নাজমীন মুর্তজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

বিদেশের ব্যস্ত জীবনের ছন্দে 
দূর্গা মায়ের আগমনের খবর অজানা থাকে না কারও  সময়টাই এমন যে মহালয়া থেকে শিউলী , তারপর কাশফুল সব কিছু মিলেই মনকে দোলা দেয়। 
আমি অষ্ট্রেলিয়ার এডেলএইডের বাসিন্দা । এখানেও আমার হিন্দু বন্ধু আছে। 
শারদীয় শুভেচ্ছা বিনিময় হওয়া থেকে , নেমন্তন্ন সবই চলছে। 
আজ এখানে চলছে মায়ের মহা নবমীর পূজা।
“যা দেবী সর্বেভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা
নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নম: নম:”
একটা কথা জানেন তো-
হিন্দুরা বেল পাতা পুড়ে কখনো রান্না করে না , তার কারণ হলো -বেলের পাতা দেখতে 'ত্রিনয়ন'-এর মতো। দুদিকে দুটি, মাঝখানে একটি। হিন্দুরা মনে করেন 'শিব' ত্রিকালদর্শী। তাঁর তিনটি চোখ আছে। দুর্গাও ত্রিনয়নী। এই তিনটি পত্র এই তিনটি চোখেরই প্রতীকী প্রকাশ। বেলপত্রের তিনটি পাতাও এই 'তিন' ভাবনা ও ভাবের প্রতীকী প্রকাশ। তাই বেলবৃক্ষকে হিন্দুরা পরম পবিত্র মনে করেন। 
বেলপাতার কথা আসলো একারণে যে ... পূজোতে বেল পাতা লাগে , হিন্দু পাড়া থেকে প্রায় আমাদের বাসায় বেল পাতা নিতে আসতো মানুষ । ঠিক এই সময়টাতে।

তখন ই টের পেতাম মা আসছে .....
কাত্যায়নী আবির্ভূতা হবেন শিঘ্রই। 

দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

দূর্গাপূজা উৎযাপন -পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক সম্মিলন, কেনাকাটা ও উপহার প্রদান, উপবাস, মণ্ডপ দর্শন, আলোকসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিমা বিসর্জন ইত্যাদি দিয়ে উৎযাপিত হয়।
দূর্গাষষ্ঠী:
কল্পারম্ভ পূজা, বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস।
মহাসপ্তমী: 
ক্ষেত্রবিশেষে কুলাচার অনুসারে সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ পূজা, নবপত্রিকা স্নান, প্রবেশ ও স্থাপন, মহাসপ্তমীবিহিত পূজা; ক্ষেত্রবিশেষে কুলাচার অনুসারে অষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ অথবা কেবল মহাষ্টমীবিহিত কল্পারম্ভ পূজা, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, দুর্গাষ্টমী ব্রত, বীরাষ্টমী ব্রত, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা মহোৎসব যাত্রা (তান্ত্রিক অনুষ্ঠান)
সন্ধিপূজা ও বলিদান;
মহানবমী: 
কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা, ক্ষেত্রবিশেষে কুমারী পূজা;
বিজয়াদশমী:
বিজয়াদশমীবিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, সিঁদুর খেলা, বিসর্জন, বিজয়াদশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা।

দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি ভারতের অসম,বিহার, ঝাড়খণ্ড,মণিপুর এবংওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। 

এই দূর্গাপূজা দেশের গন্ডি ছাড়িয়েও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও দুর্গাপূজা ধুমধামের সহিত পালন করে থাকেন।বাইরের দেশেও কাসর ঢাক বাজে , সিঁদুর খেলা হয় মহাসমারোহে । এ সব বাইরের দেশেও দূর্গাপূজোতেও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও বিভীন্ন কমিউনিটি সেন্টার বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকেন।

নাচ গান ভজন পূজন অতিথী আপ্যায়ন সব নিয়ম মাফিক হয় । এবং পাঁচটি দিন যথাক্রমে "দুর্গাষষ্ঠী", "মহাসপ্তমী", "মহাষ্টমী", "মহানবমী" ও "বিজয়াদশমী" ভীষণ ধুমধাম খাওয়া - দাওয়া , এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । তবে দেবী ভাসানোর ব্যপারটা এখানে কেমন হয় ঠিক জানি না। 

কেউ কেউ বলে ঠাকুরকে যত্ন করে রাখেন পূজো কমিটি পরের বছরের জন্য । আমি এ ব্যপারে নিশ্চিত নই । যদি এমন হয় , তবে তো সেই দেবী বির্সজনের  শ্লোগান কমিউনিটি হলের মধ্যেই গুমড়ে মরে। 

বলো দূর্গা মাই কি জয় ! 
আহা দেবী বির্সজনের দিনে  যেমনটা শুনতাম বাতাসে এই ধ্বনী  হা হা কার করে উঠতো ধরনী। 

আমরা যারা বাংলাদেশ কলকাতা থেকে এখানে এসেছি সবার কম বেশী জানা আছে যে -পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা "বনেদি বাড়ির পূজা" নামে পরিচিত।

পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলিতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। পূজা উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়-সমাগম হয়ে থাকে। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।
  
শুনেছিলাম দূর্গাপুজো গুলো প্রথমের দিকে বনেদী বাড়ির পূজো ছিল , পরে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মুলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারনা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাকি , বন্দে মাতরম গানটি রচনা করেন যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র।

দেবী দুর্গার পুজো ঘিরে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের কথিত প্রবাদ রয়েছে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে ..
ধর্মীয় আচরণের থেকেও অনেক বেশি উৎসব মনে হয় । আমি অন্য ধর্মের মানুষ হলেও দূর্গাপূজোতে মেতে উঠি , আমার মন চন্চল হয় । কারণ আমার বেড়ে ওঠা হিন্দু বন্ধুরা যেমন ঈদের দিনে নতুন জামা জুতো পরে বেড়াতে আসে , সকালের সেমাই খেতে , তেমনি আমিও এই পূজোতে অপেক্ষা করি নারকোলের ,তিলের , চিড়া মুড়ির মোয়া, ছানার পায়েসের জন্য। 

ছোটবেলায় দেখেছি কাকীমা দের কে অষ্টমীর দিনে .. সকালে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে ঠাকুরের সামনে বসতে । তিনবার হাতে গঙ্গাজল নিয়ে আচমন করতে । এবং হাতে ফুল নিয়ে  তিনবার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পড়ে ঠাকুরের চরণে তা প্রদান করতে। 

“ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে’’ 

ইত্যাদি বলে অঞ্জলি দিতে।

 সেই লাল পাড় সাদা শাড়ি আমার চোখ থেকে সরে না আজও , লম্বা সিথি জুড়ে সিঁদুরের দাগ , নাকের ডগায় ঝুরঝুর করে ঝরে পরা সিঁদুরের গুড়ো , হিন্দু বউদের সৌন্দর্য যেন সেদিন দেবীর মতোই সুন্দর । আলতা রাঙা পা , তার উপরে নুপুরের ঝুন ঝুন শব্দ ঝংকার । জডো়য়ার গয়না , শাখা পলা , এজন্যই বুঝি বলে সকল মেয়েই মা দুর্গার অংশ, তাই মৃন্ময়ী প্রতিমাকে পুজো করার পাশাপাশি কম বয়সের ছোট মেয়েদেরও পুজো করা হয় এদিন। 

শুনেছিলাম বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৯০১ সালে। ষোলো বছরের মেয়ে পর্যন্তই কুমারী হিসাবে পুজো করা যায়। একটি মেয়েকে প্রথমে আমন্ত্রণ করে তাকে শাড়ি ও গয়না উপহার দিতে হয়। সেই শাড়ি ও গয়না তাকে পরিয়ে মাতৃমূর্তির সামনে এনে উঁচু আসনে বসাতে হয়। কুমারীর পা জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার পূজা শুরু হয়। তাকে মিষ্টান্নাদি নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। তার উদ্দেশে অঞ্জলি দেওয়া হয়। এইদিন ওই কুমারীকে দেবী দুর্গার রূপ হিসাবেই ধরা হয়।

তখন আমি অনেক ছোট একবার আমার খেলার সাথী বন্দনাকে কুমারী পূজোর জন্য সাজাচ্ছিলো আমি ওর জলচৌকির সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওর আস্তে আস্তে দেবীরুপের মেকাপ গেটআপ ... কত যে নিয়ম কত যে আর্চা বাপ্প রে বাপ্প ! একটু খানি ছুঁয়ে দেখবো তাকে , না তা কি করে হয় , গঙ্গা জলে নাইয়ে নিয়ে আসা হয়েছে , ধূপ ধুনোর গন্ধ .. সিঁদুর চন্দন , ফুল ঘট ,  ফল ফলাদী কত্ত কি ! এখনো শৈশবের সেই আয়োজন এবং আমার বন্ধুকে দেবী হতে দেখার ক্ষণ টা মনে ভাসে । 
এছাড়াও আমি সন্ধি পূজোর পদ্মফুলের জন্য কত যে বায়না ধরতাম ।বান্ধবীকে পরিক্ষায় লুকিয়ে সাহায্য করতাম, আর প্রমিজ করাতাম , পূজোর সময় পদ্মফুল দিবি তো? 
এখন মনে পড়লে হাসি। 

সন্ধি দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মূলত অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিস্থলে অর্থাৎ অষ্টমী শেষ হবার ২৪ মিনিট ও নবমী শুরু হবার ২৪ মিনিট এই সময়ের মধ্যে এই পূজা হয়। এই সময়ে মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা করা হয়। এই পূজাতেই ১০৮ টি পদ্মফুল দেবীকে উৎসর্গ করা হয়।

এর মূলে রামায়ণের কাহিনী আমরা সবাই জানি। রাবণ বধের জন্য রাম ১০৮ পদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেন ও তারপর রাবণ নিধন হয়। সেই সূত্রেই এই সন্ধি পূজা করা হয়। দেবীর সামনে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য কাঁচা অবস্থায় এবং রান্না করা ভোগ হিসাবেও রাখা হয়।

১০৮ টি মাটির প্রদীপ দেবীর সামনে জ্বালানো হয়। এই সময়ে বলির নিয়ম আছে ।কোনো কোনো জায়গায় এই দিন বলিও দেওয়া হয়। বলি হিসাবে পশুবলি নিয়ে অনেক নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বলেই আঁখ, চালকুমড়ো এইসব বলি হিসাবে প্রদত্ত হয়। 
আমি তো আখের জন্য বন্ধুদের পাশে ঘুর ঘুর করতাম , যেমন করতাম নাড়ুর জন্য।

দূর্গার আবাস বিশ্ব চরাচর , যার অস্ত্রত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, বাণ, শক্তি, ঢাল, ধনুক, ঘণ্টা, পরশু, নাগপাশ , যার বাহন সিংহ ,সেই তো দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। 
প্রতিটি নারী দূর্গা রূপেই পৃথিবীতে জীবন যুদ্ধ সংসার ধর্ম আনুষ্ঠানিকতা পালন করে যায়। 

(তথ্য সুত্র: বিভীন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে ,
নেট থেকে , দূর্গা নিয়ে পড়া আর্টিকেল , এবং শারদীয় পূজোর সংখ্যা , শৈশবের স্মৃতির পাতা থেকে।)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours