স্বপন নাথ, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক, বাংলাদেশ:
আমরা শৈশব ও কৈশোরে লক্ষ করেছি ও নিজে অংশগ্রহণ করেছি বিভিন্ন উৎসবে ঐক্যচেতনায়। হয়তো কর্পোরেট ছোবলে অনেক কিছুই এখন ম্লান। তবে, বাঙালি যেন অচেনা এক শক্তিতে জয়ী হয় বারবার। তা একান্তই বাঙালির লোকচেতনা, মাটির গন্ধে যা পরিপুষ্ট। বিবর্তন তো হবেই, যা হচ্ছে দুনিয়াব্যাপী।
আমরাও বদলে নিচ্ছি খাপ খাওয়ানোর তালে।
একসময় বাঙালি হিন্দুর পরিবারে উৎসবের ভাব বিরাজ করতো শরতের আগমনীবার্তায়। প্রতিবেশী অন্য ধর্মের লোকজনও জানতে চাইতো, এবারের পূজায় আমরা কী কী করতে যাচ্ছি! নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ কেনাকাটার একটা আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা জমে থাকতো সকলের মনে। এ-নিয়ে কল্পনা-জল্পনা দানা বাঁধতো কিশোর ও তরুণদের মনে। এ-কারণে আগে থেকেই বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হতো বাঙালির ঘরে ঘরে।
ওই সময় শ্রেণিহীন হওয়ার একটা তাগিদও লক্ষ করেছি। এ-চেতনা থেকেই দুর্গাপূজা ও শারদোৎসব সর্বজনীন হয়ে ওঠে। সাহিত্যেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। পূজার দিনে শরতের সকালে সাদা শেফালী ফুল কুড়াতাম আর পূজামণ্ডপে নিয়ে যেতাম। আমাদের এ-কাজ দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা আলাদা সমাদর করতেন, উৎসাহ দিতেন। এর সাথে থাকতো বিশেষ প্রসাদের আয়োজন। শরতের এ-আনন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় বলেছেন:
আজ কি তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলাধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর--
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরতকালের প্রভাতে (শরৎ)।
সুতরাং, পূজার উৎসব শুধু পূজার্চনায় রক্ষিত থাকেনি। বাঙালির নানা উৎসবের মধ্যে শারদীয় উৎসব একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যদিও বাঙালি হিন্দুদের পূজাবিধি একান্তই শাস্ত্রশাসিত। কিন্তু এর বাইরে সাংস্কৃতিক দিক থেকে তা আর বিধিবিধানের মাঝে নেই। এ-জন্য বাঙালি মাত্রেই শরৎকাল এলে উৎসবে মেতে ওঠে। পূজা সংস্কৃতি ও মননচর্চার উপলক্ষ্য মাত্র। তাই পূজা নয়, বাঙালির বর্ণিল ঋতুর বিচিত্র ভাব-ভাবনার সম্মিলনে পালিত হয় শারদোৎসব।
শাস্ত্র বা পুরাণে যা বলা আছে, তা থেকে আমরা বুঝে নিই, কেন মায়ের এতো প্রভাব। মূলত, মা হলেন জন্মধাত্রী ও এর অস্তিত্বের রক্ষক। তিনিই বাঁচিয়ে রাখেন সকল বিপদ-আপদ থেকে। ফলে, এ-বিশ্বকে অশুভ থেকে রক্ষাকল্পে মায়ের আরাধনার প্রচলন। অনেক বীর দেবতা থাকা সত্ত্বেও মায়ের বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্রহ্ম মৌল অস্তিত্বের আধার হলেন এ-দেবীরূপী দুর্গা। তাঁর অনেক বাহু। আমরা বিভিন্ন জাদুঘরসহ নানা ক্ষেত্রে তার প্রমাণও পেয়েছি। অমঙ্গল সংহার ও করুণার প্রতীক বলেই তার বিবিধ বাহু লক্ষণীয়। তিনি শক্তির আধারও বটে, যে শক্তির গৌরবে আমাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান।
প্রাচীন পুরণাদিতে দুর্গাপূজার উদাহরণ রয়েছে। বিভিন্ন নামে আগে একই বৈশিষ্ট্যের দেবতার পূজা হতো। বাঙালির কাছে দুর্গার বর্তমান রূপটি একসময় স্থিত হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য যে, পৌরাণিক যুগে যেভাবে এ-পূজার প্রচলনের কাহিনি আমরা পেয়ে থাকি, তা থেকে ভিন্নভাবে এখন পালিত হয় পূজা। আচারাদিতে পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি। বলা যায়, দুর্গাপূজার বাঙলায়ন হয়েছে। এর ফলে শুধু পূজার সীমারেখায় এ-উৎসব স্থিত হয়নি। রূপ নিয়েছে সর্বজনীনতায়। উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন বিবরণে জানা যায়, বঙ্গীয় অঞ্চলে এ-পূজার প্রচলন ঘটে সম্রাট আকবরের শাসনামলে। প্রচলনকারী হিসেবে কেউ বলেন রাজা কংসনারায়ণ; আবার অন্য তথ্যে মেলে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের নাম। অন্যত্র পাওয়া যায় যে, দশম শতকে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়। তবে সেকালে সকল পূজার ধরনও ছিলো ভিন্ন। ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় আবেদনের সাথে মানুষের প্রয়োজনে আরও বাড়তি আনন্দ-বিনোদনের পর্ব যুক্ত হতে থাকে। ফলে, পূজা ও আচারাদিতে মানবিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা আগে ছিলো শুধুই দেবদেবী উপাসনার বিষয় হিসেবে।
রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের সময় বারোয়ারি পূজার প্রচলন শুরু হয়। প্রতিমাপূজার যে প্রথা ছিলো, তা থেকে সরে এসে ঘটা করে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হতে দেখি। বিশেষত, ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ-পূজার সাথে বিনোদনের নানা উপকরণ যুক্ত হতে থাকে। ঔপনিবেশিক কর্তারা নিজেরা এতে অংশগ্রহণ করে ও এতে উৎসাহ জোগায়। সেসময় সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গের আগ্রহ, কামনা-বাসনা পূরণে, নিজের শক্তিসামর্থ্য প্রকাশের অংশ হিসেবেও পূজাপার্বণ পালনের ইতিহাস আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা, মুক্তির মন্ত্রে সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসে। তা-ই পূজার্চনায় সংরক্ষিত সে-মনগড়া বিধি-বিধান আর নেই। দুর্গা এখন গণদেবতার আসনে অধিষ্ঠিত। ফলে, শরৎকালের কাশফুলে, শেফালীর সুগন্ধ আর ফসলের আনন্দে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে এ-পূজা।
পূজা, প্রার্থনা, যাই হোক না কেন, বাঙালিত্বের সম্প্রীতির এ-আনন্দ জয়ী হোক, চিরকালীন হোক।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours