কাজল ভট্টাচার্য সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

পুরুষের শিরদাঁড়াটা আজও আছে তো?
ফি বছর ঘটা করে তো দুর্গা পূজা করেন। লাখের পুজো, কোটির পুজো। একশো ফুটের মা দুগ্গা, থিমের দেবী। আগে ছিল সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, তিনদিনের পুজো। এখন তো পিতৃপক্ষ শেষ হতে না হতেই ঢ্যাং কুরাকুর, পুজোর বাদ্যি বেজেছে। একের পর আরেক পুজো উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। এবার তো আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সটান দিল্লি থেকে উড়ে এলেন শহরে। গোটা ঘটনা তাঁদের চোখের সামনেই। ত্রিশূলের ফলা দিয়ে দেবী সমানে খুঁচিয়ে চলেছেন অসুরের বুক। অসুরনিধন উৎসব। সবার মুখে তালা। তা বলি কী- কখনও অসুরের অসহায় মুখটির দিকে তাকিয়ে দেখেছেন?

প্রতিবছর নিয়ম করে দেবী দুর্গার পায়ের কাছে থেবড়া মেরে বসে থাকা অসুর। আগে তিন, সাড়ে তিনদিন। এখন সীমাহীন। অথচ চেহারাখানা একবার দেখুন অসুরের। রোজ যেন শহরের নামকরা জিমে যাতায়াত। কী হাতের গুলি ! সিক্স প্যাক এইট প্যাকের সলমন খান মার্কা শরীরখান। তবুও দেবীর সঙ্গে পেরে ওঠে না।

সেই ছোটবেলা থেকে এক দৃশ্য দেখে আসছি। দেবীর কত কায়দা! যুদ্ধ করতে যাওয়ার আগেও নির্ঘাত ফেসিয়াল। বিউটি পার্লারে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে, তবেই রণাঙ্গনে আসা। সাজপোশাকের বাহারও চোখে পড়ার মতো। তারপর কত রকম ভঙ্গিতেই না অসুরবধ।

অসুরও চুলটুল আঁচড়ে, গোঁফে কলপ করে তৈরি। তবু যুদ্ধে নামার আগে মালকোঁচা মারা ধুতিটার কোমরের বাঁধন আরও একবার দেখে নেওয়া। এমনিতে ইজ্জতহরণ চলেছেই। তারওপর আবার যুদ্ধের মাঝে সিংহ ধুতিতে টান মারলেই বিপদ। মরতে অসুরকে হবেই। স্ক্রিপ্টে সেরকমটাই আছে। নড়চড় হলেই রিটেক। নয়তো চাকরি যাবে। অগত্যা !

আপনিও তো পুরুষ। অসুরের এই অসহায় অবস্থা দেখে একবারও আপনার মন কাঁদে না? লাখো- লাখো মানুষের ভিড়ে মিশে, আপনার স্ত্রীর হাত ধরে সোৎসাহে প্যান্ডেল হপিং করে চলেছেন। সব জায়গাতেই নারীশক্তির জয়- জয়গান। আর মাটিতে লুটোপুটি অসুরের। তার গায়ে সিলমোহর দেগে দেওয়া হয়েছে অশুভ শক্তির।
একবারও জানতে ইচ্ছে করে না, অসুরের মনের ভেতর তখন কী চলছে ?

মনে আছে, সেটা ছিল দূরদর্শন জামানা। অনুষ্ঠানের নামটা আজ আর মনে পড়ে না। রাত দশটা নাগাদ হিন্দি ফিল্মের একেকজন তাবড় তাবড় স্টারকে ধরে আনা হতো। একবার দেখা গেল টিনসেল টাউনের এক মারদাঙ্গা ভিলেনকে। "প্রেম। প্রেম নাম হ্যায় মেরা !" প্রেম চোপড়া। নানা মজার মজার অভিজ্ঞতা শোনালেন তিনি। সবশেষে অনুষ্ঠানের প্রথা মেনে প্রেমকে জিজ্ঞেস করা হলো- আপকে আখরি খোয়াইস? আপনার শেষ ইচ্ছেটা কী?
একটুও না ভেবে প্রেম চোপড়া গম্ভীর গলায় বললেন- "এক পিকচার বনানা। জিসমে ম্যায় হিরো, অউর অমিতাভ বচ্চন ভিলেন।"
- কিঁউ? কারণ জানতে চাইলেন অ্যাঙ্কর।
-"বহুত পিটা মেরে কো," বলেন প্রেম। মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ। "হর পিকচার কে আখরি দো-তিন রিলমে খুব পিটাই হোতি থি মেরি।" সিনেমা পরিণতির দিকে গড়ালেই হলো। ভিলেনকে পেটানো শুরু হিরোর।

প্রেম চোপড়া, অ্যাঙ্কর দুজনেই এবার হাসিতে ফেটে পড়েন। "অব ম্যায় বদলা লুঙ্গা," বলেন প্রেম। "হিরো বনকে খুব পিটুঙ্গা অমিতাভকো।"
দুর্গার অসুরও মনে-মনে ওরকমটাই ভাবে। কিন্তু অসুরের হাল ওই প্রেম চোপড়ার মতোই। রুজি- রোজগারের প্রশ্ন। প্রোডিউসর, ডিরেক্টরের মন জুগিয়ে চলা। কোনদিন দূরদর্শনের স্টুডিওতে অসুরের ডাক পড়েনি। তার বাক স্বাধীনতা থাকলে, সেও ওই প্রেম চোপড়ার ভাষাতেই কথা বলতো।

আর আমরা ওই অসহায় প্রেম চোপড়া, অসুরের দিকে তাকিয়ে,  নিজেদের কথা ভাবি। ভাগ্যিস আমাদের গৃহাশ্রমে দেবীর হাতে সম্বতসর বধ হওয়াটা কেউ দেখতে পায় না। নইলে ইজ্জত বলে আর কিছু থাকতো না, মা দুগ্গার দিব্যি!

পুরুষমানুষের এই নিত্য ভোগযাপনের দৃশ্য নিয়ে হাজির হন মহাদেব।
দুর্গার পরেই কালীপুজা। দেবীশক্তির আরাধনা। কালো ছাগশিশু রক্ত দেবে আর জটাজুটধারী ব্যোমভোলা, যে কারুর সাতে নাই পাঁচেও নাই, সে দেবীর পায়ের তলায় লুটাবে। স্ত্রী তাঁর স্বামীর বুকে পা তুলে, একহাত লম্বা জিভ বার করে সেলফি তুলবেন। হাতে আবার নাঙা চকচকে খড়্গ। স্বামীর ঘাড়ে কটা মাথা যে সে নড়াচড়া করে।

এজন্যই মেয়েদের কাছে এত কদর শিবঠাকুরের। অসম্ভব ভালবাসেন স্ত্রীকে। বেপরোয়া এক চিরকালীন প্রেমী। আবার স্ত্রীর হেনস্থায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। জুড়ে দেন তান্ডব। সংসারের কোনও কিছুতে নাকগলানো নেই। নিজে শ্বশুরবাড়ি না গেলেও, স্ত্রীর বাপেরবাড়ি যাওয়া আটকান না। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নিজেতেই মত্ত। একদম সিধেসাধা লাইফস্টাইল। একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট! অথচ তিনিই দেবেরও দেব- দেবাদিদেব মহাদেব। এমন আদর্শ স্বামী আর কোথায়?

অথচ এই পুরুষমানুষটিরই হাল দেখুন। এসেই মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে তাকে। কালীপুজো খাতে বরাদ্দের শেষ নেই। আলো, বাজি, পুজোর সাজ- সরঞ্জাম আরও কত কী! অথচ শিবের জন্য? মাটির ওপর একখানা চাদর তো পাতা যেত! নিদেনপক্ষে একটা মাদুর। কালীপুজোও এখন একদিনে শেষ হয় না।

এমনি করেই দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ ধরে চলছে পুরুষশক্তির হেনস্থার পাইকারি প্রদর্শনী। আর নারীশক্তির জয়গান। তবু আশ মেটে না নারীদের। তাঁরা নাকি আজও অবলা। তাঁদের 'সবলা' করে তুলতে সরকারি প্রোজেক্ট। মেয়েদের জন্য রাজ্যের 'কন্যাশ্রী', কেন্দ্রের 'বেটি পড়ায়ো বেটি বঁচায়ো।

থেবড়া মেরে বসে থাকে পুরুষ। চোপ, ওভাবেই থাক! নারী আন্দোলন চলছে চলবে। আরও নারী স্বাধীনতা চাই। নিপাত যাক পুরুষতন্ত্র। ততদিন ওভাবেই মা দুগ্গার হাতে ত্রিশূলের খোঁচা খাক অসুর। মাটিতে গড়াগড়ি খাক শিব। আমরা পুরুষরা কিন্তু কিছুই দেখেও দেখবো না।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours