শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

"নেহেরু" শব্দটার উৎপত্তি উর্দু 'নহর' শব্দ থেকে। নহর মানে জলধারাও। 'পন্ডিত রাজ কাউল' দিল্লীর একটি খালের ধারে। বসতি নির্মান করেছিলেন। পন্ডিত রাজ কাউলের বংশধরেরা তাদের নামের আাগে পিছে কাউল ও নেহেরু শব্দগুলো জুড়ে দিতেন। এক সময় তার 'কাউল' শব্দটি তুলে দিয়ে কেবল নেহেরু সংযুক্ত করেন।

নেহেরুরা হলেন আদতে কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিত ব্রাহ্মণ। কাশ্মীরের রাজ কাউল পন্ডিত নামের এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ আরবি ও ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। যার নাম এই রাজ কাউল। ফররুখ শিয়র তখন মোঘল সম্রাট। তার দরবারে এই রাজ কাউলের পাণ্ডিত্যের খবর পৌঁছে। সম্রাট তাকে সাদর আমন্ত্রণে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। স্বপরিবারে দিল্লীতে বসবাস করা শুরু করেন পণ্ডিত রাজ কাউল।

সম্রাট তাকে বসবাস করার জন্য জমি ও বাড়ি নির্মানের টাকাও দেন।এমন কি আবাদের জন্য  চাষাবাদের ভূমি ও ব্যবসা করাী জন্যও নগদ অর্থ সাহায্য দেন। জলাধার বা নহরের পাশে বাড়ি ঘর করে বাস করার কারনে  কাউল নামের সাথে নেহেরু শব্দটি সংযুক্ত হয়ে যায়।
পন্ডিত রাজ কাউলের পু্ত্রের নাম, বিশ্বনাথ কাউল। পন্ডিত বিশ্বনাথ কাউলের তিন পুত্র। পন্ডিত সাহেবরাম, পন্ডিত টিকারাম, পন্ডিত মউসারাম। মাউসা রাম পন্ডিতের পুত্রের নাম লক্ষী নারায়ন। পন্ডিত লক্ষী নারনের পুত্র গঙ্গাধর নেহেরুর ছিলো তিনপুত্র দুই কন্যা। পন্ডিত বংশিধর নেহেরু,পন্ডিত নন্দলাল নেহেরু, পন্ডিত মোতিলাল নেহেরু। 

পন্ডিত রাজ কাউল হলেন, ভারতের বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও রাজনীতিক মোতিলাল নেহেরুর পূর্বপুরুষ। পন্ডিত মতিলাল নেহেরুর এক পুত্র দুই কন্যা। পুত্র  জওহরলাল নেহেরু  ও কন্যা পন্ডিত বিজয়লক্ষি নেহেরু  ও কৃষ্ণা নেহেরু।  পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু হলেন,পন্ডিত  ইন্দীরা নেহেরু পিতা। পন্ডিত ইন্দীরা নেহেরু ; ইন্দীরা গান্ধী নামে ভারতীয় রাজনীতির  ইতিহাসে পরিচিত।
 
আঠার শতকে নেহেরু বংশের আদি পুরুষ পন্ডিত রাজ কাউল মোঘল  দরবারে চাকুরী করতেন। আবার  মোতিলাল নেহেরুর পিতা গঙ্গাধর নেহেরু মোঘল শাসনামলে পুলিশের চাকুরী করতেন দিল্লীর কতোয়াল পদে। মোতিলাল নেহেরুর পিতামহ, পন্ডিত লক্ষী নারায়ন  বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এডভাইজার হিসেবে দিল্লীর মোঘল দরবারে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী  বিপ্লবের 
সময় দিল্লী থেকে নেহেরু বংশ আগ্রার তাজ মহলের কাছাকাছি বাড়ি করে। মোতিলাল নেহেরু আগ্রাতেই জন্ম নেন। তিনি গর্ভে থাকতেই তার পিতা মৃত্যু বরন করেন। জ্যাঠা নন্দলাল নেহেরুর স্নেহে প্রতিপালিত হন।নন্দলাল নেহেরুও ছিলেন আগ্রার হাইকোর্টের উকিল। হাইকোর্ট আগ্রা থেকে এলাহাবদে  স্থানান্তরিত হলে নেহেরু  বংশের সবাই  এলাহাবাদে চলে যায়। 

নেহেরু পরিবারের সদস্যরা  বাড়িতে পন্ডিত ও মৌলভী রেখে সংস্কৃত  হিন্দি উর্দু ফার্সী শিখতেন। জওহর লাল নেহেরু বাল্যকাল থেকে ব্যারেস্টারি পাশ করা পর্যন্ত ইংরেজদের বেশ ভূষায় সজ্জিত থাকতেন। বিলেতি সাহেবী কায়দা ছিলো তার চলাফেরায়। কিন্তু তিনি ও তার পিতামাতা সহ  মোহন লাল করমচাঁদ  গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর তার পোষাক ও চলাফেরায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। জওহর লাল নেহেরুর মা ও ছিলেন কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। জওহর লাল নেহেরুর মায়ের বংশও কাশ্মীর উপত্যকা থেকে চলে এসে এলাহাবাদে বসবাস করতো।

 বাল্যশিক্ষক মুন্সি মোবারক আলীর নিকট থেকে ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোর কাহিনীও তাকে এক সময় বৃটিশ বিরোধী অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯১৬ সালে লখনৌ কংগ্রেসে জওহর লাল নেহেরুর সাথে গান্ধজীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় জওহর লাল " হোমরুল লীগে" সংযুক্ত হয়ে ছিলেন। ১৯১৬ সালেই কমলা কাউরকে বিয়ে করেন। দুবছর পরই জন্ম নেয় 'প্রিয়দর্শিনী ইন্দীরা'।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জওহর লাল নেহেরুর ভারত বর্ষের সব বড় নেতাদের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। জওহর লাল নেহেরু প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের বুর্জোয়া শক্তির সাথে পেরে উঠেননি একা। পিতার আদর্শে  প্রিয়দর্শিনী ইন্দীরা গান্ধী সমাজতন্ত্রের কিছুটা ভাবাদর্শগ্রহনও করেছিলেন। 
জওহর জওহরলাল নেহেরু  নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ও সভাপতিও নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়  ইংরেজরা তাকে বন্দী রাখে আহামেদাবাদ দূর্গে।তিন বছর জেলে বন্দী ছিলেন। বন্দীকালিন তিনি বই  লিখেন। লেখক হিসেবেও এ রাজনীতিক সমাদৃত। 

পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভ ভাই পাটেল ভারত বিভাগ মানতে চাননি। গান্ধীজির নির্দেশেই এ দুজন ভারত বিভাগ মেনে নেন। পন্ডিত জওহরলাল স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।  একটানা ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। তবে দেশ ভাগের পর নেহেরু পাকিস্তানের সাথে সর্বদা বন্ধুসূলভ আচরন করতে চাইতেন। আর সর্দার পাটেল ঠিক উল্টো। দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের সাথে বৈরী মনোভাব রাখতেন।

নেহেরুর মৃত্যুতে তার তীব্র সমালোচক জুলফিকার আলী  ভুট্টো বলছিলেন;
" A very sad day for all of us. We had differences with Jawharlal Nehru.  But he was my hero when i was a student. He is surely a part of us. A very great man indeed, a very great idealist.  A very great gentleman is gone, and subcontinent is all the poorer for it." 

প্রিয়দর্শিনী ইন্দীরা গান্ধীর পিতা জওহর লাল নেহেরু। রাজীব গান্ধীর নানা। রাহুল গান্ধী মোতিলাল নেহরুর প্রপৌত্র। রাহুল গান্ধী তার নানীর  দিক থেকে  কাশ্মীর পন্ডিত রাজ কাউলের বংশধর।  হিন্দু পন্ডিত রাজ কাউল কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে দিল্লীর সম্রাট ফররুখ শিয়রের দরবারের তার সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সীর উপর পান্ডিত্যের জোড়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours