকাগো ধর্ম-সম্মেলন থেকে স্বামীজি ফিরে আসার পরে, তাঁর অনুমতিক্রমে নিবেদিতা এই উঠোনেই একটি চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। এই ক্ষুদ্র উঠোনটিই সেদিন হ'য়ে উঠেছিল সীমান্তহীন ছায়াপথ - শেষবারের মতো মিলিত হয়েছিলেন দুই যুগস্রষ্টা বিশ্বমানব - রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ।

স্বামীজির নির্দেশে নিবেদিতা কলকাতায় প্লেগ আক্রান্তদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নিবেদিতার নেতৃত্বে এটিই  ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের এই ধরণের প্রথম উদ্যোগ।

প্লেগ আক্রান্ত একটি শিশুকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য নিবেদিতা দিন রাত এক ক'রে তার সেবা করতেন। শেষপর্যন্ত নিবেদিতাকে 'মা' ব'লে সম্মোধন ক'রে শিশুটি নিবেদিতার কোলে মাথা রেখেই মৃত্যুর কোলে ঢ'লে পড়ে।

আর্তের সেবা ছাড়াও নিবেদিতা ভারতবর্ষকে তাঁর মাতৃভূমি জ্ঞান ক'রে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের অভিলক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

সেবার মহতী আদর্শে প্রাণিত হ'য়ে দেশান্তরে স্বীয় কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু সেবার আদর্শের পাশাপাশি একজন আইরিশ মহিলা হ'য়ে বৃটিশ অপশাসনের নাগপাশ থেকে ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনের ব্রতে আত্মোৎসর্গ ইতিহাসের বিরলতম ঘটনা।

স্বামীজি বলতেন "ভগিনী নিবেদিতা"। তিনি অবশ্যই   আপামর বিশ্ববাসীর ভগিনী। কিন্তু শুধুই কি তাই ?

তার মা'য়ের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুগৃহীত সেই প্লেগাক্রান্ত বাকশক্তিরহিত নিষ্পাপ শিশুটির শেষকথাটিই হোক আমাদের প্রথম কথা... 

যার অন্তরে এত মাতৃভাব... এত মমত্বের নির্ঝর, সেই মানুষটি কি 'মা' ব্যতিরেকে আর কেউ হ'তে পারেন...

তাই তিনি আমাদের ...
তাই তিনি সকলের ...

"মা নিবেদিতা" ...


ভগিনী নিবেদিতার অন্তিম ঐহিক আশ্রয় "রায়ভিলা'...

দার্জিলিঙে 'তেনজিঙ  রক' এর নিকটে উচ্চ পাহাড়ি ঢালে সুদৃশ্য ভবন 'রায়ভিলা'। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ভগ্নীপতি ডঃ দ্বারকানাথ রায় প্রতিষ্ঠিত এই বাসগৃহে মোট সাতবার এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। দার্জিলিঙ ছিলো তাঁর বড়ো আদরের স্থান। আচার্য জগদীশচন্দ্রই  তাঁকে এখানে নিয়ে আসেন। দার্জিলিঙের সবুজ সৌন্দর্যের আকর্ষণে স্বামীজিও পাঁচবার এখানে এসেছিলেন। 

এই বাসগৃহেই ১৯৫৪ সালের ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এর ভীত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৭  সালের ২৫ ডিসেম্বর এই প্রতিষ্ঠান বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বাসগৃহটি অধিগ্রহণ ক'রে ২০১৬ সালের ১৬ মে রামকৃষ্ণ মিশনের কতৃত্বে ভবনটি হস্তান্তর করে। নবরূপসজ্জিত 'রায়ভিলা' পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা দেওয়া হয়। 

সবুজ পটিসহ শ্বেত বর্ণের চারতলা ভবনটির পাশেই অবারিত হিমালয়। ভবনটির প্রাচীর ছাড়াতেই তিল তিল ক'রে গভীর খাদে নেমে গিয়েছে পৃথিবী। আর তার অবয়বজুড়ে মেঘের কুয়াশা আর অনন্ত আকাশের অপার শূন্যতা। যেন এক মহাশূন্যের অভয়ারণ্য। 

এই ভবনে রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশনাল এন্ড কালচারাল সেন্টার বহুবিধ প্রশিক্ষণ, শিক্ষামূলক অধ্যয়ন ও সেবামূলক কাজকর্ম করে চলেছে।

ভবনের চারতলার কক্ষটিতে ভগিনী নিবেদিতা তাঁর শেষ স্পন্দন রেখে গেছেন। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর  জন্মান্তরে যাবার আগে এই কক্ষেই তিনি মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তাঁর অন্তিম অনুভব ...

'The frail boat is sinking, but I shall yet see the Sun Rise'.

ভগিনী নিবেদিতার ইচ্ছানুযায়ী দার্জিলিঙ সংশোধনাগারের নিকটবর্তী মুর্দাহাটি শ্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সেখানে এই মহীয়সী নারীর স্মরণে ও শ্রদ্ধায় একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। সেই স্মৃতিসৌধে খোদিত রয়েছে ভারতমাতা নিবেদিতার  প্রথম ও অন্তিম পরিচয় ...

'Here repose the ashes of Sister Nivedta (Margaret E. Nobel) of Sri Ramakrishna - Vivekananda who gave her all to India'



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours