শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

আজ গিয়েছিলাম শিমলা বাজার, (সরিষাবাড়ি /জামালপুর) শিব মন্দীর ও কালি মন্দীরে। অনেক বছর হলো আমার এলাকার মন্দীরে যাওয়া হয় না। ছোটবেলায় তো দুর্গাপুজার  লম্বা ছুটি পেতাম বিদ্যালয় থেকে। সম্ভবত পুজোর ছুটি থাকতো দশদিন। এখন বিদ্যালয় কদিন বন্ধ থাকে?  

 মুসলিম সম্প্রদায়ের হলেও বিদ্যালয়ের সনাতন সম্প্রদায়ের  ম্যাডামদের বাসায় তো নিমন্ত্রণ পেতামই। সনাতন সম্প্রদায়ের বন্ধুদের মা দিদিরাও তাদের হাত দিয়ে খাাবার মুখে তুলে দিতেন। 

মেলার কথা তো না বললেই নয়।  কতকিছু নিজে কিনতাম। কিনে দিতাম বোন ভাগ্নীদের। দূর্গা পুজোর মন্ডপে যেমন ভীর থাকতো তেমনি অগনিত মানুষ থাকতো মেলায়। এত ভির ও ক্রেতা থাকতো যে কুমোরেরা টের পেতো না দুষ্ট ছেলেরা মাটির ছোট ছোট হাতি ঘোড়া বাঘ, মটর গড়ি চুরি করে নিয়ে যেতো। যা না বললেই নয়; দূর্গা পুজোর সময় উপস্থিত দর্শক ও মেলায় আগত ক্রেতার অধিকাংশই ছিলো মুসলমান। কুমোরেরা অপেক্ষাই করতো। এই কয়টি দিনের জন্য। তাদের সাড়া  বছরের  আয়ের একটা বৃহত্তর অংশ আসতো এই মেলার আয় থেকে। পুজোয় কেবল মেলায় কুমোরদের আয় হতো না।  হাটবাজারে আয়, ব্যায় বেড়ে যেতো। আয় বেড়ে যেতো সিনেমা হলগুলোর।

আমি  আজ মন্দীরে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি পুজোর ভক্ত ও দর্শকদের সংখ্যা দেখে। এত কম! এ যেন অন্য কোন শিব মন্দীর দেখছি;
দেখছি অচেনা কোন জগন্নাথ মন্দীর।  আর এই দূর্গাপুজার মেলায় আগত দোকানের  সংখ্যা ও ক্রেতা দেখে  আমি নিজের চোখকেই  বিশ্বাসই করতে পারছি না!  আমার দেখা দূর্গাপুজার মেলায় আগত মানুষের এক পঞ্চমাংশ উপস্থিতি নেই! আর কেন যেন মনে হচ্ছে  ঢাকের বারি  কম। আগে সাড়াক্ষন ঢাকের বারি শোনা যেতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে,  আমাদের এলাকার মসজিদের  হুজুর  (কালা হুজুর বলে পরিচিত ছিলেন)  খাদেমকে পাঠাতেন মন্দীরের ঢোলটা একটু বন্ধ রাখতে। কেন না,  আমাদের বাজারের মসজিদ থেকে শিব মন্দীরের দুরত্ব মাত্র ৩০/৪০ ফুট! তারা ঢাকা বাজানো  সাময়িক  বিরতি দিতো।  তারপর যথারীতি ঢাক বাজানো শুরু হতো। 

পুজোর মেলায় আগত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা কমে যাওয়ার কারন কি? এটাও একটা গবেষনার বিষয়। তবে এ গবেষনার ফলাফল খুব একটা ভালো খবর বয়ে আনবে বলে মনে হয়  না। অন্তত  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য।। শুনলাম কোলকতায় দূর্গাপুজোর মন্ডপে আজান  দিয়ে, সুরা কেরাত পড়ে শোনানো হয়েছে! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন বজায় রাখার জন্য!  যে নির্বোধগুলো  এমনটা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে চায় সে নির্বোধগুলোর যে  ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী দর্শনের দ ও জানা নাই তা  তা বুঝতে ডক্টরেট ডিগ্রির দরকার নেই। তারা বাংলাদশের ওয়াজ মাহফিলে মূর্তি বিষয়ক বয়ান শুনে দেখতে পারে। কেন বাংলাদেশের দূর্গাপুজোর মন্ডপগুলোতে এখন আর মুসলিম 'দর্শক ' যায় না। তারা তা গবেবেষনা করে দেখেলেই  তাদের আজান দিয়ে সম্প্রীতি বজায় রাখার মত উদ্ভট ও হাস্যকর কাজের অসারতা চাক্ষুস দেখতে পাবেন। তার আরো পড়ে দেখতে পারেন  বাংলাদেশের জাতীয় দৈননিক পত্রিকাগুলোর কলাম। আমি  একটি পত্রিকা থেকে একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি; 
"কিছু লোক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপের কাজ আল্লাহর সাথে শিরক তথা মূর্তিপূজা করবে, ইসলামের দৃষ্টিতে যা মানব হত্যার চেয়েও ছোট অপরাধ নয়। "  অর্থাৎ মূর্তি পুজা এদের ভাষায় মানুষ হত্যার মত অপরাধ! 
আমি ছোট বেলায় কেবল শুনতাম মূর্তি পুজা দেখা পাপ। আর মুর্তিপুজা  করা  মহাপাপ।  আর ২০১৯ সালে শুনলাম; মূর্তি পুজা করা মানুষ হত্যা করার মত অপরাধ! 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপিকে অনেকেই অসাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীর  মনে করেন। সন্দেহ নেই  তিনি  ডানপন্থীদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তারপরও তিনি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলে যারপর নাই সমালোচিত হচ্ছেন।  যে কেউ ভিপি নুরুল হক নুরুর  এর পোষ্টে গিয়ে দেখতে পারেন।
  
ঢাকার একজন মেয়র  পুজা মন্ডপে ঢাক  বাজিয়েছেন বলে; হাদীস কোরআনের রেফারেন্স দিয়ে কলাম লেখা হচ্ছে, ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া হচ্ছে তার নাকি আর মুসলমানিত্বই নেই! 
অথচ, মমতা ব্যানার্জি যখন কালেমা পাঠ করেন,  রোজা রাখার কথা বলেন ; মাথায় ঘোমটা দেন তখন কিন্তু এরাই খুশিতে আত্মহারা।  নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যখন  হিজাব পরে মুসলিমদের সামনে আসে তখন এই সকল সমালোচকরাই বাহবা জানায়!  

আমার যে বন্ধুটি ১৭/১৮ বছর আগেও দূর্গাপুজা বিসর্জন দেয়ার সময় হিন্দুদের সাথে নদীতে নামতো। সেও তার  ছেলে মেয়েকে  এখন মন্দীরে গিয়ে পুজো দেখতে  নিষেধ করে। কেন না, পু্জো দেখা পাপ! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কখনো একতরফা হয় না। উভয় তরফ থেকে  সম্প্রীতির ঘোষনা আসতে হয়।  তা,না হলে সে সম্প্রীতি হাওয়াই মিঠাইয়ের মত হাওয়া হয়ে যাবে। একতরফা যেমন প্রেম পিড়ীতি হয় না  তেমনি একতরফা সম্প্রীতিও হওয়ার কথা কেবল অর্বাচীনেরাই ভাবতে পারে।

 ভারতের মুসলমানেরা পুজোর সময় কি বলে আমি জানি না। তবে বাংলাদেশের মৌলভী আলেম মুফতিরা বলে থাকেন পুজো দেখা পাপ। মনে হয় তাদের সে উপদেশ, বাংলাদেশের মুসলিমরা মেনে চলছেন। তাই দুর্গাপূজার মন্ডপে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের আসা হয়তো  আগের থেকে অনেকাংশে কমে গেছে।  আহ! যদি বাংলাদেশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের আলেম ওলামারা বলতো, ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যা, খুন, ধর্ষন, প্রতারনা 'পাপ'।  আর যদি মুসলিম সম্প্রদায় এ সকল 'পাপ 'থেকে দুরে থাকতো তবে কতই না ভালো হতো! কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাস বলে ; ধর্মবেত্তাদের বক্তব্য শুনে মানুষ যতটা  সাম্প্রদায়িক হয় ততটা সৎ হয় না। যতটা সাম্প্রদায়িকতাও ছাড়ানো যায় ততটা মানবিকতা ও সৌহার্দ্য ছড়ানো যায় না।  রাষ্ট্রীয় ভাবে  ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে কতটুকু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা যায়  তা ঐতিহাসিক ভাবেই প্রশ্ন বোধক। তবুও আশা করছি দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকুক
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours