মৌসুমী মণ্ডল, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

"কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দিরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা কর। সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই আমি পূজা গ্রহণ করব।"

সালটা ১৮৪৭। ধনী বিধবা রাণি রাসমণি কাশী যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২৪টি নৌকা প্রস্তুত করেন। সঙ্গে আত্মীয়স্বজন, দাস-দাসী ও রসদ নিয়ে রওনার তোড়জোড় চলতে থাকে। কিন্তু যাত্রার পূর্বরাত্রে দেবী কালিকার স্বপ্নদর্শন পান। দেবী রাণিকে স্বপ্নে ঠিক উপরিউক্ত কথাগুলোই বলেছিলেন। এই স্বপ্নের পর রাণি অবিলম্বে গঙ্গাতীরেই জমি ক্রয় করে মন্দির তৈরীর আদেশ দেন। ১৮৪৭ সালে এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় আর শেষ হয় ১৮৫৫ খ্রী: - এ। শোনা যায় তৎকালীন দিনে এই মন্দিরটি তৈরী করতে রাণিমা-র খরচ হয় ৯লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এর একটি অংশ ছিল মুসলমানদের গোরস্থান এবং জমিটির আকার ছিল কচ্ছপাকার। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে 'স্নানযাত্রার দিন' দক্ষিণেশ্বরের এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন রাণি রাসমণি দেবী। এই মন্দিরে দেবী কালিকা 'ভবতারিণী' নামে পরিচিতি পান। ১০০ফুটেরও বেশী উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য পদ্মের উপর, শায়িত শিবের উপর ভবতারিণী দন্ডায়মান। শোনা যায় একটি পাথর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই মূর্তির।

মন্দির ও মূর্তি দুই-ই প্রতিষ্ঠা হল। পূজারী পাওয়া যাবে কোথায়? রাণি কৈবর্ত্য জাতির অন্তর্গত শুনে তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ শুধু রাণিকেই নয়! মা ভবতারিণীকেও বয়কট করে বসলেন। কৈবর্ত্যের হাতের বানানো মন্দিরে তাঁরা পুজো করবেন না। এই ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের শেষ কথা। এবং যে ব্রাহ্মণ ওই মন্দিরের পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাঁকে ব্রাহ্মণ সমাজ একঘরে করবে। শোনা যায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের উদ্বোধনের নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় জানান রাণি কৈবর্ত্য জাতি। তাঁর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে একঘরে হতে হবে তাঁকে। কিন্তু রাণির বিশ্বস্ত কর্মচারীরা তাঁকে বোঝান রাণি কৈবর্ত্য জাতির অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি মাহিষ্য জাতির অন্তর্গত। শেষ পর্যন্ত রামকুমার রাজি হন। এবং তাঁর ভাই গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে এসে উপস্থিত হন। শোনা যায় রামকুমার মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করলেও গদাধর দোকান থেকে মুড়ি, মুড়কি কিনে খেয়েই ক্ষিদে নিবারণ করেন। পরে দাদার নির্দেশেই পঞ্চবটীতলে নিজে হাতে রান্না করে খেতেন এবং রাতের খাবার হিসাবে মন্দিরের প্রসাদী লুচি খেতেন। সেইসময় হতদরিদ্র্য মানুষেরাও দক্ষিণেশ্বরের প্রসাদ গ্রহণ করতেন না। খাওয়ার লোক না থাকায় প্রসাদ গরুকে দেওয়া হত বা গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া হত। ভবতারিণীর সেবাকে গদাধর অর্থাৎ রামকৃষ্ণদেব কোনোদিনও চাকরি হিসেবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু রাসমণির জামাই মথুরবাবু একপ্রকার জোর করেই বিষ্ণুঘরের পুজোর দায়িত্ব দিলেন। এবং ভাগ্নে হৃদয়কে দুই ভাইয়ের সাহায্যকারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। কিছুকাল বাদে রামকৃষ্ণের পুজোর আদব কায়দা দেখে মথুরবাবু অবাক হয়ে যান। তিনি রাণি মা কে জানান যে এক অদ্ভুত পূজারী পাওয়া গেছে। দেবী বোধহয় শীঘ্রই জাগ্রত হয়ে উঠবেন।

সেই পাঁচটাকা মাসিক বেতন দিয়ে শুরু হয় গদাধরের পথচলা। গদাধর হয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। পরে ঠাকুর নামেই পরিচিত হন সকল লোকের মাঝে। এভাবেই কৈবর্ত্যের তৈরী দক্ষিণেশ্বর এক সাধকের জন্ম দেয়। দক্ষিণেশ্বর হয়ে ওঠে মা ভবতারিণী ও তাঁর সন্তানের মিলনস্থল।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. অনেকগুলো তথ্য এক জায়গায়। ভালো লাগলো!

    ReplyDelete