প্রশান্ত ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: 

পুরোহিত মহামহোপাধ্যায় পার্বতীনন্দন বাচস্পতি দর্পণ বিসর্জনের সমস্ত আয়োজন করে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করছেন, 'ওঁ গচ্ছ গচ্ছ স্খানং যত্র দেবো মহেশ্বরঃ। শত্রুদর্পবিনাশায় পুনরাগমনায় চ।।' দেবীর এই বিসর্জন মন্ত্রোচ্চারণের সময় ঢাক এবং কাঁসর সব স্থির হয়ে আছে, দর্পণ ভাসানো মাত্র ষোড়শোপচারে ফাইনাল রাউন্ডের জন্য বাজবে বলে। ঠিক সেই সময় একটি বিচিত্র আওয়াজ, অনেকটা শিঙা ফোঁকার মতো। প্রাজ্ঞ বাচস্পতি মশাই এইরকম  একটি বিজাতীয় শব্দে থতমত খেয়ে মন্ত্রোপাঠ থামিয়ে দিলেন। উপস্থিত যজমানেরাও অবাক। বাচস্পতির মনে হল এই নাদ যেন প্রতিমার দিক থেকে আসছে। তিনি দেবীর মুখের দিকে চোখ তুললেন। ওই বিচিত্র আওয়াজ তখনো হচ্ছে। বাচস্পতি দেখলেন, দেবী কাত্যায়নীও কিছুটা বিরক্ত। তার প্রশস্ত ললাট সামান্য কুঞ্চিত। কেউ কিছু ঠাওর করার আগেই আওয়াজ থেমে গেল। মহামহোপাধ্যায় ফের মন্ত্রোচ্চারণ করতে  শুরু করলেন, ওঁ গচ্ছ গচ্ছ... ফের সেই শব্দ, এবার যেন আরও জোরে বাজছে। বাচস্পতি বিরক্ত হয়ে প্রধান যজমানকে ধমকে উঠলেন, 'এসব কী হচ্ছে!' আর ঠিক তখনই দেবী দুর্গা ত্রিশূল ধরা হাতটি আলগা করে ব্লাউজের ভিতর সেই হাতটি ঢুকিয়ে একটি বিকট সাইজের স্যাটেলাইট ফোন বের করল।
আর মৃণ্ময়ীর এই রূপ দেখে বাচস্পতি মশাই হিটকি খেয়ে পড়লেন। প্রধান যজমানও চেতনাহীন। 
ওদিকে দেবী তখন কথা বলছে। ফোনটি করেছেন স্বয়ং মহাদেব। 
দেবী-- না যাত্রা করিনি।
মহাদেব-- মানে! বলেছিলুম না, এবার একদম রিক্স নেবে না। এনআরসি আপদটা রয়েছে। 
দেবী-- এখানে সেসব ভয় নেই। এটা বাংলা।
মহাদেব-- এইজন্যই বলে মেয়েদের বুদ্ধি হয় না। বাংলা যেন ভারতে নয়।
দেবী -- আহা! অত টেনশন করো না। তোমার ছেলেমেয়েরা খুব এনজয় করছে। 
মহাদেব-- আমি টেনশন করব না তো তোমার বাবা করবেন! তুমি ইমিডিয়েট রওনা হও। ওই গো-ছানাদের দেশে এক অনুপলও বেশি থাকবে না। 
বাবা তুলে আক্রমণ করায় দুগ্গার যুগপৎ ক্রোধ ও দুঃখ হল। তবু সে ভক্তমণ্ডলীর সামনে স্বামীকে পাল্টা গাল না দিয়ে শান্ত গলায় বলল-- বললুম তো আমার যেতে কয়েকদিন দেরি হবে।
মহাদেব -- কয়েকদিন মানে! আমি কয়েক পল-ও দেরি সহ্য করব না। 
বাবা-মার এই বাক্যালাপে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক সবাই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। এমনকী, মহিষাসুরও করুণ মুখে দুগ্গার দিকে তাকিয়ে।  
দেবী--- দেখো, ভক্তদের বাণিজ্যিক দিকটাও তো দেখতে হবে। ওরা একটা কতবড় কার্নিভাল করছে, গত তিন বছর ধরেই তো করছে। ওদের এই গ্রান্ড শো-টা ভেস্তে দেব!!! 
মহাদেব-- আরে গত তিন বছরের মতো এবারের হাল নয়। আগে ওই এনআরসি'র উৎপাত ছিল না। তুমি ইমিডিয়েট রওনা দেও। 
ঠিক তখনই সেখানে এসে হাজির হল উপ-প্রধান যজমান। সে ইতিমধ্যে আকণ্ঠ সিদ্ধি সেবা করে ফেলেছে। স্বচক্ষে দুগ্গাকে কথা বলতে দেখে এবং ওই প্রান্তে শিবের গলার আওয়াজ পেয়ে ডাবল চার্জ হয়ে গেল। গলা তুলে উপ-প্রধান যজমান বলে উঠল, 'মা ফোনটা একবার আমায় দেও তো, আমি বাবাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।' 
দুগ্গা বুঝল পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে। সে শিবকে পরে কথা বলতে অনুরোধ করল। কিন্তু ভোলানাথ ততক্ষণে দুর্গা ও ছেলেমেয়েদের জায়গা ডিটেনশন ক্যাম্পে না হয়, এই টেনশনে অস্থির। সে আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল, 'আমি ত্রিনয়নে দেখতে পাচ্ছি তোমাদের এই ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়ে শেষ হবে।' 
ততক্ষণে দেবীর হাত থেকে স্যাটেলাইট ফোনটা নিয়ে নিয়েছে উপ-প্রধান যজমান। সে শিবের ওপরে গলা তুলে বলল, 'বাবা, আই অ্যাম হৃষীকেশ গাঙ্গোয়ান, জয়েন্ট সেক্রেটারি অফ দি ভার্চুয়াল অ্যাসোসিয়েশন দুর্গোৎসব কমিটি। আমি আপনাকে বলছি, এবার আমরা কার্নিভালে চান্স পেয়েছি। ১১ অক্টোবর, রেড রোডে হবে কার্নিভাল। আপনি মাকে বাধা দেবেন না।' 
মহাদেব এই মরলোকের প্রাণীটির কথা কিছুটা বুঝলেও, ভাবতে পারছিল না। তার মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, 'আর এনআরসি?' 
উপ-প্রধান -- এখানে দিদি আছে। নো এনআরসি। ওসব শাহি হুঙ্কারে আমরা বিচলিত হই না।
মহাদেব-- তোমরা তো হও না। কিন্তু আমি তো কামাখ্যার মুখে শুনেছি, সেখানে কী কাণ্ডটা হচ্ছে! এরপরে কোন ভরসায় উমাকে থাকতে বলি।' 
উপ-প্রধান -- দিদির ভরসায়। আপনার যদি কোনো ক্যোয়ারি থাকে, আপনি দিদিকে বলোতে ফোন লাগান।
মহাদেব মহবিস্ময়ে বললেন, 'দিদিকে বলো!'
উপ-প্রধান-- সব মুশকিল আসান। রিং করুন -- ৫৮৪৬০৫৮৪৬০। 
মহাদেব উচ্চস্বরে, নন্দী কলমটা নিয়ায়, আর একটা পাতা। হ্যাঁ, নাম্বারটা আরেকবার প্লিজ।
উপ-প্রধান মহাদেবের মুখে প্লিজ শুনে একটু কুণ্ঠিত হল। লাজুক স্বরে বলল, প্লিজ বলবেন না, আপনার আমরা সেই কবেকার ভক্ত। নিন লিখে নিন, ৯৮৩৭০৯৮৩৭০। 
নাম্বারটা বলেই উপ-প্রধান স্যাটেলাইট ফোনের লাইনটি কেটে দিল এবং ফোনটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জিনসের হিপ পকেটে ঢোকাতে গিয়েছিল কিন্তু তার আগেই মহিষাসুর হাত বাড়িয়ে সেটা প্রায় কেড়ে নিয়ে দুগ্গাকে ফেরত দিল। আর ঠিক সেইসময় লক্ষ্মী গম্ভীর ভাবে বলল, ফোনটা অন করে রেখেছ কেন?
দুগ্গা, আরে ভুলে গিয়েছি। গতকাল রাতে সামান্য ফাঁকা পেতে একটু ফেসবুক করতে অন করেছিলাম। দুগ্গা একগাল হেসে বলল, অফ করতে ভুলেই গেছি। মহিষাসুর ওমনি ফুট কাটল, অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড় চড় করে। ততক্ষণে লক্ষ্মী বলল, তোমারও কি সরস্বতীর মতো যখনতখন ফেসবুক নিয়ে বসে পড়ার অভ্যেস হয়েছে। সরস্বতী দিদির এই কথায় মুখ বেঁকিয়ে শুধু হু করে একটা আওয়াজ করল। 
ওদিকে দিদিকে বলোতে ফোন করে তো মহাদেব একেবারে তাণ্ডব লাগিয়ে দিয়েছে। পিকের বাহিনীর লোকেরা যত বলছে, ওরকম করে ফোন করে দিদিকে পাওয়া যায় না। আপনি আপনার সমস্যাটা বলুন। আমরা দিদির কাছে পৌঁছে দেব। কিন্তু কৈলাসপতি নাছোড়বান্দা। অগত্যা উপায় বাতলে দিল পিকে স্বয়ং। হট লাইনে কানেকশন করে কনফারেন্সে দিদিকে নিলেন। শিব ও দিদি ডায়রেক্ট টক।
দিদি-- আপনি কে বলছেন? 
মহাদেব -- আমি মহাদেব বলছি।
দিদি--কোন মহাদেবদা? দুর্গাপুরের? 
মহাদেব শুনলেন দুর্গাপতি। খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ, দুর্গাপতি। কৈলাস থেকে বলছি।
দিদি -- কৈলাস বিজয়বর্গীয়! তা আমাকে কেন? 
মহাদেব -- ওরা যে বলল, দিদিকে বলোতে ফোন করতে। 
দিদি-- কারা বলল? 
মহাদেব -- দুর্গার এক ভক্ত। 
দিদি-- দুর্গা! মানে আমাদের উমাদি। 
মহাদেব-- ইয়েস। আই অ্যাম দ্য ওনলি হাজবেন্ড অফ দুর্গা।
দিদি থতমত খেয়ে গেল। মানে? আপনি কে বলছেন?!
মহাদেব -- আমি উমাপতি দেবাদিদেব মহাদেব।
দিদি রীতিমতো বিষম খেয়ে বলল, ' তা আমার কাছে কেন? এনি পবলেম?  
মহাদেব--- প্রবলেমই তো? আজ সন্ধের আগেই দুর্গাকে রওনা করিয়ে দিতে হবে।
দিদি-- তা আটকাচ্ছে কে! 
মহাদেব -- কার্নিভাল। 
এই কথা শুনেই দিদি বলতে শুরু করল, এই গ্র্যান্ড শো বিশ্ব-বাংলার ব্র্যান্ডিংয়ে প্রভূত সহায়তা করবে। বাংলায় পর্যটনের দুয়ার খুলে যাবে এই দুর্গা কার্নিভালের সৌজন্যে। আরও বহু বিদেশি পর্যটক আসবেন। বাংলার শারদোৎসব যে বিশ্বের অন্য দেশের যে কোনও উৎসবের তুলনায় পিছিয়ে নেই, তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে এই কার্নিভাল, বুঝলেন মহাদেবদা। 
দিদির মুখে 'মহাদেবদা' শুনে ভোলানাথ বাকরুদ্ধ, কেননা, এই তিন লক্ষ কোটি একত্রিশ হাজার বছরে, তাকে কেউ দাদা বলেনি! মহাদেব বুঝল এ কেমন দিদি। তবু সে ভুলল না। ফের বলল, 'আমার ভয় হচ্ছে ওই এনআরসি নিয়ে।' 
দিদি--ভয় করবেন না মহাদেবদা। যত ভয় পাবেন, তত ওরা ঘাড়ে চেপে বসবে। আর মনে রাখবেন, উমাদি এসেছেন বাংলায় মানে, আমার স্টেটে। এখানে শাহিশাসন চলে না। 
মহাদেব-- তবু ভারত তো? 
দিদি--- তো!? ভারত কি কারোর বাপের সম্পত্তি?
মহাদেব-- কিন্তু দাপের তো।
দিদি -- দাপ কি আমাদের কম আছে মহাদেবদা। উমাদি আর আপনার আশীর্বাদে আমরা এখনো মহাবলী। আমাদের স্টেটে কোনো এনআরসি হবে না। 
মহাদেব -- তাই যেন হয়। তবে রাজা দুর্জন হলে কিছুই তো মানে না। 
দিদি --- শুনুন মহাদেবদা, আমি রাফ অ্যান্ড টাফ আছি। ওরা দুর্জন হলে আমিও সুজন থাকব না। 
মহাদেব --সে তো যুদ্ধের কথা। 
দিদি-- যুদ্ধই তো। এই তো আপনার সহধর্মিণী রীতিমতো যুদ্ধ করে হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী। 
মহাদেব -- বেশ। বেশ। তবে কার্নিভাল হয়ে গেলেই রওনা করিয়ে দেবেন। 
দিদি -- টেনশন নেবেন না মহাদেবদা। উমাদিকে আমি ১১ অক্টোবর সন্ধেতেই ফ্লাইট ধরিয়ে  দেব। 
মহাদেব -- আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে জোর এল। 
দিদি -- শুভবিজয়া মহাদেবদা। 
লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। এদিকে বাচস্পতির জ্ঞান ফিরে আসার পর  আবার শুরু করেছেন, 'ওঁ গচ্ছ গচ্ছ স্খানং যত্র দেবো মহেশ্বরঃ।...


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours