দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

সারা দেশে মা কালীর পুজো অমাবস্যার রাত্রে হয়। কিন্তু মহারাজ নন্দকুমারের আবাসভূমি আকালীপুরে মা কালীর পুজো দিনে হয়। ছাগ বলিও হয় দিনে। এই পুজো জরাসন্ধর কালী পুজো নামে খ্যাত। মা এখানে ভয়ঙ্কর দর্শনা। সাপের কুণ্ডলীর উপর পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা।  দেহের অলঙ্কারও সাপের। রাজ পরিবারের পুজো হলেও, রাজারা এই সময় আসেন না। তাঁরা আসেন তিনবার ফিবছর। বিজয়া দশমীতে চতুর্দশী তিথিতে কালী পুজোয়। আর মাঘ মাসে  সরস্বতী পুজোর চার পাঁচ দিন আগে রটন্তী কালী পুজোয় এবং পৌষ মাসের শেষ দিন মকর সংক্রান্তির মেলায়।

বীরভূমের নলহাটি থানার আকালীপুর গ্রামে এই কালী অধিষ্ঠিত। উত্তরবঙ্গ গামী বাসে গেলে নগরার মোড়ে নামতে হয়। সেখান থেকে তিন কিমি ভ্যানে গেলে আকালীপুর মায়ের মন্দির। কাছেই মহারাজ নন্দ কুমারের ভিটা। সেই প্রাসাদ আর নেই। তবে রাজ বংশের লোক আছেন ভদ্রপুর এবং বহরমপুরের কুঞ্জঘাটায়। বহরমপুরের কুঞ্জঘাটায় অশীতিপর রাজা গৌরী শঙ্কর রায় প্রধান সেবাইত। বর্তমানে তাঁর তিন ছেলে ভবানী শঙ্কর রায়, প্রকাশ শঙ্কর রায় ও গিরিজা শঙ্কর রায় এই মন্দিরের উত্তর সূরী। মহারাজ নন্দ কুমারের শেষ বংশধর অপুত্রক হওয়ায় নন্দ কুমারের মধ্যম ভ্রাতা রাজ কৃষ্ণ রায় দত্তক পুত্র নেন তাঁরই তিন বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বোনের ছেলেকে। তাঁরাই বর্তমান উত্তর সূরী বলে জানান গৌরী শঙ্কর রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভবানী শঙ্কর রায়। এই পুজো জরাসন্ধর কালী পুজো নামে খ্যাত। সে এক লম্বা চওড়া ইতিহাস আছে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ পুরাকালে মগধের রাজা জরাসন্ধ পাতালে মাকালীর সাধনা করত। তখন বিহারের গয়াকে মগধ বলা হত।
কথিত, জরাসন্ধের মৃত্যুর পর বহুদিন মাটির নিচে থেকে যায় এই কালী। রাজস্থানের যোধপুরের রানী অহল্যা বাঈ কিছুদিন মগধে ছিলেন।  সেই সময় শিবের স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি মগধের একটি জায়গায় খনন কার্য্য করান। সেখানেই শিবলিঙ্গের পাশাপাশি একটি মাত্র কষ্টি পাথরে তৈরী বেদী সমেত মূর্তি পান। যেহেতু মূর্তি প্রাপ্তির জায়গাটি কাশীরাজ চৈত সিংহের, তিনি সেটি কাশিরাজকে দিয়ে দেন।  কাশী উত্তর প্রদেশে হলেও, মগধে রাজত্ব করতেন চৈত সিং। কিন্তু মূর্তিটি তদানীন্তন ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের নজরে পড়ে যায়। তিনি মূর্তিটি ইংল্যাণ্ডের মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে চান। তাই হেস্টিংসের হাত থেকে মূর্তিটিকে বাঁচাতে রাজা চৈত সিং মূর্তিটিকে কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে গঙ্গার জলে লুকিয়ে রাখেন। কালক্রমে মহারাজ নন্দকুমার কাশী পৌঁছান। তখন তিনি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার অধীন বাংলার দেওয়ান। একদিন রাত্রে তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান মূর্তিটিকে গঙ্গাবক্ষ থেকে উদ্ধার করার জন্য। তিনি সেই স্বপ্নাদেশের কথা পরের দিন কাশীরাজ চৈত সিংকে জানান।  চৈত সিং বুঝলেন মায়ের ইচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন গঙ্গা বক্ষ থেকে মূর্তি উদ্ধারের। সেই মূর্তি মহারাজ নন্দকুমার নিয়ে আসেন গঙ্গা পথে হুগলী হয়ে মূর্শিদাবাদে। মূর্শিদাবাদের গঙ্গা থেকে আসেন দ্বারকা নদে। দ্বারকার সঙ্গে যোগ আছে ব্রাহ্মণী নদীর। তাই দ্বারকা নদ হয়ে তিনি ব্রহ্মাণী নদীতে নৌকা ভাসান। নৌকা এসে ভেড়ে আকালীপুর গ্রামের ধারে। মূর্তিটিকে নামানো হয় নদীর ধারে বটগাছের নীচে। তারপর এক মানুষ মাপের দৈর্ঘ্যের দূরত্ব অনুযায়ী মূর্তিটিকে প্রতিদিন ঘাট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বট গাছের নীচে মায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় মহারাজ নন্দ কুমারকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসায় ইংরেজরা। তিনি বন্দী হন। সেই জন্য অসম্পূর্ন মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন নন্দকুমারের ছেলে গুরুদাস রায়। ফলে মন্দিরে কোন চূড়া ছিল না। মহারাজ নন্দকুমারের বিচারের পর ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ৫ অগাস্ট ফাঁসি হয়। কালক্রমে রাজা গুরুদাস রায় ও রাণী জগদম্বা অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। এরপর তাঁদের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের ছেলেরা অর্থাৎ দৌহিত্ররা মায়ের পুজোর দায়িত্ব নেন। ১৭৭৫ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মোট ২৩৫ বছর মন্দিরে কোন সংস্কার হয় নি। অনেক ভক্ত স্বেচ্ছায় সংস্কার করতে চাইলেও রাজ পরিবার তার অনুমতি দেন নি। ২০০৪ সমাজবাদী পার্টি নেতা ও মন্ত্রী কিরন ময় নন্দ আকালীপুর মাকালী দর্শনে আসেন। তাঁর অনুরোধে রাজা গৌরী শঙ্কর রায় মন্দির সংস্কারে সাড়া দেন। আগে সংস্কার বশতঃ রাজ পরিবারের সংস্কারের কাজে ভয় কাজ করত। যাহোক পুরানো শৈলীকে বজায় রেখে এই মন্দির সংস্কার হয়। পরবর্তীকালে রাণী ভবানী ৩৬৫ বিঘা সম্পত্তি দান করেন মায়ের সেবার উদ্দ্যেশে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের জমিদারী প্রথা বিলোপের পর দেবোত্তর সমেত মহারাজ নন্দ কুমারের সমস্ত সম্পত্তি সরকারী আইনে অধিকৃত হয়।

রাজ পরিবার মামলা করে। মহামান্য আদালতের নির্দেশে সামান্য বার্ষিক খরচ পান। তাতে কোন সঙ্কুলান না হওয়ায় রাজপরিবারকেই নিজ ব্যয়ে এই দৈনিক পুজো চালাতে হয় বলে জানান দেবাশীষবাবু। প্রধান সেবাইতকে বার্ষিক ৩৬০ টাকা দেওয়া হয়। গ্রামের ঢুলিকে কিছু জমি দেওয়া ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা না থাকায় ঢুলিরা কদাচিৎ বাজায়। সকাল সাতটায় মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে এগারোটায় ভোগ পুজো হয়।  সন্ধ্যে সাতটায় আরতি হয়ে মন্দির বন্ধ হয়।  রাজপরিবারের নির্দেশ অনুযায়ী ভোগের মধ্যে থাকে ভাত, একটি ভাজা, মুগের ডাল, তরকারি ও তেঁতুল দিয়ে মাছের টক। পুরানো নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন দশ পোয়া অর্থাৎ প্রায় দু’কেজি আতপ চালের ভোগ হয়।  আগে ভোগের জন্য মাথা পিছু ১২ টাকা নেওয়া হত। এখন ৩০ টাকা নেওয়া হয়।

মা এখানে ভয়ঙ্কর দর্শনা। সাপের কুণ্ডলীর উপর পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা। একটি মাত্র কষ্টি পাথরে মূর্তিটি তৈরী।  হাতে ও পায়ে সাপের চুড়ি ও নুপুর। মাথায় সহস্র নাগের ফনা যুক্ত মুকুট। সবই পাথরের উপর খোদায় করে তৈরী অলঙ্কার। এরপরে রঙ করা হয়েছে। এই কালীকে গুহ্যকালী বলা হয়। শুধুমাত্র পাতালে থাকার জন্য এই নাম করণ হয় নি বলে জানান দেবাশীষবাবু। তিনি বলেন, “উপনিষদে বলা আছে, সাধকের সাধনার সুবিধার্থে ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করা হয়। তাই এই খানে দেবীর এমনি রূপ। এই দেবীর মন্দির অষ্টকোনাকৃতি। অর্থাৎ অষ্টাঙ্গিক যোগের কথা বলা হয়েছে।  দেবী সাপের কুণ্ডলিনীর উপর বসে। যা প্রতীক হিসেবে কুল কুণ্ডলিনী জাগানোর কথা বলা হয়েছে। এরপর মনকে সহস্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে সহস্র ফনার মুকুটের মাধ্যমে। সাধনার গুহ্য বা গোপন ইঙ্গিত এই মূর্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এক অভিনব শিল্প কর্মের মাধ্যমে। মায়ের দেহের উপরিভাগ উন্মুক্ত। নিম্নভাগে ঘাগড়া পড়ানো। তবে কোন ভক্ত চাইলে, সাময়িকভাবে দেহের উপরিভাগে ওড়না পড়ানো হয়”।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours