শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

টিপ্নন হলো টিপুর ডাক নাম। এই টিপ্পনই ভারতের  ইতিহাসে টিপু সুলতান বলে সু-পরিচিত। আলোচনা করবো টিপু সুলতানকে নিয়ে। তবে, তার আগে একটু ইতিহাসের পেছনে ফিরে যেতে হবে। টিপু সুলতানের পিতার নাম হায়দার আলী। হায়দার আলির পিতার নাম ফতে মুহাম্মদ।  

হায়দার আলীর প্রপিতামহ শেখ ওয়ালী মোহাম্মদ ছিলেন মক্কা নগরীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। টানা কয়েক বছর ব্যবসায় লোকসান হলে মক্কা শহর ছেড়ে বাগদাদে বসবাস শুরু করেন। বাগদাদে বাড়িঘর করেও তার ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। তিনি ও তার পরিবার বাগদাদে বসবাসের সময় ভারতের ঐশ্বর্যের কথা শুনেছিলেন। ওয়ালী মুহাম্মদ স্ত্রীর পরামর্শে হিন্দুস্তানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং পরিবার বর্গসহ প্রথমে ভারতের পাঞ্জাবে আসেন। অতপর জীবিকার সন্ধানে দক্ষিণ ভারতের; দক্ষিণাপথে ' গুলবার্গে' এসে বসতি গড়েন।

শেখ ওয়ালী মোহাম্মদের নাতী 'ফতে মুহাম্মদ ' মহীশুরের  হিন্দু মহারাজার অধিনে সেনা বিভাগে চাকুরী গ্রহন করেন। ওয়ালী মুহম্মদের মৃত্যুর পর পরিবাবার পরিজন সহ মহিশুর রাজ্যে চলে আসেন। কর্মদক্ষতার দরুন তার পদন্নোতি ঘটে এবং তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। মহারাজার সেনা বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় এক যুদ্ধে ফতে মুহাম্মাদ মৃত্যু বরণ করেন। তখন পুত্র হায়দার আলীর বয়স মাত্র পাঁচ।  অর্থনৈতিক অসচ্ছলতায় পতিত হওয়ার কারনে হায়দার আলীর পড়ালেখা হয়নি। তাই তার মা চাইলেন হায়দার বড় হয়ে ব্যবসায়ী হোক। কিন্তু হায়দার চাইলেন বাবার মত সৈনিক হতে। এবং হিন্দু মহারাজার  সেনানিবাসে থেকে যুদ্ধবিদ্যা  রপ্ত করলেন।

মহিশুরের হিন্দু  মহারাজার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কূলীন ব্রাহ্মণ নন্দরাজ। হায়দার তার বীরত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী নন্দরাজের দৃষ্টি  আকর্ষণ করে। তিনি তাকে সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। হায়দার আলী দুই বিয়ে করেছিলেন। ১৭৫৩ সালে তার ২য় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয়  ফতে আলী টিপু সুলতান। ছোট বেলায় তার  ডাক নাম ছিলো টিপ্পন। টিপ্পন নামের এক দরবেশের আর্শীবাদে হায়দার পুত্র লাভ করেছেন বলে বিশ্বাস করে। তাই টিপুর ডাক নাম রাখা হয় টিপ্পন। 

হায়দার আলী সাধারণ  সৈনিক থেকে একময় গভর্নর হয় প্রধানমন্ত্রী নন্দরাজের কল্যানে। খুব দ্রুতই ১৫ শত অশ্বারোহী ও চাার হাজার পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত হন। হায়দার আলীর সাথে এবার প্রধানমন্ত্রী নন্দরাজের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কেন না, বংশানুক্রমিক  মহীশুর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর  পদটি নন্দরাজ বংশের জন্য নির্ধারিত ছিলো। যা হায়দার আলী সঠিক মনে করেননি। সেনাপতি হয়ে প্রথম আঘাত হানেন নন্দরাজের উপরই।  যদিও হায়দার আলীর উত্থানে শুরু থেকেই এই প্রধানমন্ত্রী নন্দরাজের  মদদ ছিলো।  প্রধানমন্ত্রীকে গদিচুত্য করায় মহারাজা  হায়দার আলীকে স্বাগত জানালেন, " আমার গুণধর পুত্র " বলে। হায়দার আলী মারাঠাদের আক্রমন প্রতিহত করেন।  যার কারনে দিল্লীর সম্রাট তাকে 'নবাব' উপাধিতে ভূষিত করে।  এক পর্যায়ে মহীশুরের রাজা হায়দার আলীর প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় শংকিত হয়ে উঠেন। এবং কৌশলে তাকে সেনাপতি পদ থেকে সরাতে চাইলে  ১৭৬১ সালে মহিশুরের রাজাকেই সিংহাসন থেকে উৎখাত করে নিজেকে মহীশুর রাজ্যের "নবাব" বলে ঘোষণা করেন। তখন তার পুত্র  টিপু সুলতানের বয়স ছিলো ৮ বছর। 

হায়দার আলী নিজে শিক্ষিত ছিলেন না বলে; নিজের সন্তান টিপুকে , আরবী, ফার্সী, ফ্রেন্স ও ইংরেজি সাহিত্য সহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনে ব্যাস্ত রাখেন।  মাত্র ১৫ বছর বয়সে পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠে টিপ্পন তথা টিপু সুলতান। টিপু সুলতান ও তার পিতা হায়দার আলী দুইটি রণাঙ্গনে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ রত ছিলেন। হায়দার আলী অার্কটের রণাঙ্গনে অসুস্থ হওয়ার পর মৃত্যু বরণ করেন যদিও তার বাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে।  পিতার মৃত্যুর সময় টিপু সুলতান উপস্থিত থাকতে পারেননি। তার ছোট ভাই  শাহাজাদা করীম শাহ দাফন সম্পন্ন করে মাত্র কয়েক দিন সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন।  কিন্তু বড় ভাই টিপু ফিরে এলে, সিংহাসন ছেড়ে দেয়। এবং  মহা ধূমধামে ১৭৮২ সালে টিপু সুলতানের রাজ্যাভিষেক হয়। টিপু ইংরেজদের যুদ্ধে পরাজিত করতে থাকলেন। কোন ষড়যন্ত্র ও সমরশক্তি তাকে রুখতে পারেনি। 

ভারতে আগত  আরবরা সাধারনত সবার সাথে আত্মীয়তা করতে চাই তো না। তারা নিজেরা সৈয়দ বলে গর্ববোধ করতো। টিপু সুলতান একবার তার শ্যালক বুরহান উদ্দীনকে সৈয়দ কন্যার সাথে বিয়ে করানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ' নগরের ' গভর্নর সৈয়দ বদরুজ্জামানের মেয়েকে শ্যালকের হাতে সমর্পনের প্রস্তাব পাঠান। টিপু সুলতান নবাব সৈয়দ বদরুজ্জামানকে দরবারে আমন্ত্রণ করেন। টিপু সুলতান তাকে দরবারে অভ্যর্থনাও জানান। নবাব প্রানের ভয়ে টিপু সুলতানের প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করতে পারেননি। কিন্তু  বদিরুজ্জামানের সৈয়দ বংশে এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নবাব কি ভাবে সৈয়দ হয়ে একজন  সৈয়দকন্যাকে,  শেখের ( টিপুর বংশ) হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।তারা অপমানিত বোধ করলেন এবং এ বিয়ের বিরোধিতা শুরু হলো। এমনকি বিয়ের নিদৃষ্ট দিনে সৈয়দ কন্যা,  শেখতনয়কে বিয়ে করা  এতই গর্হিত কাজ মনে করলেন সৈয়দ বদরুজ্জামানের কন্যা ইন্দিরাতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তবুও টিপু সুলতানের শ্যালকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবব্দ হলেন না। সৈয়াদজাদীর এই আত্মহত্যা  টিপুর রাজ্যের সকল সৈয়দকে মারাত্মকভাবে আহত করলো। তার এই আত্মহত্যার কাহিনী পুরো মহিলা শুর রাজ্যে ছড়িয়ে পরলো এবং এ জন্য সরাসরি টিপু সুলতানকে  দোষী মনে করলেন।
টিপু সুলতানের সাথে মারাঠা ও  ইংরেজ কোন ভাবেই  পেরে উঠছিলো না।
  
নিজাম বাহাদুরের সাথে পুত্র কন্যা বিয়ে দিয়েও টিপু সুলতান ঐক্য করতে চেয়েছিলেন।  নিজামরা  টিপু সুলতানের আত্মীয়তার প্রস্তাবে সারা দেয়নি।  নিজাম বাহিনী ও মারাঠা তখন একজোট ছিলো। টিপু সুলতান এই যৌথবাহিনীকেও পরাজিত করে।
তবে একসময় ইংরেজ, মারাঠা, নিজাম এই ত্রয়ী বাহিনীর নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অর্ধেক রাজ্য হারান। কেন না, তার দুই পুত্রও বন্দী হয়ে গিয়েছিলো।

টিপু সুলতানের মহিশুরের  প্রধানমন্ত্রী মীর সাদেক আলী রাজসভায়  আল্লাহ ও রাসুল মুহাম্মদের নামে শপথ করে বলেন, সুলতান ও রাজ্যের সাথে কখনো বেইমানি করবেন না। কিন্তু  তার আরেক সেনাপতি  কিষানও রাও যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন। তেমনি তার প্রধানমন্ত্রী ও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সাথে।যোগ দেয় তার ভাই শহাজাদা করীম শাহ! উল্ল্যেখ্য কিষান রাওয়ের স্ত্রী নিজের স্বামীর  একটি  ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন টিপু সুলতানের মায়ের মাধ্যমে। এবং টিপু কিষান রাওকে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগে বেশ গর্বভরেই বলেন, যে ষড়যন্ত্রের আগুন তিনি জ্বালিয়েছেন  তা আর নেভানো সম্ভব নয়।

প্রধানমন্ত্রী মীর সাদেক ও অর্থমন্ত্রী  পুর্নিয়া তথা তার ঘনিষ্ঠ একজন সৈয়দ ও ব্রাহ্মণের ইংরেজদের সাথে হাত মেলানোর কারনে মহিশুরের চতুর্থ যুদ্ধে টিপু সুলতান নিহত হয়।

টিপু সুলতানের  বংশধরদের বর্তমান চেন্নাইয়ের,ভেলোরে স্থানান্তরিত করা হয়। পূর্বচুক্তি অনুযায়ী মহিশুর রাজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। টিপু সুলতানের বংশধরেরা দিল্লী ও তামিলনাড়ুতে বসবাস করে থাকে।
বৃটিশদের ভারতবর্ষ দখল শুরু হয়েছিলো এক মীর জাফর দিয়ে আর দখল শেষ হয়ে ছিলো। আরেক মীর সাদেককে দিয়ে।  কোলকতায় ছিলো ধনকুবের জগৎশেঠ  আর মহিশুরে ছিলো অর্থমন্ত্রী পূর্নিয়া!  ইতিহাসের কি বিচিত্র মিল। সিরাজ দৌলার বিরুদ্ধে ছিলো খালাতো ভাই শওকত জং। আর টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ছিলো তার সৎ ভাই শাহ করীম। তার পর বৃটিশদের দিল্লী দখল অভিযান। খোদ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জন্য জিন্নাত মহল ইংরেজদের পক্ষ নেয়! বৃটিশদের ষড়যন্ত্র ভারতবর্ষে কোথায় ছিলো না?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours