কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"মেঘ কালো আঁধার কালো
আর কলঙ্ক যে কালো..."
তারচেয়েও কালো মাকালী।
ঘোর কালো দেবী মূর্তি। তার ওপর নগ্ন। এলোচুল। এ পর্যন্ত গোটাটাই এক প্রচন্ড শক্তির আধার। বিপর্যয়ের ছবি। ভক্তিতে মাথা নামুক না নামুক, ভয়ে নামবেই।
কিন্তু এর পরেই চমক। শিল্পী দেবীমূর্তির ঠিক যে মুহূর্তটিকে তুলে ধরেছেন, সেখানে দেবীর চোখেমুখে হিংস্রতার লেশমাত্র নেই। বরং লাজে রাঙা! বিস্ফারিত চোখ। লজ্জায় জিভকাটা। যদিও পটভূমি বা পরিপ্রেক্ষিত উল্টোটাই।
অদ্ভুত এক শৈল্পিক ঘাত। সম্পূর্ণ বিপরীত দুই আবেগের সমন্বয়। ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের এক চরম কল্পনা। মনের ভেতর কোথাও যেন এক অনুরণন তৈরি হয় দেবী কালীর সামনে দাঁড়ালেই। আর এই ঘাত তৈরির প্রধান সহায় দেবীমূর্তির গায়ের কালো রং। ত্বকের এই কালো রংকে আরও প্রকট করে তুলতেই যেন দেবী নগ্নিকা। সব মিলিয়ে গোটা ব্যাপারটা দারুণরকম 'বোল্ড'। কিন্তু এই 'বোল্ড' ব্যাপারটা কি ঠিক বাঙালি মেজাজের সঙ্গে যায়? এ নিয়ে তর্ক বাঁধতেই পারে।

"অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো!"
দেবীর কালো মেয়ের এই রূপ একেবারেই দেশজ। তবু শাস্ত্র বলে কথা! তার নিজস্ব মত আছে। আবার ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রেরও। তবে মোটামুটি ব্যাপারটা এরকম, সব বর্ণের অতীত কালো। সাতবর্ণ মিশেও কালো। আবার মহাশূন্যের রংও কালো। সেই মহা বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপ ধরা পড়েছে দেবীর বর্ণে।
বিজ্ঞানের ভাষায় সর্ববর্ণের সমন্বয় কালো। দুনিয়ার সব আলো গিলে ফেলার ক্ষমতা ধরে। এমনই তার শক্তি। আবার অনেক ধর্ম বা সামাজিক রীতিতে কালো শোকের রং। অশুভের ইঙ্গিত। বয়ে আনে মৃত্যুর বার্তা। প্রতীক তীব্র যৌনতার। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। মিশরে কালো, জীবন আর পুনর্জন্মের রং। ফেংসুইয়ে কালো মানে শক্তি, রহস্য আর শান্তির প্রতীক।

কালো জগতের আলো।
আমরা বলি ঠিকই। কিন্তু বাস্তবে তা একেবারেই উল্টো।
দেবী কালিকাও কিন্তু অনেক জায়গাতেই কালো কুচকুচে নন। তাঁর ত্বকের কালো যেন কেমন ফিকে। ত্বকে যেন কালোর এক স্তর কম চেপেছে। দেবী সেখানে ঘন নীল। আবার কোথাও বা শ্যামা। কবি গান বেঁধেছেন- শ্যামা মা কি আমার কালো রে!
কেন? কালীঠাকুরের  গায়ের রং নিয়েও টানাটানি কেন? আসলে যতই আমরা বাতেলা ঝারি না কেন, বাস্তবে কালো আমাদের নাপসন্দ। পুজো আরাধনা করছি ঠিকই, তবু তারমধ্যে মাকালীকে খানিকটা আমাদের মনমতো  তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে! ঠিক যেমন মা বাবা কাকারা ছেলেবিয়ের জন্য মেয়ে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেকে বোঝান, "মেয়ের গায়ের রং ঠিক কালো না। শ্যামলা।"
অথবা, "মেয়ে দেখতে দারুণ। তবে গায়ের রংটা ময়লা।"
"ঠিক কালো না। গায়ের রংটা চাপা!"
ভাবুন দেখি ব্যাপারটা। চামড়ার রং কালো বলতেও ইজ্জত যায়। কতো না টালবাহানা! এমনকি হয়ত নিজের অজান্তেই, কালোর উপমা হলো ময়লা। তাই প্রাণপণ চেষ্টা কালোর সিলমোহর থেকে বাঁচতে। শ্যামলা, রং ময়লা, চাপা গায়ের রং বলে কুলরক্ষার নিরীহ চেষ্টা।

"শ্যামা মা কি আমার কালো রে?"
রং পাল্টেছে মা কালীও। কোথাও তা কালো না হয়ে, ঘন নীল। আবার কোথাও বা শ্যামাকালী।
কালো মেয়ের পুজো করতেই পারি। তাকে নিয়ে কাব্য করতেও বাধা নেই। "মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে, ও কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।" গাঁয়ের লোক তাকে কালো বললেও, কবি আদর করে 'কৃষ্ণকলি' বলে ডাকতেই পারেন। প্রেম করাও চলতে পারে। তবে বিয়ের প্রথম শর্ত, দুধে- আলতা গায়ের রং না হলেও চলবে। কিন্তু ফর্সা মাস্ট। সুন্দরীর প্রথম ব্যাখ্যা, গৌরবর্ণ। নইলে ছেলেপুলেগুলোও হবে কালো- কালো! কেলটে সোনা। কালিন্দী।
মেয়েদের বেলায় ছবিটা একটু অন্যরকম। অনেক মেয়ের সঙ্গেই কথা বলে দেখেছি, ফর্সা টুকটুকে ছেলে তাদের খুব একটা পছন্দ নয়। চাপা রং হলে চলবে। তবে খুব বেশি কালো কোন ভাবেই প্রেফারেবল না। কিন্তু নিজের বেলায় মেয়েটি যত দূর সম্ভব ফর্সা হতে চায়। কেন, একি ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই? বাজারে ফর্সা মেয়ের কদর বেশি। তাই মুখে বেসন ঘষে, হলুদ বাটা মেখে যেভাবে হোক ফর্সা হতেই হবে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বেনিয়ারা। কেউ সাতদিনে, কেউ একপক্ষ কালের মধ্যে, ফর্সা করে দেওয়ার গ্যারান্টি দিয়ে ক্রিম বিক্রি করে চলেছে। 

"সখী কালো আমার ভালো লাগে।"
হ্যাঁ এমন পুরুষও আছেন যার পছন্দ শ্যামলা মেয়ে। তবে সেই পুরুষ কি নিজে কালো হতে চায়? মনে হয় না। কারণ ফর্সা চামড়ার ওপর ছেলেমেয়ের সমান দুর্বলতা। কালী ঠাকুরই একমাত্র ব্যতিক্রম। নইলে অন্য দেবদেবীর দিকে তাকান, সবাই ফর্সা টুকটুকে। এমনকি অমন যে বোহেমিয়ান দেবাদিদেব মহাদেব, তিনিও দিব্য ফর্সা। তবে আছেন আমাদের বিষ্ণু আর ভালবাসার ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ। দুজনেই নীলবর্ণ। কালো না কিন্তু।

কালো মানুষকে অবহেলা করার এই মানসিকতার উৎসাহে ঠিক কোথায়? আমাদের স্বর্গবাসী দেবদেবীরাও সবাই ফর্সা ঝকঝকে তকতকে। আবার গির্জার দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে তাকান। সব নারীরাই ফর্সা। বক্সার মহম্মদ আলি নাকি তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফর্সাপরীরাই কি শুধু স্বর্গে যায়? আর কালোপরীরা রান্নাঘরে? এমন এক অদ্ভুত ধারনা জড়িয়ে গেছে কালো রংয়ের সঙ্গে। আবার ধরুন কিছু শব্দ। খারাপ অর্থ বোঝাতে হলেই 'ব্ল্যাক'। যেমন,  ব্ল্যাকমেল, ব্ল্যাক ডে,  ব্ল্যাক আউট। তবে শক্তি বোঝাতেও কিন্তু 'ব্ল্যাক' শব্দের অর্থ ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়। যেমন বিশেষ ভাবে শিক্ষিত বাহিনী ব্ল্যাক ক্যাট, জুডো ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট।

অনেকে আবার বলেন আমাদের এই ফর্সাপ্রেম, আসলে উপনিবেশবাদের ফসল। বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবের খবর আজও উঠে আসে খবরের শিরোনামে। চামড়ার রঙের সঙ্গেই জড়িয়ে জাত্যাভিমান। এমনকি তারজন্যই হলিউডের ক্লিওপেট্রা ফর্সা। বাস্তবে সেই জগদ্বিখ্যাত সুন্দরীর গায়ের রং ছিলো কালো। এমনকি কালোচামড়া প্রীতি মানুষকে কত অধঃপতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে মজার গল্পও আছে। ভারতের ব্রিটিশ প্রভুদের নাকি মন মজেছিলো নেটিভ শ্যামবর্ণা সুন্দরীতেই। আবার লালমুখো সেনাদের পছন্দ ছিলো কালোসুন্দরীদের ঠান্ডা গায়ের উষ্ণতা। মেমসাহেবের ত্বকে সেই হিমেল স্বাদ পেতেন না সাহেবরা। ব্রিটিশ প্রভুদের ওই কালোপ্রীতিতেই নাকি রাজপাট জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল, অনেকেই এমন রসিকতা করেন।

তবে কালোরও কদর আছে বৈকি। সেই কদরের গোটাটাই মানবিক না, পাশবিক। কালো কচিপাঠার মাংস আর কালোগরুর দুধ। এই দুইয়ের কদরে বাঙালি একমত।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours