কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

আগামী নোবেল পুরস্কারের জন্য রাহুল সিনহার নাম প্রস্তাব হলেও, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

কোনও খাটাখাটনির দরকার নেই। গবেষণা না করলেও চলবে। নোবেলপ্রাপ্তির রাহুলীয় তত্ত্ব, "চাই শুধু একজন বিদেশী স্ত্রী।" ব্যাস, তাহলেই বিনায়কের সিদ্ধিলাভ। বৈপ্লবিক তত্ত্ব, সন্দেহ নেই।

এবার এক প্রশ্ন।
রাহুলবাবুর বৈপ্লবিক তত্ত্ব সামনে আসতেই তো ফুঁসে উঠলো যাবতীয় বিজেপি বিরোধী শিবির। অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে, সমবেত স্বরে রাহুল সমেত গোটা বিজেপি দলটাকেই দেগে দেওয়া হলো অর্বাচীনের দল বলে। হাজারো চোখা চোখা বচন। পাগলে কী না বলে ছাগলে কি না খায়! পাশাপাশি বিজেপি বিরোধীরা গর্ব বোধ করেছেন অভিজিতবাবু, অমর্ত্য সেনের মতো নোবেলজয়ী বঙ্গসন্তানদের এহেন কীর্তি নিয়ে। এবার বুকে হাত রেখে বলুন তো, এই দুজনের নীতির ঠিক কতটা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সরকারি স্তরে?

যাই হোক, আবার বিজেপি'র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহার কথায় ফিরে আসি। অভিজিতবাবুকে নিয়ে মন্তব্য করার আগে, রাহুলবাবু নিশ্চয়ই গবেষণা করেছিলেন। হাজার হলেও তাঁর একটা পদমর্যাদা আছে। বিজেপির পদস্থ কর্তা তিনি। সোশ্যাল মেডিয়ার অর্বাচীনদের মতো তিনি ফেকলু নন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর্ত্য সেনের নোবেলপ্রাপ্তি। এই দুজনের নোবেলপ্রাপ্তির রহস্য জানতে তিনি প্রায় গোয়েন্দার ভূমিকা নিয়ে ফেলেছিলেন।
বিজেপি বিরোধী শিবির তর্ক করে দেখতে পারেন রাহুলবাবুর গোয়েন্দাগিরিকে ঠিক কোন পর্যায়ে ফেলা হবে। সত্যজিত রায়ের ফেলুদা নাকি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সি?  নিদেনপক্ষে সেই স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজের দীপক চ্যাটার্জী। তবে বিরোধীরা যতই গলা ফাটান না কেন, রাহুলবাবু ঠিক ধরে ফেলেছেন এই নোবেলজয়ের অনুপ্রেরণা কার। রাহুল সিনহার পর্যবেক্ষণ, যাঁদের দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশী, তাঁরাই নোবেল পেয়ে যাচ্ছেন।

এতো গেল নোবেলপ্রাপ্তির রহস্য। এবার দেখে নেওয়া যাক, অভিজিতবাবুর গবেষণা নিয়ে রাহুলবাবু কী বলেছেন। অভিজিতবাবুরা অর্থনীতিকে বামপন্থীদের রংয়ে রাঙিয়ে নিয়েছেন। একথা অবশ্য নতুন না। রাহুলবাবুর অনেক আগেই ওই কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় রেল ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। মাননীয় মন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে রাহুলবাবুর মন্তব্য, বামপন্থীরা গোটা দুনিয়ায় খারিজ হয়ে গেছে।

ব্যাস আর যায় কোথায়? তেড়ে উঠলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সুজন চক্রবর্তী। রাজা যায়, রাজ্য যায়, রাজার মেজাজ যায় না। "মেজাজটাই তো আসল রাজা আমি রাজা নই।" তবে একটা ব্যাপারে খটকা লাগে। মার্কিনি আকাশ বাতাসের ওপরেও কেমন যেন এক ঘোর বিতৃষ্ণা ছিলো বামপন্থীদের। কথায় কথায় খিস্তিখেউড় করতেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সিলমোহর দেগে দিয়ে। খাতা- কলমে অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো আজ মার্কিন নাগরিক। তাঁর এতো দরাজ প্রশংসা করছেন কিভাবে সুজনবাবু ?
আবার হঠাত করেই দারুণ উদার হয়ে গেলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি সাফ কথায় জানিয়ে দিলেন, কোনও অর্থনীতিকেই বামপন্থী দক্ষিণপন্থী বলে পরিত্যাজ্য করা যায় না। তা মানুষের কল্যাণে লাগলেই গ্রহণীয়। ওদিকে গেরুয়া শিবিরকে একহাত নিতে ছাড়লেন না কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তাঁর পরিচিত কেতায় বলে দিলেন, পাগলে কিই না বলে! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র যে অভিজিতবাবুর প্রশংসা করবেন তা স্বাভাবিক। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের 'ন্যায়' প্রকল্পের রূপরেখা তৈরির অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন এই নোবেলজয়ী। 

বিজেপি যে অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বকে গ্রহণীয় মনে করবে না, তা আর নতুন কি?
রেলমন্ত্রীর বক্তব্যে কারণটাও পরিষ্কার। পদ্ম শিবিরের মত, অভিজিতবাবু যে অর্থনীতির প্রবক্তা তা বামঘেঁষা। এর আগে অমর্ত্য সেনের সঙ্গেও সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দিয়েছিল বিজেপির ওই একই কারণে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে অমর্ত্য স্পষ্ট কথায় জানিয়েছিলেন, বিজেপি এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসুক। তার জবাবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়েছিলেন, অমর্ত্য সেনের মতো মানুষরা সবসময়েই সমাজকে ভুল পথে চালিত করেন।
অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিজেপির সাপে নেউলে সম্পর্কের ইতিহাসটা বেশ পুরনো। প্রথম মোদি সরকারের আমলেই। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিকে লেখা এক চিঠিতে অমর্ত্যবাবু জানিয়েছিলেন, তিনি দ্বিতীয় বার আচার্য পদের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী না। কারণ বিজেপি সরকার তা চায় না।

প্রসঙ্গত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের উদ্যোগেই ২০০৫ সালে আধুনিক নালন্দার রূপরেখা তৈরি হয়। তার দু বছর পর থেকেই অমর্ত্য সেন ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে তাঁর আচার্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, দ্বিতীয় বার ওই পদে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখাননি তিনি। এরপরেই বিজেপি'র নানা মহল থেকে অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে।

স্বাভাবিকভাবেই অমর্ত্য সেনের মতোই অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজেপি'র কাছে অস্পৃশ্য। কিন্তু আজ যারা অভিজিতবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরাও কি ওঁর দেখানো পথে হাঁটবেন? ইতিহাস সেরকম সম্ভাবনার কথা বলা তো দূরে থাকুক, ইঙ্গিতও দেয় না।

তাতে অবশ্য কোনও পক্ষেরই কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিদেশে বসে আরও  গবেষণা চালিয়ে যাবেন তাঁদের বিষয় নিয়ে। নতুন নতুন দিক খুলে যাবে সম্ভাবনার। কাগজে কলমে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর করার নানা পথ বাতলাবেন সরস্বতীর বরপুত্ররা। এরচেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতাও ওঁদের নেই। কারণ অর্থনীতি নিয়ে শেষ কথা বলবেন আমাদের ভারতীয় গণতন্ত্রের সেরা রাজনীতিবিদরাই। আর কেউ খুঁজে বেড়াবেন নোবেলজয়ের রহস্য।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours